somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার
আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

এক নিভৃত নায়কের কথা-কর্নেল জামিল আহমেদ

১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শোকাবহ ১৫ই আগষ্ট, ’৭৫ এর ট্র্যাজেডী নিয়ে বহু আলোচনা হয়। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু; এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় আরেকজন মহান লোকের শিক্ষনীয় কর্তব্যবোধ ও আত্মত্যাগের এক বিরল ও উজ্জ্বল আদর্শের দৃষ্টান্ত। সেদিন সকালে আক্রান্ত হবার পরে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েক যায়গায় সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ফোন করেছিলেন, নানান কারনে কোথাও থেকে প্রত্যাশীত সাহায্য পাননি।

ব্যাতিক্রম শুধু একজন। তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধু র জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যাওয়া পাকিস্তান ফেরত একজন সেনা অফিসার; কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তার সেই আত্মত্যাগের ঘটনা নিয়েই এ কাহিনী।

১৫ আগষ্ট ভোরবেলা,‌ ১৯৭৫; গণভবনের সরকারী কোয়ার্টারে ঘুমন্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সামরিক সচিব কর্নেল জামিল। দিনটি তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, এদিন তার ডিজিএফআই এর প্রধানের দায়িত্ব নেবার কথা। বঙ্গবন্ধুও সকাল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে যাবার কথা। তার নিরাপত্তা নিয়ে গতদিন কেটেছে তার খুবই ব্যস্ত। বংগবন্ধুর ৩২ নং এর বাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে কখনোই জামিল সন্তুষ্ট নন, এ নিয়ে প্রায়ই আক্ষেপ করতেন যে বঙ্গবন্ধু কেন যে গণভবনের কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকতে চান না। আবার নিজেই বলতেন যে তাতে কি, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করতে হলে আগে আমাকে গুলি করতে হবে। কথাটি ফলে গেছিল খুবই করুন ভাবে।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততা অর্জন তিনি রাতারাতি করেননি। বিশেষ করে একজন পাকিস্তান ফেরত অফিসার হয়ে অমন গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পাওয়া খুব সহজ কথা ছিল না।বঙ্গবন্ধু র সাথে তার পরিচয় সেই পাকিস্তান আমল থেকেই, বংগবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি ঢাকায় আইএসআই প্রধান। তখন থেকেই তিনি দেশপ্রেম ও বিশ্বস্তার কারনে বঙ্গবন্ধু র গভীর আস্থা অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ফাদার ও বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করতেন।

ভোর ৫টার দিকে জামিলের বাড়ির ফোন বেজে উঠল। জামিলের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা জামিল ফোন ধরলেন; অপর প্রান্তে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জলদ গম্ভীর কন্ঠ; জামিলকে চাচ্ছেন। মিসেস জামিল জামিলকে ফোন দিলেন। মিসেস জামিল অপর প্রান্তের কথা শুনলেন না, জামিলকে শুধু বলতে শুনলেন, আমি এখনই আসছি স্যার। জামিল ফোন রেখে স্ত্রীকে বললেন যে কারা যেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমন করেছে। তার জীবন বিপন্ন, আমাকে এখনই যেতে হবে। ড্রাইভার আইনুদ্দিনকে দ্রুত তৈরী হতে নির্দেশ দিলেন, নিজেও সিভিল পোষাকে তৈরী হওয়া শুরু করলেন। এরই ফাঁকে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বললেন, রক্ষীবাহিনী সদর দফতরেও ফোন করলেন। সিভিল পোষাকে প্রস্তুত হলেও তার গুলি ভর্তি সার্ভিস রিভলবারও নিলেন। বাবা মায়ের নীচু শব্দের কথাবার্তায় পাশের ঘর থেকে বড় মেয়ে কংকাও ঘুম ভেঙ্গে ঘরে ঢুকেছে। সে শুধু দেখল তার বাবা তৈরী হয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন। বেরিয়ে যাবার আগে আরেকবার নিজেই বংগবনধুর বাড়িতে ফোন করলেন, তবে সেখানে কেউ ফোন ধরছে না।

তিনি চেষ্টা করলেন তার অধীনস্থ প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) বাহিনী সমেত যেতে। কিন্তু সে সময় সেখানে বাহিনী নেবার মত জীপ ছিল না। তাই বাহিনীকে মার্চ করে রওনা হবার নির্দেশ দিয়ে নিজের লাল নিশান প্রিন্স গাড়ি নিয়ে আগে রওনা দেবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। গাড়িতে রওনা দেবার আগে স্ত্রী শেষ আরেকবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে যেতেই হবে? কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তিনি জবাব দিলেন, পাগল হয়েছ? বঙ্গবন্ধুর জীবন বিপন্ন আর আমি যাব না? একটি সিগারেট ধরিয়ে এক গ্লাস পানি পান করে বেরিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। যাবার আগে বলে গেলেন, আমার মেয়েদের ভাল করে যত্ন কোর। স্ত্রী এবং বড় মেয়ের হতবিহবল দৃষ্টির সামনে ড্রাইভার আইনুদ্দিন সবেগে গাড়ি ছেড়ে দিল। তারা পেছনে ফিরতেই বাড়ির একজন গার্ড বলে উঠল, আপনারা ওনাকে যেতে দিলেন! মিসেস জামিল ও মেয়ে কংকা তখনো জানে না যে তাদের প্রিয়জন আর জীবিত ফেরত আসবেন না, সে যাত্রাই তার শেষ যাত্রা।

পরের ঘটনা জানা যায় ড্রাইভার আইনুদ্দিন ও সোবহানবাগ মসজিদের ইমামের ভাষ্য থেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌছে আর তারা এগুতে পারছেন না। সেখানে ঘাতক দলের একটি বাহিনী রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আটকে রেখেছে। জামিল গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেডের দিকে এগিয়ে গেলেন। দায়িত্বে আছে এক সুবেদার মেজর। তাকে জামিল নিজের পরিচয় দিয়ে নির্দেশ দিলেন ব্যারিকেড সরাতে এবং তার সাথে বাহিনী নিয়ে এগুতে। সুবেদার মেজর একটু দ্বিধায় পড়ে গেল।

এমন সময় এগিয়ে এল ঘাতক দলের একজন অন্যতম অফিসার বজলুল হুদা। সে আদতে ক্যাপ্টেন, তবে সেদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে খুনোখুনিতে বিশেষ পারদর্শীতা দেখাবার পুরষ্কার হিসেবে ফারুক তাকে তাতক্ষনিক ভাবে বঙ্গবন্ধু র বাড়ির উঠোনে মেজর পদে প্রমোশন দেয়। আরেকজন জেসিওকেও প্রমোশন দিয়ে অনারারি লেফটেন্যান্ট বানায় ফারুক। উল্লসিত ফারুক নিজের হাতেই দুই জনের কাঁধের ব্যাজ বদলাবদলি করে। তাই বজলুল হুদার কাঁধে এখন মেজরের শাপলা ব্যাজ চকচক করছে, হাভভাবে চরম ঔদ্ধত্য।

বজলুল হুদা এসে সুবেদার মেজরের কাছে জানতে চায়, গাড়িতে কে? কর্নেল জামিল, স্যার; জবাব আসে। ড্রাইভার আইনুদ্দিনের ভাষ্যমতে বজলুল হুদা জামিলের নাম শোনা মাত্র সুবেদার মেজরকে গুলি করার নির্দেশ দেয়। ভ্যাবাচ্যাকা সুবেদার মেজর এ নির্দেশ পালনে অস্বীকৃত জানায়, না আমি পারব না। এর ফলে বজলুল হুদা নিজেই ষ্টেনগান হাতে এগিয়ে এল, বিনা বাক্য ব্যায়ে গাড়িতে বসা জামিলকে লক্ষ্য করে এক ঝাঁক গুলি ছুড়ে দিল, তিনবার লা ইলাহা পড়তে পড়তে পরপারে পাড়ি দিলেন জামিল, রেখে গেলেন কর্তব্যবোধ ও আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বলে রাখা ভাল যে জামিল সেখানে পৌছাবার আগেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পাইকারি হত্যাকান্ড শেষ হয়ে গেছিল। ড্রাইভার আইনুদ্দিন প্রান ভয়ে কোনমতে পালিয়ে গেল। পুরো ঘটনার একমাত্র সিভিলিয়ান স্বাক্ষী হয়ে রইলেন সোবহানবাগ মসজিদের ইমাম সাহেব। হত্যাকান্ডের পর সৈন্যরা জামিলের লাশ সহ গাড়ি ঠেলে ঠেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যায়, বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় ফেলে রাখে লাশ সমেত গাড়ি। কোন কোন সূত্রমতে জামিলকে ভয় দেখানো হয়েছিল গুলি করা হবে বলে। জামিল পরোয়া করেননি, দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, চালাও গুলি।

এ বর্ননার সাথে সামান্য কিছু অমিল পাওয়া যায় জামিলের মৃতদেহ চাক্ষুস অবলোকনকারী ততকালীন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ষ্টেশন কমান্ডার লেঃকঃ হামিদের বর্ননায়। হামিদের বর্ননামতে জামিলের কপালেই কেবল একটি মাত্র গুলির চিহ্ন ছিল। ষ্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে যেটার সম্ভাবনা অত্যন্ত বিরল। ওনার শোনা মতে হত্যাকারী অফিসার সম্ভবর মেজর নুর। অবশ্য ওনার কাছে ১৫ই আগষ্টের পুরো বর্ননা দিয়েছিল বজলুল হুদা। তারমতে জামিলের হত্যাকারী নুর বা কোন অফিসার নয়, সাধারন সৈনিকরা। তাকে ৩২নং এর দিকে এগুতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি এগুতে চাইছিলেন এবং সৈনিকদের গালাগালি করছিলেন।

আরো দুজন সিনিয়র অফিসার সেদিন ভাগ্যক্রমে প্রানে বেঁচে যান। খুনিরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনে লেকের পাড়ে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে রাখে ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হক এবং কর্নেল শরিফ আজিজকে। খুনের নেশায় উন্মাদ সৈন্যরা তাদের মেরে ফেলতে ফারুকের অনুমতি চেয়েছিল। ফারুক বদান্যতা দেখিয়ে আর কোন হত্যাকান্ডের প্রয়োযন নেই বলে তাদের ছেড়ে দিতে বলে। তারা ঠিক কি পরিস্থিতিতে ৩২ নং এ গেছিলেন তা অবশ্য জানা যায় না।

এদিকে জামিলের বাড়িতে উদ্বিগ্ন তার পরিবার। তিনি বেরিয়ে যাবার পর তারা জানতে পেরেছেন যে বঙ্গবন্ধু আর নেই, রেডিওতে শুনতে পেয়েছেন ডালিমের সদম্ভ ঘোষনা। উদ্বেগ আর ও বেড়েছে। নানান যায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, কোন খবর পাচ্ছেন না। বেলা ১১টার দিকে ড্রাইভার আইনুদ্দিন উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় বাসায় এলো। সে তেমন কোন কথা বলতে পারল না, শুধু বিড়বিড় করে বলছিল, আমি স্যারকে যেতে বার বার মানা করেছিলাম, উনি আমার কথা শোনেন নাই। এইটুকু বলেই সে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

অবশেষে বেলা দুটার দিকে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর টেলিফোন এলো। পদমর্যাদায় শফিউল্লাহ বড় হলেও সিনিয়রিটির হিসেবে জামিল তার সিনিয়র। পাকিস্তান ফেরত বলে জামিলের প্রমোশন অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে হচ্ছে। শফিউল্লাহও ফোনে দূঃসংবাদ পুরো দিতে পারেননি। কেবল; ভাবী জামিল ভাই...জামিল ভাই করে আমতা আমতা করছিলেন। তবে মিসেস জামিল এতেই বুঝে যান যে অবশেষে সেই ভয়াল আশংকাই সত্যে পরিনত হয়েছে। ফোনের রিসিভার হাতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এর কিছুক্ষন পর সেনাবাহিনীর এক অফিসার এসে তাদের এ বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ নয় বলে সরে যেতে বলে। তারা আশ্রয় নেন লালমাটিয়ায় জামিলের এক ভাই এর বাসায়। হতভম্ব সন্তানরা তখনো বিশ্বাস করতে পারেনি যে তাদের বাবা আর নেই।

এরপর খালেদ মোশারফ আবারো ফোন করে জামিলের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন। শুরু হল খুনীদের কব্জায় থাকা জামিলের লাশ উদ্ধার নিয়ে এক কুৎসিত নাটক। খালেদ লাশ উদ্ধারে হত্যাকারী গ্রুপের সাথে মধ্যস্থতায় লিপ্তে হলেন। হত্যাকারীরা লাশ ফেরত দিতে রাজী হল। জামিলের ভাই ৩২ নং এ গিয়ে হত্যাকারী সৈন্যদের কবল থেকে তাদেরই কড়া পাহারায় লাশ গ্রহন করে খালেদ মোশারফের ক্যান্টনমেন্টের বাসায় রাত ১১টার দিকে নিয়ে আসেন। সে বাসার গ্যারেজে ঠাই হয় জামিলের মৃতদেহের।

অনেক দেন দরবারের পর মুখ দেখানো যাবে না এই শর্তে খুনী দল রাজী হয় জামিলের পরিবারকে মৃতদেহ শেষবারের মত দেখতে দিতে। জামিলের মৃতদেহ গাড়ির পেছনের সিটে রাখা ছিল, পুরো যায়গা হয়নি বলে পা জোড়া বেরিয়ে ছিল জানালা দিয়ে। অত্যন্ত ফর্সা ছিলেন তিনি, তার স্ত্রী স্বামীর পা জোড়া দেখেই চিনতে পারেন যে উনি জামিল ছাড়া আর কেউ নন।

অনেক কাকুতি মিনতির পর কান্নাকাটি করা যাবে না বা কোন কথা বলা যাবে না এই শর্তে জামিলের মুখ এক নজর দেখার অনুমতি মেলে। ১২ বছর বয়সী বড় মেয়ে কংকা বাবার মৃত মুখ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, সাথে সাথে কড়া ধমকের সাথে বন্দুক উচিয়ে তাকে বাড়ির ভেতর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারফিউ এর মধ্যে জামিলের কোন যথাযথ ধর্মীয় মতে শেষকৃত্য হয়নি। খালেদের বাড়িতেই কোনমতে কাজ সারা হয়েছিল। কাফনের কাপড়ের যায়গায় তার কপালে জোটে আমেরিকা থেকে ওনার শ্যালিকার পাঠানো একটি সুদৃশ্য সাদা চাদর। ক্যান্টনমেন্ট গোরস্থানে ১৬ই আগষ্ট দিবাগত রাত ১টায় তাড়াহুড়ো করে চির শয়নে শায়িত করা হয় এই নির্ভিক নিঃস্বার্থ মানুষটিকে, স্বাধীন বাংলায় আত্মত্যাগের এমন বিরল কাহিনী জানল কেবল পরিবারের সদস্যরা।

জামিল উদ্দিন আহমেদের জন্ম গোপালগঞ্জে, ১ ফেব্র"য়ারি ১৯৩৩ সাল। ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সচিবালয়ে যোগ দেন এবং বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উনি পাক আর্মিতে আইএসআই এর সিনিয়র অফিসার ছিলেন বলে তাকে পাকিস্তান সরকার ভাল পদে তাদের দেশেই থেকে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল, দেশ সেবার অকৃত্রিম টানে জামিল সে লোভনীয় প্রস্তান প্রত্যাখান করেন।

ওনার মৃত্যুর ৪০ দিন পর বেগম জামিলের চতূর্থ সন্তান সম্ভাবনা ধরা পড়ে যে অনাগত সন্তানের সংবাদ জামিল জেনে যেতে পারেননি। শুরু হয় চার নাবালিকা সন্তানসহ বেগম জামিলের কঠিন জীবন সংগ্রাম। জিয়া সেনাপ্রধান হবার পর মিসেস জামিলকে একটি পত্র পাঠিয়ে জামিলকে শহীদ বলে অভিহিত করেন। যদিও জামিল হত্যার কোন রকম তদন্ত বিচার এসব কিছুই করেননি। জিয়া পরিবারের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পূর্ব পরিচয়ও ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জিয়ার রহস্যজনক ভূমিকার কারনে মিসেস জামিল সবসময়ই জিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। জিয়ার কাছে তিনি যেতে চাননি। তবে তার মা তাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জিয়ার বাসায় নিয়ে গেছিলেন কিছু সাহায্য সহযোগিতা যদি সে দূঃসময়ে পাওয়া যায় এই আশায়। বেগম জিয়া তার সাথে সৌজন্য মূলক আচরন করলেও জিয়ার ব্যাবহার ছিল খুবই রূঢ়। পরবর্তিকালে জিয়া এবং অন্যান্য সরকার তাদের ওপর বহুভাবে নিপীড়ন চালান বলে মিসেস জামিল অভিযোগ করেন। জামিলের ভাই এর বাসাতেই তাদের কাটাতে হয়েছে পরবর্তি ৯ মাস। বহু দেনদরবারের পর মোহাম্মদপুরে মাসিক দেড়শো টাকা ভাড়ায় (পরিত্যাক্ত সম্পত্তি) সরকার থেকে একটি বাসা ভাড়া পান। তাও ’৮০ সালে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তিনি নিজে শুরু করেন ব্যাবসা, চার সন্তানকেই মানুষ করেন ।বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে এগিয়ে আসা একমাত্র শহীদের স্মৃতির গর্বকেই সান্তনা হিসেবে মেনে নিয়ে সয়ে যান অবহেলা আর নানান অত্যাচার নিপীড়ন।

জামিলের মৃত্যুর পর এই অসহায় পরিবারটিকে সুইডিশ সরকার তাদের দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। মিসেস জামিল স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় দেশ ছেড়ে সেখানকার নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় নেননি, বেছে নিয়েছেন সংগ্রাম মুখর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। অবশেষে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় আসলে তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্যা নির্বাচিত হন। অবশেষে গত বছর সরকার জামিলকে মরনোত্তর পদোন্নতি দিয়ে ব্রিগেডিয়ার পদবী ও বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশে নানান রূপে অসংখ্য চাটুকার দেখা গেলেও জামিলের মত নিঃস্বার্থ, নির্ভীক, ন্যায়পরায়ন, বিশ্বস্ত মানুষ খুব বেশী দেখা যায়নি। অন্য কোন সভ্য দেশ হলে হয়তবা জামিলের আদর্শ স্কুলে পড়ানো হত, আমাদের দেশে তিনি থেকে গেছেন পর্দার আড়ালে। জামিল চিরদিন এক বিরল উদাহরন হয়ে আমাদের ইতিহাসে থাকবেন এই কামনাই করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৩
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×