আমি প্রায়ই একটা কথা বলি আমার ছেলেবেলায় আমার কোনো ঐতিহাসিক দিন বা ঘটনাবলী ইতিহাস বই দেখে তেমন পড়তে হয়নি। বিশেষ দিনগুলোতে নাচ, গান কবিতা, নাটকেই আমি জেনে গেছি সেসব ইতিহাস। সে বিশেষ দিনগুলো হতে শুরু করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতীয়ার খলজীই হোক কিংবা সুলতানা রাজিয়া। ছোটবেলার সেসব দিনগুলোকে একটু একটু মিস করলেও একদম ফুরিয়ে যায়নি আমার জীবন থেকে। কারণ বড়বেলায় এসেও আমি আমার কর্মজীবনেও বেছে নিয়েছি সেই ছোটবেলার আনন্দময় কাজগুলোকেই। এমনিতেই ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ফুরোবার পরেও রেশ থেকে যায় নানা রকম আয়োজনের। এর মাঝে পড়ে যায় আমার স্কুলের এনুয়াল শো ছাড়াও নানাস্থানে নানা একটিভিটিতে বাচ্চাদের নিয়ে পারফর্ম করানো। এই সব পার্ফরমেন্সের ক্ষেত্রে আমি অধিকাংশ সময়ই নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। তো এবারের চ্যালেঞ্জটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিলো। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পাড়ি দিতে হয়েছে আমার এবারের চ্যালেঞ্জে।
মাত্র ৩ মিনিটের একটা কাজের জন্য ৩০০ বছরের আয়ু কমে গিয়েছিলো আমার তবে তা আবারও ৬০০ বছর বেড়েও গেছে সাফল্যের আনন্দে এই যা রক্ষা। এই ৩০০ বছর কমে আবার ৬০০ বছর আয়ূ বাড়বার রহস্যটাই সেই আনন্দে বেঁচে চলা। হ্যাঁ যে কোনো কাজের এই সাফল্য আমাকে দেয় জীবনের সেই গতী। ছুটে চলার গতী, আনন্দের ফল্গুধারায় ভেসে যাওয়ার আনন্দ।
তো এ বছরে যখন এলইডি লাইট বাটারফ্লাই উইংস এর ড্যান্সটা করাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনও বুঝিনি এত সুকঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে আমাকে। যে কোনো নাচ তোলা বা বাচ্চাদের শিখিয়ে ফেলা সে আমার কাছে ডালভাত সদৃশ। যত কঠিন নাচই হোক ৩ সপ্তাহের মাঝে আমি ৩/৪/৫ বছরের পুচ্চিপাচ্চাদেরকে শিখিয়ে ফেলতে পারি আোনায়াসে এ ব্যাপারে আমি নিসন্দিহান তবে এবারের চ্যালেঞ্জটা ছিলো আমার সম্পূর্ন নতুন অভিজ্ঞতা। এই এলইডি লাইট প্রজাপতির ডানায় বাচ্চাদেরকে নাচাতে গিয়ে সে লাইটিং প্রজাপতি বানাতে হলো তা বানাতে গিয়েই আমি হিমসিম। প্রথমে কাজটা খুব সহজ মনে হলেও যত দিন যাচ্ছিলো বুঝলাম এটা যা ভেবেছি তা নয়। কাজেই আমি আমার আশে পাশে যারা আছে সবাইকেই অস্থির করে মেরেছি। রাত নেই, দিন নেই উইংস মেকারকে ফোন দিয়ে দিয়ে, প্যারেন্টসদেরকে এটা ওটা নানা কিছু সহযোগীতা চেয়ে, এমনকি আমার বাসার লোকজনকেও আমি জ্বালিয়ে মেরেছি। আর স্কুলের আমার কলিগদের কথা আর কি বলবো!
তবে যখন আমার বাচ্চারা স্টেজে উঠে আলো ঝলমল ডানা নিয়ে সম্পূর্ন দক্ষতায় নেচে গেলো এবং চারিদিকে প্রশংসার রোল উঠলো আমার এ কদিনের সকল পরিশ্রম, উদ্বিগ্নতার অবসান হলো। যাইহোক আমার এ সাফল্য আমার একার নয়। আমার বাচ্চারা যারা আমার অঙ্গুলী নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, পারফর্মেন্সটাকে সিরিয়াসলী নিয়ে এক বুক আনন্দের সাথে হাসি খুশি মুখে নেচেছে তাদের প্রতি তাই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি তাদেরকেই সবার আগে সন্মান জানাই। আর সাথে এক আকাশ ভালোবাসা আর প্রানভরা প্রার্থনা। এ জীবনে যেন তারা এভাবেই সকল কাজে সফল হয়।
তবে সেই অসাধারণ নৃত্য পরিবেশনার আগে এই ৭ প্রজাপতিকে ড্রেস পরাতে লেগেছে আমার পৌনে দুই ঘন্টা। এইটাই ছিলো সবচাইতে কঠিন পর্ব। তারপরও সকল হার্ড ওয়ার্কের পরে যখন বাচ্চারা সফল হলো তখন আমার প্রাণ জুড়ালো মন ভরালো।
এই সেই সপ্তবর্ণা রঙ্গিন আলো ঝলমল প্রজাপতিরা ও আমার হার্ড ওয়ার্কের অসাধারণ ফলাফল..
আগেই বলেছি আমার কাছে জীবন মানে গতি বা এই গতির সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলার নামই জীবন। তো এমনই গতিধারায় ডিঙ্গিয়ে এলাম এরপর আরও একটি সফল অর্জন। প্রথম আলো বর্ণমেলা। এই আয়োজনে শিশুদের নিয়ে সাফল্যের সাথে পাড়ি দিয়ে এলাম পাপেট শো "পান্তাবুড়ি"। এই যাত্রাতে সাথে ছিলো ৬ শিশু জায়না, রোজা, শামাইলা, অবন্তিকা, শামাহ এবং রুপ। মূল কাজটা তারাই করেছে এবং কৃতিত্বের সাথে। তবে এই কৃতিত্বের দাবীদার তাদের শিক্ষকেরাও। এই শিক্ষা প্রশিক্ষন ছাড়া এই সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, ছিলো না এবং কখনও হবেও না। শুধুই কি প্রশিক্ষন? তিল তিল করে সাজিয়ে তোলা পুতুলগুলো, তাদের জামা কাপড় শাড়ি চুড়ি মালা মুকুট কতই না উপকরণ? তাদের বাড়ি ঘর হাড়িকুড়ি যোগাড়ের দায়িত্ব। সর্বপোরি এই পান্তাবুড়ির গ্রাম, গাছপালা নদী, ঝোঁপঝাড় এসব নিয়ে গোটা গ্রামটাকেই বানিয়ে ফেলা একি এক জনের কাজ? কখনই নয়। তাই এই ৬ শিশুর সাথে প্রথমে নেওয়া হলো আরও ৬ জন প্রশিক্ষক এবং যথারিতী আমি পন্ডিৎ। তো প্রথমে আমরা সবাই মিলেই শুরু করলাম পাপেটগুলোকে যোগ্য সাজে সাজাতে। এর আগের শো তে এই পান্তাবুড়িই কুঁজো ও সাত ভূতের শোতে ছিলো কানাই এর পাঁজী মা তবে তার শাড়িটাও ছিলো সাদা এই যা রক্ষা। কিন্তু শাড়ির একি হাল। এই কদিন বাক্স বন্দী থেকে থেকে সাদা ধপধপে শাড়ি কুচকে হয়েছে লাল। না তা হতে পারেনা আমার মত পরিপাটি মানুষের কি আর বুড়ির শাড়ির এই হাল সহ্য হয়? কখনও না। আয়াকে বললাম শাড়ি ধুয়ে দাও। সে শাড়ি ধুলো। আমাদের আরেকজন ক্লিনারভাই সেই শাড়ি কাপড়, চোরের লুঙ্গি সব ইস্ত্রী করে দিলো।
শুরু হলো ট্রেইনিং। নতুন যোগ হওয়া শিশুরা ডায়ালগ পড়তে পারে না, পুতুল নাড়াতে পারেনা। সবগুলাকে নিয়ে বসলাম মিটিং এ। তিল তিল করে হেসে কেঁদে লাফিয়ে ঝাপিয়ে বুঝিয়ে দিলাম চরিত্রগুলো। তারা এত এত মন দিয়ে শুনলো যে এক মিটিং এই তাদের বুঝাবুঝি ওকে। এরপর দেখলাম স্টেজের করুণ হাল। চললো একই সাথে পুতুল সজ্জা, স্টেজ রিপিয়ার আর প্রশিক্ষন। একজন পুতুলের পেট সেলাই করে তো আরেকজন বানায় গোবর। একজন রাজার কাপড় পরায় তো আরেকজন আইকা লাগায়। এইভাবে মোটামুটি কাজ চলতে লাগলো। এর মাঝেই ছিলো লাইটিং ড্যান্স যা আমার সম্পূর্ণ নতুন এক্সপেরিমেন্ট।
লাইট ড্যান্স নিয়ে আমার মাথা খারাপ। আমাদের মঞ্চ সজ্জা পরিচালিকার ঘাড়ে রাজ্যের দায়িত্ব। এনুয়াল শো স্টেজ বানানো, ২১শে ফেব্রুয়ারীর শহীদ মিনার বানানো। আমি হঠাৎ তাকিয়ে দেখি হাতে সময় দুই দিন। রবি আর সোম বারের মাঝে আমাকে বানাতে হবে পান্তাবুড়ির গোটা গ্রাম। মরি মরি আর কি। যমকে বললাম, "দাঁড়ান বাবা যম। আগে আমার আনন্দময় কাজটা সেরে নেই তারপর আবার আসবেন প্লিজ!!!!!!!!! " যম রাজী হলো।
স্কুলে গিয়েই আমার ডে শিফট টিচারদেরকে লাগিয়ে দিলাম মঞ্চ পরিচালকের সাথে। আবার ডে শিফ্ট শুরু হলেই লেগে গেলো মর্নিং শিফ্ট।সাথে উৎসাহী আরও কয়েকজন। মিউজিক টিচারও পিয়ানো ছেড়ে হাতে নিলো রঙ তুলি......তারা আমাকে যতই আশস্থ করে বলে প্রেসার বাড়াইয়েন না আমি আছি। জান দিয়ে দেবো আমি তত বলি আমার জান যায় যায়। শাহীন মিস যাকে সবাই আমার জি সিরিয়াল শ্বাশুড়ি বলে আমাকে প্যানিক করার জন্য শুধু বকা দেয় বলে।আর জাকি পিচ্চি( এসিসট্যান্ট টিচার) তো পারলে আমাকে ঘুম পাড়ায় রেখে একাই সব করে ফেলে। তবুও মুঝে নিদ না আয়ি ......ভ্যা..... ......
যাইহোক, এসে গেলো বর্ণমেলা যাত্রা। সকল উপকরণ আর আমরা এক দল যাত্রীদের যাত্রা হলো শুরু। সুলতানা কামাল মহিলা কমপ্লেক্সে পৌছালাম আমরা সকাল ৯ টায়। একে একে সব রথী মহারথীরা মঙ্গে উঠলেন। চঞ্চল চৌধুরী, অপি করিম, অদিতি মুহসিন, আনিসুল হক গুনীজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠলো চারিধার। তারি মাঝে আমরা ক'জনা আমাদের টিম সাফল্যের সাথে উপহার দিলো এক মনোমুগ্ধকর পাপেট শো।
আমি যখন স্কুল ও প্রথম আলোর আয়োজনে একুশের মডেল.... ( সকলেই জানে নানা রকম কর্ম উদ্দীপনার মাঝে সাজুগুজুটাও আমার এক বিশেষ বৈশিষ্ঠ্যমূলক পছন্দের কাজ...... )
এরই মাঝে ছিলো আবার শীতকালীন পিঠা মেলা। কর্মক্ষেত্রে এবং আবাস অঞ্চলে। দুই খানেই হই হই রই রই ঝামেলা।গুলশান সোসাইটির পিঠামেলায় এবারে বেশি ঝামেলায় জড়াইনি। কিন্তু স্কুলেরটাতে দায়িত্ব ছিলো শিশুদের পিঠা চেনানো ও ছন্দে ছন্দে ছড়িতা পাঠ। তো পিঠা চেনানোর সাথে সাথে শুনিয়ে দিলাম আমার লেখা স্বরচিত ছড়িতা বাংলাদেশের পিঠা....
এর মাঝে চলেছে খানাপিনা রান্না বান্না অতিথী অভ্যাগতদের জন্য আয়োজন-
বিয়ের সিজন শীত গিয়ে ফাগুন এলো তবুও মানুষের বিয়ে করা থামেনা আর থাকে দাওয়াৎ আর দাওয়াৎ সাথে সাজুগুজু, খানাপিনা । কবে যে এসব খেয়ে খেয়ে হার্ট এটাক হয় ভাবছি। সাথে আবার নতুন ট্রেন্ড লেকসোর আর সিক্স সিজনে ব্রেকফাস্ট দাওয়াতেও শামিল হতে হলো!
গিয়েছি ঢাকা পাপেট থিয়েটারের আমন্ত্রনে। তাদের ছিলো চার রকমের পাপেট শো হ্যান্ড পাপেট, মাপেট, শ্যাডো পাপেট ও রড পাপেট। সাথে গ্রামাঞ্চলের বিখ্যাত বীনাবাণী পুতুলনাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমেছে সাপ বাদকের গাঁয়ে। বাঘকে রাজকুমারের সাথে সাথে ঢোলওয়ালা লাঠি দিয়ে সে কি মার । আমি হাসতে হাসতে , চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে শেষ!!!! হা হা হা
ছিলো ভ্যালেনটাইন। যদিও এ দিনটিকে ঘিরে একটা সময় নানা রকম উৎসাহ, উদ্দীপনা ও স্মৃতি থাকলেও আজ আর সেই স্মৃতির পাখিদের কাঁদাতে চাইনা তাই লাল শাড়ি পরে হেসে খেলে আনন্দ ও রিহারসেলেই কেটে গেছিলো সেদিনটা। তবে কাপল প্রোগ্রামে না থাকলেও আমারির পাশেই লেকসোরে খেয়েছি দলবেঁধে আর দেখেছি কপোত কপোতী......তবে
আকাশে উড়িছে বকপাতি, বেদনা আমার তারই সাথী ......... হা হা হা হা
যাকগে ভ্যালেনটাইন আমাকে কখনও তেমন টানেনা যা টানে তা ফাগুন কাজেই সকল আনন্দময় ব্যাস্ততায় হিমসিম খেতে খেতেও আমি মেতে উঠেছিলাম ফাগুনের আনন্দে। ফাগুন দোলায় এখনও দুলছি...... রেশ কাঁটতে সময় লাগবে আরও অনেকদিন......
পহেলা ফাল্গুন আমাকে দেয় জীবনের ফল্গুধারা.....আকন্ঠ পান করি আমি সঞ্জীবণী সূধা এই ফাগুনের কাছে থেকেই .......
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
বাঁধন ছেড়া প্রাণ ....... আমার আপন হারা প্রাণ .......
ওহ শেষে বলে রাখি শেষ হলো বইমেলা... এই বইমেলায় ছিলো আমার জীবনের প্রথম সম্পাদিত ব্লগার সংকলন রিদ্ধ-২। জীবনের প্রথম সম্পাদনা কাজেই আনন্দে হাবুডুবু না খেলে কি চলে!!!
যাইহোক এভাবেই কাটছে ব্যাস্ততাময় আনন্দঘন দিনগুলি। সকলের জন্য শুভকামনা ও ভালোবাসা......
এল ই ডি লাইট বাটারফ্লাই ড্যান্স এর রিহার্সেল ভিডিওটা দিলাম। মেইনটা সঙ্গত কারণে দেওয়া হলো না