somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৌরভ

১৭ ই মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকাল বেলাটা ঝড়ের বেগে কাটে তানিয়ার। বুয়া সমস্যা। ফলে ব্রেকফাস্ট আর রুবেলকেও স্কুলের জন্য তৈরি একই সাথে করতে হয়। রুবেল তানিয়ার ছেলে। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ছোট থাকতে রুবেল এতো সমস্যা করত না। তানিয়া নিজ হাতেই কাপড় পড়িয়ে দিত। এখন রুবেল রাজী হয় না। কাপড় পড়াতে গেলেই বলে ‘আমি এখন বড় হয়ে গেছি’। তাই ওকে ঘুম থেকে ওঠানো পর্যন্ত তানিয়ার এক্তিয়ার। এরপরের অংশ রুবেল নিজে করবে। আর সেখানেই সচরাচর বিপত্তিটা হয়। মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই আবার ঘুম দেয় রুবেল।
ব্যাপারটা তানিয়ারও অজানা না। তাই রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝেই হাঁক দেয়, ‘রুবেল, আবার ঘুমিও না।’
খুব একটা কাজে দেয় না। কিছুক্ষণ পরে তাই আবার তানিয়ে রুবেলের ঘরে আসে। মায়ের পায়ের আওয়াজ এগিয়ে আসতে শুনে রুবেল বিছানায় উঠে বসে। ‘আমি উঠে গেছি।’
— উঠে গেছি না, সোজা বাথরুমে ঢোকো।
তানিয়ার স্বামী সোহেল সাধারন্তঃ মা ছেলের এই বচসায় নাক গলায় না। সোহেল যখন অফিসের জন্য তৈরি হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে, ততোক্ষণে সাধারনতঃ তানিয়ার ব্রেকফাস্ট তৈরি কমপ্লিট হয়ে যায়। তানিয়া টেবিলে বসে রুবেলের উদ্দেশ্যে আরেক দফা গলা ছাড়ে
— ব্যাগ গুছিয়েছো?
উত্তর শোনা গেলে ভাল, আর নয়তো তানিয়া ডাইনিং টেবিল ছেড়ে আবার ওঠে। রুবেলের রুমে ঢুকে দেখে রুবেল তখন রুটিন দেখে দেখে বই ঢোকাচ্ছে।
— কতদিন বলেছি, রাতে ব্যাগ গুছিয়ে রাখবে। যলদি আস, বাবার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
রুবেলের ব্যাগ গুছানো হয়ে গেলে মায়ের পেছন পেছন এসে ডাইনিং টেবিলে বসে। বাবা ছেলের টিপিক্যাল কিছু আলাপ হয়।
— হাই ইয়াং ম্যান।
— হাই
— হাও ইজ এভ্রিথিং গোয়িং?
— ফাইন।
সোহেলের ব্রেকফাস্ট ততোক্ষণে শেষ হয়ে যায়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকা খোলে। রুবেল তখন পাউরুটির স্লাইস মুখে দেয়।
— হোমওয়ার্ক সব করেছো?
— হু।
— তোমার মিস সেদিন নালিশ দিচ্ছিলেন।
— একদিন শুধু হোমওয়ার্ক করতে ভুলে গেছিলাম।
— ইংলিশ গ্রামারে নাকি অনেকগুলো ভুল করেছো?
সোহেল পত্রিকার দিকে তাকিয়েই নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে
— এই কথাগুলো এখন কেন?
তানিয়া আড়চোখে সোহেলের দিকে তাকায়। কথাটা ভুল বলেনি। সন্ধ্যের পরে তার উচিত ছিল একবার রুবেলের হোমওয়ার্ক আর ক্লাস খাতা গুলো চেক করা। আসলে অফিস থেকে ফিরে সন্ধায় এতোটাই টায়ার্ড লাগে যে তখন আর কিছুই করতে মন চায় না। ইদানিং আবার বেশ কিছু সিরিয়াল বেশ ইক্সাইটিং অবস্থায় আছে। সেগুলো দেখতে গিয়ে গত কয়েকদিন রুবেলের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়নি।
তানিয়া রুবেলের দিকে তাকায়। রুবেলের শেষ। একবার মায়ের দিকে আর একবার দুধের গ্লাসের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে আশা, মা বলবেন, ‘ঠিক আছে, পুরোটা না পার, অল্প একটু খাও।’
না, তেমন কোন বক্তব্য এলো না। বেশ বেজার মনে ধীরে ধীরে দুধের গ্লাসটা হাতে তুলে নিল। তানিয়া জানে, সে এখান থেকে সরলেই রুবেল কিছু একটা চালাকী করবে। তাই সে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে। রুবেল বুঝতে পারে, পুরোটাই খেতে হবে। গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়ে আসে। পুরো দুধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তানিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহেল একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। এরপরে রুবেলকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়
— আর ইউ ডান ডিয়ার?
— ইয়া।
তানিয়া একটু পরে বেরোয়। তানিয়া একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে আছে। অফিস দশটা থেকে। এছাড়াও অফিস কাছেই। তাই সাড়ে নটা নাগাদ বেরোলেই চলে। সোহেল আর রুবেলকে বিদায় করে রান্নাঘরের আরও কিছু টুকটাক কাজ সেরে একটা ঝটপট শাওয়ার নিয়ে ফেলে।
আজকের দিনটাও প্রতিদিনের মতই চলছিল। কমপ্লিট পরিহিত সোহেল দরজার পাশে রাখা কি স্ট্যান্ড থেকে গারীর চাবিটা তুলে নেয়। স্কুল ব্যাগ পিঠে নিয়ে পেছন পেছন রুবেলও এগিয়ে যায়। রুবেলকে উদ্দেশ্য করে তানিয়া তখন শেষ মুহুর্তের উপদেশগুলো আওড়াচ্ছে।
— ওয়াটার পটটা ঠিকমত ব্যাগে ঢোকাবা। এর আগে দুটো হারিয়েছো।
দরজার পাশে রাখা ছোট টুলটায় বসে সোহেল তখন জুতো পড়ছে। রুবেলের জন্যো একটা টুল রাখা আছে। কিছু রুবেল সেটায় বসে না। অপেক্ষা করে আছে সোহেলের কখন শেষ হবে।
সোহেলের শেষ হলে রুবেল সেখানে বসে। তানিয়ে তাকিয়ে আছে রুবেলের দিকে। জুতোর ফিতে বাধতে একটু দেরী হলেই সে নিজে বেঁধে দিবে।
ব্যাপারটাইয় রুবেল ইদানিং বেশ অপমান বোধ করে। সে বড় হয়ে গেছে এটা কেন যে মা মানতে পারছে না, সে বোঝে না। নিপুন হাতে সে জুতোর ফিতা বাঁধে। সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তানিয়া। ভাবে দেখতে দেখতে রুবেলটা বড় হয়ে গেল। এই সেদিনও উল্টো করে স্যান্ডেল পড়তো।
— কমপ্লিট ইয়াং ম্যান?
সোহেলের প্রশ্নের উত্তরে আড় চোখে সোহেলের দিকে তাকায় রুবেল। এরপরে আচমকা এমন একটা কথা বলে যার জন্য সোহেল কিংবা তানিয়া কেউই প্রস্তুত ছিল না। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে রুবেল হঠাত জানতে চায়

— আচ্ছা বাবা, হোয়াট’স গে ?


— চেহারার একি অবস্থা তোমার?
— কই না তো?
— কিছু হয়েছে?
তানিয়া একবার ভাবে, লিপি আপাকে কিছু বলবে কি না। লিপি আপা তানিয়ার পাশের ডেস্কেই বসেন। তানিয়ার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় হবে। একটু গপ্পি টাইপ। একটা কোন টপিক পেলে উনার আলাপ আর থামতে চায় না। মানুষ খারাপ না, তবে এতো বকবক করে যে তানিয়ার মাঝে মাঝে বিরক্ত লেগে যায়। তাই সে পারতপক্ষে উনাকে এড়িয়েই চলে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত ব্যাপারে উনার সাথে একেবারেই কথা বলে না। এদিকে বিশ্বাসযোগ্য কিছু একটা না বললে উনি ঠিক মাইন্ড করবেন।
কি বলে পাশ কাটাবে ভাবছিল এমন সময় ম্যানেজার জাহাঙ্গীর সাহেব সামনে এসে দাঁড়ালেন। এভাবে ঘোরাফেরা করাটা জাহাঙ্গীর সাহেবের একটা ইউজুয়াল রুটিন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে তিনি একটা চক্কর দেন। সবার ধারণা এটা তিনি করেন সবাই এসেছে কি না, কাজকর্ম ঠিকমত চলছে কি না— এসব দেখতে তিনি একাজটা করেন। সবার দিকে একনজর বুলিয়ে তিনি নিজের রুমে ঢুকে পড়েন। আজকে তানিয়ার ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন
— এনি প্রব্লেম?
— নো স্যার।
— আপনার চেহারা কিন্তু তা বলছে না। ইউ র লুকিং ডিস্ট্রেসড।
তানিয়া এক মুহুর্ত ভাবে। এরপরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে একটা হাসি দেয়। এরপরে অপরাধীর মত বলে
— আসলে স্যার…
— আপনি বরং আজকে লিভ নিন।
চোখে মুখে একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকায় তানিয়া।
— গো হোম অ্যান্ড টেক রেস্ট।
জাহাঙ্গীর সাহেবের বলায় কিছু একটা ছিল, তানিয়াও ব্যাপারটা মেনে নিল। ‘ও কে স্যার’ বলে সম্মতি জানাল। কথাটা বলে উনার আর দাঁড়ালেন না।
জাহাঙ্গীর সাহেব চলে গেলে তানিয়া নিজের জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিল। তানিয়ার দিকে লিপি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। হয়তো আশা করছিল, তানিয়া নিজে থেকে কিছু বলবে। বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিপি নিজের কাজে মন দিল। কাজ করতে করতেই বলল
— আমাকে না বল, পরিচিত কাউকে বল। প্রবলেম শেয়ার করলে মন হালকা হয়।
তানিয়া বুঝল লিপি আপা রাগ করেছেন। একবার ভাবল সব খুলে বলেন। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টাল। ঠিক করল, সবটা না, কিছুটা বলবে।
— তেমন কিছু না আপা, আজকে সকালে ছেলেটাকে মেরেছি।
লিপি ভ্রু কুঁচকে তানিয়ার দিকে তাকাল। কথাটা বিশ্বাস করবে কি না ভাবছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তানিয়া নিজে থেকেই বলল
— এতো আজেবাজে কথা শিখছে না ছেলেটা।
মনে হল কথাটা এবার বিশ্বাস করল লিপি। তবে তাঁর চেহারা দেখে মনে বিশ্বাসের চেয়ে পুরো কাহিনী শুনতে তিনি বেশি আগ্রহী। উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করল
— কি বলেছে? বা*?
এনিয়ে আলাপ করবার একেবারেই ইচ্ছে করছিল না তানিয়ার। আবার কিছু একটা না বলে এখান থেকে যাওয়াটাও বাজে দেখায়। নতুন কোন বাজে কথা মাথায় আসছেও না। ঠিক করল উত্তর দেবে না। সময় নেই এমন ভাব করে বেরিয়ে যাবে।
ব্যাগটা ঘাড়ে রাখতে রাখতে লিপির দিকে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলল
— আসি আপা।
— বললে না, কি বলেছে?
বুঝল, কিছু একটা না বললে লিপি আপা সত্যিই অপমানিত ফিল করবেন। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তানিয়া সত্যি কথাটাই বলল
— জানতে চাইছিল হোয়াট’স গে?



তানিয়া ঠিক করে রেখেছিল বাসায় ফিরেই সোহেলকে ফোন করবে, কিন্তু সে সুযোগ পেল না। রিকশায় থাকতেই সোহেলের ফোন আসল।
— ঠিক আছ?
— হ্যাঁ
— ছুটি নেবে নাকি আজকে?
— নিয়ে ফেলেছি।
— গুড। বাসায় গিয়ে একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দেবে।
— আমার জন্য ভেবো না, আমি ঠিক আছি।
— না, তুমি ঠিক নেই। তর্ক কর না, যা বলছি শোন। রাখছি।
মনটা হঠাৎ করে ভাল হয়ে গেল। সোহেলের এই গুণটা ওকে সবচেয়ে ভাল লাগে। ঠিক কষ্টের মুহুর্তে পাশে দাঁড়াবে। একবার ভাবে অফিসে ফিরে যাবে কি না। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। ফিরে গেলেই লিপি আপাকে ফেস করতে হবে। উনার চেহারা দেখে মনে হয়ছিল, তানিয়ার এক্সকিউনটা উনি সম্ভবতঃ পুরোটা বিশ্বাস করেননি। সেটা বলতে যাচ্ছিলেনও। কিন্তু তানিয়া সে সুযোগ না দিয়ে, ‘আসি আপা’ বলে বের হয়ে চলে আসেন।
লিপি আপাকে দোষ দেয়া যায় না। তানিয়ে নিজে হলেও এমন কথা বিশ্বাস করত না। কোন মা ছেলেকে চড় থাপ্পড় না মারে? সেজন্য কেউ এমন বিদ্ধস্ত হয়?
আসলে এভাবে যে ওর অতীত আবার তানিয়ার জীবনে ফিরে আসবে, তা ভাবতে পারেনি তানিয়া। ব্যাপারটার জন্য তৈরিও ছিল না। কেবল সোহেল ব্যাপারটা ধরতে পারে। তাই দ্রুত সে পরিস্থিতি সামলে নেয়। প্রথম চড় মারার সাথে সাথেই সে তানিয়ার হাত চেপে ধরে।
— ডোন্ট। আমি হ্যান্ডল করছি।
এই বলে সে রুবেলকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রুবেল বেরিয়ে যাওয়ার পরে সে বিদ্ধস্ত হয়ে সোফায় বসে পড়ে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। একবার ভেবেছিল আজকে ছুটি নেবে, পরে আবার ভাবে, বাসায় থাকলে বরং আরও খারাপ লাগবে। অফিসে কাজের ভিড়ে হয়তো মনটা হালকা হবে। হয়নি। একেবারেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। ভাগ্যিস জাহাঙ্গীর সাহেব নিজে থেকে ছুটি দিলেন।
এমন সময় সোহেলের ফোন আসল।
— পৌঁছেছো?
— এইমাত্র।
— ওকে, এখন ঔষধ খাও।
— খাব।
— খাব না, এখনই খাও। আমি লাইনে আছি।
সোহেল কথা শুনবে না। ধীরে ধীরে তানিয়া বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
— রুবেল কি কাঁদছিল?
— না।
— আসলে…
— আলমারীতে আমার ড্রয়ারে আছে।
স্মিত হাসি দিয়ে তানিয়া আলমারী খুলল। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একটা ঘুমের ঔষধ বের করল।
— বের করেছি, খেয়ে নেব।
— ডাইনিং রুমে যাও।
— খাচ্ছি বাবা।
— শোন, অফিস থেকে দিন তিনেকের ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে?
— কেন?
— ইয়েস? অর নো?
— পারবো, আই থিঙ্ক। তারপরও, বসকে ফোন করে জানতে হবে।
— গুড। এখনই কর। আমি মিনিট পনের পরে ফোন করছি।
তানিয়া ঔষধটা খেল। ও জানে, সোহেল ওর প্ল্যান সম্পর্কে আর কিছু বলবে না। মনে হয় কোথাও ঘুরতে যাবে। মন্দ হয় না। তারপরও ট্রাই করল
— কোথায় যাবে?
— ঔষধ খেয়েছো?
— হ্যাঁ বাবা। আচ্ছা শোন, রুবেলকে কি আজকে টিফিন টাইমে বাসায় নিয়ে আসব?
— না। হি ইজ ওকে।
— আসলে আমার কি যে হল…
— এনিয়ে রাতে কথা হবে। বসকে এখনই ফোন কর।
সোহেল ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দিল। ফোনটা দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত ভাললাগা অনুভব করল তানিয়া। এমন একটা স্বামী পাওয়ার জন্য নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে এখন। স্পেশালি ঐ ঘটনার পরে সে আশাও করেনি এমন কেউ ওর জীবনে আসবে।
রুবেলের জন্য মনটা কেমন করছে এখন। ছেলেটার হতভম্ব চেহারা এখন চোখের সামনে ভাসছে। হয়তো ক্লাসে কারো কাছে শুনেছে কথাটা। কিংবা টিভিতে দেখেছে। আজকাল তো এমন সম্পর্ক নিয়ে হর হামেশা সিনেমা হচ্ছে। আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার কারণে এই ছেলেটা একেবারেই বাংলা চ্যানেল দেখতে চায় না।
ওর জন্য কি কিছু রাঁধবে? ওহ, বসকে ফোন করতে হবে।



সুন্দর একটা ঘুম দিয়ে উঠে সত্যিই তানিয়ার ফ্রেস লাগছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফ্রিজ থেকে চিংড়ী মাছটা বের করে রেখেছিল। চিংড়ী মাছ রুবেলের প্রিয়। ডাইনিং টেবিলে ঐ খাবারটা দেখলেই ওর মুখ খুশিতে ভরে যায়। চিংড়ী রাঁধতে রাঁধতে সে মায়ের বাসায় ফোন করল।
— রুবেল ঠিক আছে?
— হ্যাঁ
— কাঁদছিল?
— কাঁদবে কেন?
তানিয়া এক মুহুর্ত ভাবে। চড় মাড়বার কথাটা বলবে কি না। পরে সিদ্ধান্ত নেয়, বলবে না।
— আমরা দিন তিনেকের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি।
— কোথায়?
— জানি না। সোহেলের প্ল্যান।
— বাচ্চার স্কুল?
এটা সেটা বলে মাকে বুঝ দিল তানিয়া। রুবেলের এই দুপুর সময়টা মায়ের কাছেই কাটে। তানিয়ার ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় বলে, স্কুল থেকে রুবেল প্রতিদিন তানিয়ার মায়ের ওখানে চলে যায়। সোহেল কিংবা তানিয়া অফিস থেকে আসবার পথে ওকে নিয়ে আসে।
তানিয়া একবার ভেবেছিল রুবেলকে আজকে নিয়ে আসবে, সোহেলকে বলেওছিল ব্যাপারটা। ও অ্যালাউ করেনি।
— নো। আমি অফিস থেকে আসবার সময় নিয়ে আসব। তুমি মোবাইল সাইলেন্ট করে এখন চুপচাপ ঘুম দিবে।
ছুটি পেয়েছে কথাটা জানাতে সোহেলকে ফোন করেছিল তানিয়া। ভেবেছিল স্কুল থেকে ছেলেটাকে এনে আজকে ওর ফেভারেট কিছু খাওয়াবে। সোহেল রাজী হল না। মাঝে মাঝে সোহেলের এসব ব্যাপারকে বাড়াবাড়ি মনে হয়। আরে বাবা সকালে না হয় ও আপসেট ছিল, বাট এখন তো আর না। এখন একটু আদর করে সকালের চড়টা কম্পেনসেট করবে না?
— আর হ্যাঁ, ঐ ব্যাপার নিয়ে রুবেলের সাথে আর আলাপ করবে না।
এবার সত্যি সত্যিই বিরক্ত হল তানিয়া।
— বা রে, জানতে হবে না, কোথা থেকে শুনল?
— আমি জেনেছি।
— জেনেছো? কৈ আমাকে তো বলোনি? কোথা থেকে?
— বাসায় এসে এসব নিয়ে আলাপ করব। এখন চুপচাপ ঘুমাও।
লাইন কেটে দিল সোহেল। তানিয়ার এবার বেশ রাগ হল। সব কিছুতেই সাসপেন্স। ও, ছুটিতে কি করবে তা ই তো জানতে চাওয়া হল না। আবার ফোন করবে? মন সায় দিল না। কিছুটা অভিমান জমেছে বুকের ভেতর। সব ব্যাপারে সাসপেন্স বাড়াবাড়ি লাগে।

প্রতিদিনের চেয়ে আজ একটু আগেই ফিরল সোহেল। সাথে চাইনিজ নিয়ে এসেছে। রুবেলের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। ঘরে ঢুকেই ছেলেটা নিজের ঘরে দৌড়াল। স্কুল ব্যার রেখে এসেই ডাইনিং টেবিলে বসল।
— আম্মু, স্যুপ খাব।
সকালের ঘটনার কোন রেশ নেই। মন থেকে একটা ভার নেমে গেল। তানিয়া প্যাকেটগুলো খুলে বাটিতে ঢালতে লাগল। সোহেলও এসে ডাইনিং টেবিলে বসল
— তুমিও এখন খাবে?
— হ্যাঁ।
— নাকি পাহারা দিতে এসেছ?
— আমাকেও একটা বাটি দাও।
তানিয়া আর কথা বাড়াল না। মুখ গম্ভীর করে রুবেল আর সোহেলকে খাবার বেড়ে দিতে লাগল। এমন সময় রুবেল বলল
— জানো বাবা, সকালে যে তোমাকে বললাম না, শিহাব স্যারের কথা, উনাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে।
তানিয়া অবাক হয়ে রুবেলের দিকে তাকাল। নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করল
— শিহাব স্যারকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে? কেন?
— উনি যে গে।
তানিয়া ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। মুখ রক্তশূণ্য। সোহেল দ্রুত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে তানিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে সোহেলের হাত পড়তেই তানিয়া সোহেলকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সোহেল একবার রুবেলের দিকে একবার তানিয়ার দিকে তাকাল। ছেলেটা বুঝে উঠতে পারছে না কি এমন সে বলল। সোহেল রুবেলকে খাওয়া চালিয়ে যেতে ইশারা করল। হতভম্ব রুবেল কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে ও উঠে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল।
— কি হয়েছে মা?
তানিয়া তখনও কেঁদেই চলেছে। সোহেলে এবার তানিয়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল
— প্লিজ, কন্ট্রোল ইওরসেলফ।
তানিয়া নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। সোহেলের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অস্ফুটে শুধু জানতে চাইল
— আবার?

চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৫
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×