যখন স্কুলে যেতাম প্রায়ই শুনতাম, প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়েছে।
তখন ছেলেরা মেয়েদের প্রেম নিবেদন করতো, আর মেয়েরা সেই প্রেম প্রত্যাখ্যান করলেই 'এসিড নিক্ষেপ'...... এসিড তখন হাতের নাগালেও ছিলো বটে, ঔষধের দোকানগুলোতেই বেশি পাওয়া যেতো।
গৃহবধূ নির্যাতনেও এসিডের একটা বড় ভূমিকা ছিলো। দাম্পত্যকলহ হলেই গৃহবধূকে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা মিলে এসিড নিক্ষেপ করতো। এমনকি রাতের আধারেও কিছু দুর্বৃত্ত, খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে এসিড ছুঁড়ে মারতো। একজনের উপর প্রতিশোধ মিটাতে এসে পরিবারের পাঁচজনকে এসিডে ঝলসে দিতো।
তখন প্রযুক্তি এতো উন্নত ছিলো না, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট এসব কিছুই ছিলো না। মিডিয়া বলতে শুধু পত্রিকা, তখন পত্রিকার পাতা মেলে ধরলেই দেখা যেতো এসিড নিক্ষেপের খবর। একপাশে সুন্দরী একটা মেয়ের ছবি, আর তার পাশেই সেই সুন্দরী মেয়েটির এসিডে ঝলসানো একটা বীভৎস চেহারা।
আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের স্কুল পাঠিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কখন জানি পাড়ার বখাটে ছেলেরা প্রেমের প্রস্তাব দেয়, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেই তো আদরের মেয়েটার মুখ এসিডে ঝলসে দেবে। কখনো ভয়ে আর আয়নায় নিজের চেহারা দেখবে না......
তখন এসিড নিক্ষেপ এমন ভাইরাল ছিলো, যদি কোন ছেলে তার বাসার হারিকেনের জন্য কেরোসিন তেলের বোতল নিয়ে রাস্তায় বের হতো, মেয়েরা আতঙ্কিত হয়ে যেতো, এসিডের বোতল ভেবে।
কত শত অভিভাবক তাদের সুন্দরি মেয়ের পড়াশুনা মাঝপথে বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কারণ এসিডে ঝলসানো বীভৎস চেহারার মেয়েকে পরে কেইবা বিয়ে করবে?
চারিদিকে এক এসিড নিক্ষেপ আতঙ্ক শুরু হয়ে গেলো। প্রশাসনও ব্যাপারটা রোধ করতে পারছে না, এসিড নিক্ষেপকারীকে জেলে ঢুকায় আবার কয় দিন পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে বীরদর্পে চলাফেরা....!
তারপর প্রশাসন ধরা শুরু করলো এসিডের উৎস গুলোকে, যেমন ঔষধের দোকান এবং আরো যেখান-যেখান থেকে এসিড পাওয়া যায়, যারা বিক্রি করে তাদের সহ এসিড নিক্ষেপকারীর সাজা কঠিন করতে থাকলো, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত।
এসিড বিক্রির জন্য লাইসেন্সের উপর কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারী হলো। যার ফলস্বরূপ, এখন এসিড নিক্ষেপের কোনো ঘটনাই আর শুনা যায় না....!!
এসিড নিক্ষেপ নিয়ে আমার এই লেখাটি যারা ধৈর্য সহকারে পড়লেন তাদের বলি, "আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য এসিড নিক্ষেপ ছিলনা, এটা শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড বললাম।
লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো "ধর্ষণ, ধর্ষক, ধর্ষিতা এবং এর প্রতিকার"। এই টপিকে বড় বড় লেখক, বুদ্ধিজীবীরা, সেলিব্রেটিরাও লিখেছেন। তাদের সামনে আমি অতি তুচ্ছ একজন এই বিষয়ে লেখার দুঃসাহস করছি।
এসিড নিক্ষেপের মত ধর্ষণ ও একদিন সমাজ থেকে নির্মূল হবে, এর জন্য এর মূল উৎসে যেতে হবে।
মেয়েদের পর্দা নিয়ে এতো হৈচৈ?? আগের যুগে তো মেয়েরা, মহিলারা স্লিভলেস(হাতা কাটা) জামা আর ব্লাউজ পরে রাস্তায় বের হতো।
আর আমাদের মা-খালাদের যুগে কি মেয়েরা স্টাইলিশ কাপড় পরতো না?? এখনের যুগের মেয়েদের মতো তারা তো বোরকাও পরতো না। কই তখন তো এত ধর্ষণ এর ঘটনা শুনা যেতো না, তাহলে এখন কেন!!!!!!
এখানে শুধু পর্দা দায়ী না, প্রযুক্তিও দায়ী। প্রযুক্তি যেমন আমাদের উপকার করছে তেমনি অপকারও করছে।
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র, পুলিশ, বাস ড্রাইভার, হেল্পার, দারোয়ান সবাই সহজেই মাত্র দশ টাকা খরচে ইন্টারনেট চালাতে পারছে। মাত্র বিশ টাকায় 'সাইবার ক্যাফেতে' বসে একঘণ্টা ভিডিও ব্রাউজিং করতে পারছে। আর একবার ইউটিউবে বা বিভিন্ন ভিডিও সাইটে ঢুকলে সহজে আর বের হতে পারছে না, চেইনের মত একটার পর একটা ভিডিও.......
"পার্কে গিয়ে ছেলে-মেয়ে কি করলো?,,, দেবর ভাবীর সাথে কি করলো? ,,, প্রবাসীর বউ, বাচ্চার প্রাইভেট টিচারের সাথে কি করলো?"
আর "নীল ছবির" তো কথাই নেই....
এসব 'যৌন উত্তেজনা' মূলক ভিডিও গুলোতে আরো লেখা থাকে, "শেষ পর্যন্ত না দেখলে চরম মিস করবেন"।
"যেন আপনাকে ঠাকুরমার
ঝুলির রুপকথার গল্প শুনানো হচ্ছে, শেষটা শুনতে হবে কারণ পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার আসছে, রাজকুমারীকে দৈত্যের হাত থেকে বাঁচাতে।"
প্রযুক্তি এসব নষ্টামি গুলো ফলাও করে প্রচারের সুযোগ হাতের নাগালে করে না দিলে, ধর্ষন আজ এতোটাও সহজ হতো না।
কিছু হরমোনাল বৈশিষ্ট্যের কারণেই ছেলেদের জৈবিক চাহিদা বেশি থাকে, তারা যখন এসব কুরুচিকর ভিডিও দেখে তখন তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। তখন সে ভুলে যায় একটা যুবতীমেয়ে আর বাচ্চামেয়ের মধ্যকার পার্থক্য, তখন সে মরিয়া হয়ে মাধ্যম খুঁজে তার জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য....... হোক সে মাধ্যমটা কোনো কোলের শিশু, হোক সে কোনো বাবা-মার আদরের দুলালি, হোক সে কোনো প্রতিবন্ধী বা কোন পাগলী......!!!
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে যতক্ষণ বাড়ী ফিরে না আসে, ততক্ষণ আমরা আতঙ্কে থাকি।
যেই বাস ড্রাইভার, কন্ডাকটর, আমাদের মেয়েদের গন্তব্য পৌছে দিতো আজ তারা আমাদের মেয়েদের কবরে পৌছে দিচ্ছে।
পরকালে আমাদের এই প্রজন্মকে কি মুখ দেখাবো???
সরকার ও প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ, "প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজে যে 'বিকৃত যৌনতা' ছড়াচ্ছে আগে সেটা বন্ধ করুন।
শুধু জেল ভারী করে কি লাভ!!!! ধর্ষকের সাজা হোক মৃত্যুদন্ড...
"কিছুদিন আগে সৌদি আরবে, একটা মেয়েকে ধর্ষণ করায় পাঁচজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।"
আমাদের আইনে সৌদি আরবের মত, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। তাই বলে কি ধর্ষণ অপ্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মতোও অপরাধ না???
কিছু ধর্ষকের লাশ যাক না তার গ্রামে, কিছু ধর্ষকের লাশ যাক না তার এলাকায়, কিছু ধর্ষকের লাশ যাক না তার পরিবারের প্রিয়জনদের কাছে। সেই লাশগুলো দেখে আতঙ্কিত হউক একটি মহল্লা, একটি এলাকা, একটি গ্রাম........
এভাবে করেই হয়ত ধীরে-ধীরে ভয় পাবে গোটা একটি সমাজ, তারপর গোটা দেশ।
যেমন একদিন ভয় পেয়ে, এসিড নিক্ষেপকারী সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছিলো, তেমনি ভয় পেয়ে একদিন সমাজ থেকে ধর্ষণকারীও নির্মূল হয়ে যাবে।
আমরা বাঙালিজাতি সব পারি, নয় মাস যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা আনতে পারি, কোটা বাতিল করতে পারি।
তাহলে কেন সমাজকে, দেশকে ধর্ষকমুক্ত করতে পারবোনা???
সরকার ও প্রশাসন সোচ্চার হয়ে এগিয়ে এলে কেন পারবোনা, অবশ্যই পারবো......!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:০৬