সাংবাদিকতার একজন অমনোযোগী ছাত্র হিসেবে যতটুকু বুঝেছি, একটা সংবাদে মূলত ছ’টা প্রশ্নের উত্তর খুঁজা হয়। এর প্রধানতমটা হলো ‘কী হচ্ছে বা ঘটছে’। এখানে ছাত্র সহপাঠীর দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। দুনিয়ার সব জায়গাতেই মূল নিউজটা এমন শিরোনামে হবে বা এর কাছাকাছি হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এবেলা আমাদের দেশীয় মিডিয়ার অবস্থানটা ভুল কিছু না।
‘প্রসঙ্গ’ বলে রাখা ভালো। গত ক’দিন ধরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে ছেলে সহপাঠীর দাবিতে মেয়েরা যে আন্দোলন করছে সেখানে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নতুন আর একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, মিডিয়া মূল ঘটনাকে আড়াল করে সুড়সুড়িমূলক শিরোনাম করছে। আমি কথা বলছি সে প্রসঙ্গেই।
রিপিট করছি, সংবাদে মূল যে প্রশ্ন তা হলো ‘ঘটনাটা কী’ বা ‘কী হচ্ছে বা ঘটছে’। উত্তর: গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে মেয়েদের আন্দোলন হচ্ছে। দ্বিতীয় মেজর প্রশ্ন হচ্ছে ‘কেন হচ্ছে বা কী কারণে হচ্ছে’ উত্তর: ছেলে সহপাঠী ভর্তির দাবিতে।
বাহ্যিকভাবে দেখলে মিডিয়া এখানে একদমই ঠিক আছে। তবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়ার সমালোচনা যারা করছে তারা বলছে, ‘ছাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বতন্ত্র ইন্সটিটিউট হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভূক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইনে ছাত্র না থাকলে কোন প্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে অধিভূক্ত করার বিধান নেই। তাই ছাত্রীরা এখন সহশিক্ষা চালুর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। ঢাবি ভিসিকে সে দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে।‘ ফেসবুকে যারা এ দাবি করছে তাদের দাবি এখনো প্রমাণিত নয়। আর প্রমাণিত হলেও মিডিয়া যে শিরোনাম করেছে তা ভুল হয়ে যায় না। বড়জোর মিডিয়া কেন আন্দোলনের নেপথ্যের কাহিনী লেখেনি সে জন্য তার দুর্বলতা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।
এখানে বলে রাখা ভালো, প্রতিটা সংবাদেরই একটা গুরুত্ব থাকে মিডিয়া হাউজগুলোতে। ভেতরের কারণ খুঁজা বা না খুঁজাটা অনেকটা তার উপর নির্ভর করে। ছাত্রীদের এ আন্দোলন মিডিয়া ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তারা যদি সম্পূর্ণ একটা নিউজ করত তাহলে দায়িত্বশীলতা ও দায়বদ্ধতা ভালোভাবে রক্ষা হত। কিন্তু করেনি বলে বা করতে পারেনি বলে মিডিয়াকে আক্রমণ করার কোন সুযোগ এখানে নেই। কারণ সংবাদ প্রকাশের যে নৈর্ব্যক্তিক জায়গা সেটা এখানে ঠিক আছে।
আর, এ ঘটনায় মিডিয়াগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছে। তাদের কেউই আন্দোলনের ভেতরের কারণ ব্যাখা করেনি। ছাত্রীদের পক্ষ থেকেও সংবাদ সম্মেলন করে কারণ তুলে ধরা হয়নি বা মিডিয়াকে জানানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। তুলে ধরার পর মিডিয়া প্রকাশ না করলে আমরা মিডিয়ার নিন্দা করতে পারতাম। নানা সময়ে তা করিও। তারা নিজে থেকে কেন ছাত্রীদের সাথে কথা বলে কারণ জানার চেষ্টা করল না, নাকি জেনেও লিখল না সেটা তর্ক সাপেক্ষ। মীমাংসার আগ পর্যন্ত বিষয়টাকে মিডিয়ার দুর্বলতা হিসেবে দেখতে হবে। সুতরাং এখানে ছাত্রীদের আন্দোলনের নেপথ্যের কারণ উঠে না আসায় মিডিয়ার যেমন দায়ভার রয়েছে তেমনি ছাত্রীদেরও রয়েছে, এ দায় এড়াতে পারেন না কর্তৃপক্ষও। আর একটা কথা, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, মিডিয়ার নানা দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধা রয়েছে। সেটা সংবাদের মুন্সিয়ানা ও কারিগরী দিক উভয় ক্ষেত্রেই।
কথা হচ্ছে, এ ঘটনায় প্রাথমিক যে নিউজ, তা উঠে এসেছে। মানে ‘ছাত্রী আন্দোলন, সহশিক্ষার দাবিতে।‘ তবে নিউজে মূল কারণ না থাকায় আমরা তাকে বলতে পারি তা অসম্পূর্ণভাবে এসেছে বা বিস্তারিত আসেনি। এখানে মিডিয়া উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ কাজটা করেছে এমনটা দাবি করা অবিবেচনাপ্রসূত আমার কাছে। এটা আসলে সাংবাদিকতার মানের প্রশ্নও। মান নিয়ে পাঠকের রুচি কাজ করে বলেই পত্রিকা ভেদে কম-বেশি বিক্রী হয়। মূল ধারার জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোর কাছে আমরা নেপথ্যের কারণসহই সংবাদ আশা করি।
শেষ করছি,
সংবাদে ‘শিরোনাম’ হচ্ছে একটা ক্লু, নিউজের ইন্ট্রোতে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। চলমান এই ঘটনা নিয়ে মিডিয়া যে শিরোনাম (ছাত্র ভর্তির দাবিতে কলেজে ছাত্রীদের তালা) করেছে তা পড়ে পাঠক ধারণা নিতে পারছে ‘কোথায়, কী হচ্ছে’। মিডিয়ার প্রথম ও প্রধান কাজ এটাই। তবে পুরোটা নিউজ পড়েও নেপথ্যের কাহিনী, মানে আন্দোলনের যে মূল দাবি (ইন্সটিটিউট হিসেবে ঢাবির অধিভূক্ত হওয়া) তা জানতে পারবে না পাঠক। এটা খুবই দু:খজনক এবং মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা আশা করব মিডিয়া একই ভুল আগামিতে করবে না। মিডিয়া যদি পুরো ঘটনা জেনে ‘স্বীকৃতি না পেয়ে সহশিক্ষার দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রীরা’ এমন শিরোনামে নিউজটি করতে পারত তবে মিডিয়ার বিশ্বাসোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা পাঠকের কাছে বাড়ত এতে কোন সন্দেহ নেই।
এ ঘটনায় যুগান্তরে প্রকাশিত নিউজের লিংক,
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:১৮