somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউঃ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ কাছে থেকে দেখা।

১৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


লেখকঃ মাহমুদ নূরুল হুদা
প্রকাশকঃ সাহিত্য প্রকাশ, প্রকাশকালঃ ১৯৯৩
দামঃ ১৫০ টাকা।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমি উনার সম্পর্কে জেনেছি পূর্বে তিনটি বই থেকে, এক- আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, দুই- অসমাপ্ত আত্নজীবনী, তিন- ছোটদের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এবং ৭-৮ মাস আগে বাংলাদেশ সরকারের একজন সাবেক সচিব, ঢাবির ৫২-৫৩ সালের একজন ছাত্রের সাথে কয়েক ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল তা থেকে।
উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের তালিকা করলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম চার বা পাঁচ নম্বরে আসবে। উনার জীবনী পাঠ আপনাকে ইতিহাসের রাস্তায় নিয়ে যাবে। অনুভব করতে পারবেন সেই সময়ের রোমাঞ্চ।

বইয়ের প্রথমে শহীদ সাহেবের পরিবার সম্পর্কে লেখা। যদিও আমার কখনোই কারো পারিবারিক পরিচয় নিয়ে আগ্রহ আসে না। কারন আমরা সবাই জানি ইব্রাহিম আঃ এর পিতা কে ছিল কিংবা নুহ আঃ এর পুত্র। যারা এটাকে গুরুত্ব দেন তাদের এ অংশ ভাল লাগবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পুরুষ এই ভূখণ্ডে এসেছিলেন ইসলাম প্রচার করতে। উনার বাবা, মা, ভাই, নানা, মামা, খালা সবাই অতি অভিজাত। বিশেষ করে উনার নানা [এবং বড় দাদা] মওলানা উবায়দী সোহরাওয়ার্দী একজন কিংবদন্তী তুল্য মানুষ। পুরাণ ঢাকার নজরুল কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। লিখিত বইয়ের সংখ্যা ৪৮।
উনার আম্মা খুজিস্তা বানু একজন কবি এবং ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট।

উনার বাবা জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মওলানা উবায়দীরই ভাতিজা কোলকাতা হাইকোটের বিচারক এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন। এবং তিনিও কবি ছিলেন।

তবে আমার দৃষ্টি গিয়েছে মামার দিকে, আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী। তিনিও ছিলেন একজন স্কলার। বই পোকারা অনেকেই জানেন লিও টলস্টয় যখন মারা যান তার ওভার কোটের পকেটে একটা বই পাওয়া যায়, “সেইংস অব মোহাম্মাদ”। এই বইয়ের লেখক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মামা আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী।

বইতে শহীদ সাহেবের ছাত্র জীবন সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত কথা নেই। ১৯২৬ সাল থেকে মৃত্যু ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এরপরের ঘটনাও তেমন বিস্তারিত নেই। বেশ ঘটনা বহুল জীবন শহীদ সাহেবের। আইনজীবী, শ্রমিক নেতা থেকে চিও রঞ্জন দাসের সাথে মুসলিম হিন্দু ঐক্যের জন্য কাজ করেন। অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলাকে পরাজিত করেন। দাঙ্গা রোধে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনকের একজন। তবে তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না একটুও। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার একটা ঘটনা উল্লেখ আছে বইতে...
"সোহরাওয়ার্দী সাহেব উদীয়মান দেশী ব্যবসায়ী রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহাকে আগে থেকে চিনতেন এবং তার দরদী মনের কথা জানতেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, আমি তোমাকে একটি বড় কাজ দেব। কাজটি যদি তুমি ঠিকমত করতে পার, তবে সমস্ত দেশবাসী উপকৃত হবে। বাংলাদেশের তাঁতিদের হাতে সুতা পৌছাবার জন্য আমি তোমাকে সারা বাংলার একক ডিস্ট্রিবিউটর নিযুক্ত করবো। তুমি বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের মালিক, তোমার কাছে অনেক লঞ্চ ও বড় বড় বোট আছে। তুমি সুতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার যানবাহনের মাধ্যমে তাঁতিদের কাছে পৌছাবার ব্যবস্থা করবে। এই কাজে তোমার অনেক লাভ হবে জানি। আমি জানি তুমি মানব দরদী। এই কাজের লাভের টাকা দিয়ে তুমি জনহিতকর কোন কাজ করবে বলে আমি আশা করি। আর. পি. সাহা বললেন, স্যার, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো” -[৯২ পৃষ্ঠা]।
আর. পি. সাহা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন। তিনি এই লাভের টাকা দিয়ে মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ । এই ট্রস্টের অধীনে পরে প্রতিষ্ঠিত হয় মেয়েদের আবাসিক বিদ্যালয় ভারতেশ্বরী হোমস সহ অনেকগুলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।

দেশ ভাগের সময় তিনি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে অখণ্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে রাজি করে ফেলেন। কিন্তু বাঁধ সাথে উগ্র হিন্দুবাদীরা। তখন তিনি বলেছিলেন, “তাহারা হয়তো বুঝিতে পারিতেছে না যে তাহাদের বাংলা একটি নিকৃষ্ট প্রদেশে [তখন বাংলা ভারতের সবচেয়ে অভিজাত এবং ধনী প্রদেশ ছিল] পরিণত হইবে এবং দ্বিখণ্ডিত ভারতের পিছনের সারিতে স্থান পাইবে”। পরে খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে কিছু ক্ষমতা লোভী শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ভাগ হয় বাংলা যার ফলে পরে যুদ্ধ এবং দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

দেশভাগের পর মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ অনেকবার শহীদ সাহেবকে অনুরোধ করেন পাকিস্তানে এসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। তিনি বলেন ভারতের মুসলমানদের জন্য একটা ব্যবস্থা না করে তিনি যাবেন না [তখন সমগ্র ভারতে দাঙ্গা লেগেছিল। স্বভাবিক ভাবেই মুসলিমরা ছিল এর সহজ স্বীকার]। তিনি গান্ধীকে অনুরোধ করেন এবং তাকে নিয়ে শুরু করেন কাজ, যা “গান্ধী-সোহরাওয়ার্দী পিস মিশন” নামে পরিচিত হয়। এটি এখন পর্যন্ত উপমহাদেশে হওয়া সবচেয়ে সফল দাঙ্গা বিরোধী মিশন। এতে স্বাভাবিক ভাবেই আর এস এস সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। তাকে হত্যার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেন।

এরপর দেশে আগমন, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন, মন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হবার ঘটনার বেশ সাবলীল বায়ান করা হয়েছে বইয়ে। সর্বশেষ উনার ইন্তেকাল এবং তাতে বাংলাদেশের মানুষের কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তার বর্ণনার মাধ্যমে বইটি শেষ হয়। লেখকের বর্ণনা,

“বিমান রানওয়েতে থামলে আমি বিমানে উঠি এবং ক্রুদের সহযোগিতায় কফিন প্লেনের পাশে এনে অপেক্ষমাণ ট্রাকে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছে হস্তান্তর করি। ঐ সময়ে লক্ষ জনতার ক্রন্দন রোল আমার এখনো মনে আছে। লাশ গ্রহনের সময় শেখ মুজিব যে আর্তনাদ করে উঠেছিল, তা উপস্থিত জনতাকে উদ্বেলিত করে। এক সময় তাকিয়ে দেখি মওলানা ভাসানী গালে হাত দিয়ে রানওয়েতে বসে কাঁদছেন।... জানাজার নামাজ পাঁচবার পড়তে হলো। জনতা ক্রমেই আসতে থাকে এবং তারা জানাজার নামাজ পড়ার জন্য দাবি করতে থাকে। আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক জানাজায় অংশ নেয়।

লেখকের পরিচয় দেওয়া হয়নি। তিনি এককালের তুখোড় ছাত্রনেতা। হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলনের একজন পুরোধা এবং আট বছর শহীদ সাহেবের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন।

উপমহাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সাক্ষী এই বইটি। বইটা পড়ে যে অনুভূতি হবে তার কাছে ১৫০ টাকা তুচ্ছ...
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১:২০
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×