এক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম বাঙালি ও আরবদের মধ্যে মিল কিসে! তার উত্তর মতে, 'এরাবিয়ান ও বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে মিলের জায়গাটা হলো এই দু’দলই জাতি হিসেবে অসভ্য।' পরনিন্দাকারী, পেছন থেকে বাঁশ দেওয়ায় ওস্তাদ আর পরশ্রীকাতর। সবচেয়ে বড় অমিল অর্থে। এরাবিয়ানরা তেল বেচা ধনী ও অনেকাংশে কপাট মূর্খ আর বাঙালিরা ঠিক গভীরতা না জানা অতল ফকির। এরা বাংলাদেশ নামক ডোবায় বসে এই সত্যটা জানার সুযোগটাই পায় না, পুরো দুনিয়া থেকে ওরা ঠিক কতটা পিছিয়ে। ও, এই দুই জাতির মধ্যে আর একটা মিলের জায়গা আছে। সেটা হলো খাবারে।
বাঙালিরা সসি, মসল্লাবাজিতে ভরা ভোজে মজতে পছন্দ করে, এরাবিয়ানরাও। ইস্তাম্বুলে বেশ ক’বছর হয়ে যাচ্ছে আমার। সিরিয়া যুদ্ধ, ইয়েমেন যুদ্ধসহ নানা কারণে তুরস্ক এখন আরবদের দ্বিতীয় ঘর। এর বাইরে ভ্রমণের জন্য ধনী আরবরা বেছে নিচ্ছেন তুরস্ককে। যেমন সৌদিয়ান, কাতারী, কুয়েতিরা ইস্তাম্বুলে ভীড় করছে ছুটি কাটাতে। একসময় আরব ধনকুবেররা পশ্চিমা ব্যাংকে টাকা রাখত, এখন এদের বিশাল একটি অংশ তুরস্কে রাখে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, পশ্চিমারা সুযোগ পেলেই আরবদের টাকা বাজেয়াপ্ত করে খেয়ে ফেলে। ফলে ভীত আরবরা এখন পশ্চিমা বিমুখ। আর ফিলিস্তীনের নির্যাতিত, নিষ্পেতিত আরবদের একটা বিশাল অংশ বহু যুগ ধরেই দেশটিতে আশ্রিত। এর বাইরে রাশিয়ার তাতার মুসলিম, গ্রিক মুসলিম, চীনের উইঘুর, ইউক্রেনের তুর্কিশ মুসলিমসহ বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের একটি অংশ তুরস্কে শরণার্থী হিসেবে দীর্ঘ বছর ধরে আশ্রিত রয়েছে।
কুত্থেকে কই চলে যাচ্ছি বুঝতেছিনা। উপরের বকবকানি দেখে মনে হচ্ছে আমিও বাংলাদেশে রাজনীতিবীদ বনে যাওয়ার পথে। যাইহোক, ইস্তাম্বুলে গড়ে উঠেছে নানা জাতিগোষ্ঠীর হরেক রকম রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে এরাবিয়ান রেস্টুরেন্টই সবেচয়ে বেশি। এর বাইরে রয়েছে মালয়শিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, চাইনিজ, কোরিয়ান, ইন্ডিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের রেস্টুরন্টে।
এখানে আসার পর থেকেই মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টের খুঁজে বের হতাম আমি। এতদিনে মোটামুটি সব রেস্টুরেন্টই চেনা হয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশি যাওয়া হয় মালয়শিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, সিরিয়ান আর ইয়েমেনি রেস্টুরেন্টে। নামকাওয়াস্তে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থাকলেও যাই না কখনো। কারণ দাম। একটা মুরগী বিরিয়ানি নেয় বাংলাদেশের প্রায় হাজার খানেক টাকা। আর একটা বিফ বিরিয়ানি নেয় হাজার টাকার উপরে। সে হিসেবে আরব রেস্টুরেন্টগুলার দাম তুলনামূলকভাবে কম, সার্ভিসও ভালো।
বেশকিছু তার্কিশ খাবার আছে যা খেতে খুবই সুস্বাদু। বিশেষ করে তার্কিশ কাবাব। কেউ ইস্তাম্বুলে এলে প্রথমেই ঘুরতে যায় সুলতান আহমেত নামে একটি জায়গায়। দেশটির প্রধান পর্যটন এলাকা হচ্ছে এই সুলতান আহমেত। এই এলাকার একটি জাদুঘরে ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দাঁড়িসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিস সংরক্ষিত রয়েছে। একই জায়গায় দেখা যায় চার খলিফার তরবারি, নবী মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমার জামা ও তার বড় ছেলে হাসানের ব্যবহৃত জুব্বা, ইসলাম ধর্মের আরেক নবী হযরত মূসার লাঠি, হযরত দাউদের তরবারি, হযরত ইব্রাহিমের কাবা নির্মাণকালীন ব্যবহৃত সেই পাথর, যেখানে তার পদচিহ্র রয়েছে ইত্যাদি। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রথম গীর্জাটিও এখানে। ও, এই সুলতান আহমেতেই মেলে তুরস্কের বিখ্যাত খাবার সেলিম উস্তা কুফতে (কাবাব)। দাম একটু বেশি হলেও স্বাদে অনন্য সাধারণ। তুরস্কের বিখ্যাত আইসক্রিম কাভরামান মারাশ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না পর্যটকেরা। আমি গরীব হয়েও পারিনি। বেশ ক’বার কিনে খেয়ে খালি পকেট আরও খালি করেছি। তার্কিশ আরও দুটি খাবার আমার ভালো লাগে। পিদে (অনেকটা পিজ্জ্বার মতো) আর লাহমাজুন (ময়দার রুটির উপরে গরুর মাংস ছিটিয়ে তৈরি করা)। এর বাইরে দোনের খেতে চাইলে ঢুঁ মারি বেরেকেত দোনের বা কামাল পাশা দোনের রেস্টুরেন্টে।
যাক আবার ফিরে আসি ভিনদেশী খাবারে। ইস্তাম্বুল শহরের ইউসুফ পাশা-হাসেকি এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে উইঘুর-আরব রেঁস্তোরা। আমি মাঝে মধ্যে এই এলাকায় যাই, দামের কথা ভুলে গিয়ে হরেক রকম খাবার অর্ডর দিয়ে খাই। আর খানিক সময়ের জন্য হারিয়ে যাই দেশীয় স্বাদে। বাংলাদেশী খাবারের সাথে ওদের খাবারের বেশ মিল। শহরের ফাতিহ নামক এলাকার ফাতিহ সুলতান মসজিদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আরব রেঁস্তোরা। এ এলাকায় এলে দেখা যায় শত শত আরব স্বদেশী খাবার খাওয়ার জন্য ভীর করছে। এই এলাকার অদূরেই এদেরনিকাপ নামক এলাকায় দেখা মেলে মালয়শিয়ানদের। ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে মার্কেজ এফেন্দি নামক একটি এলাকায় আর আমাদের স্বাদের ইন্ডয়ান রেস্টুরেন্ট এর দেখা মেলে চেম্বেরলিতাস নামক এলাকায়। খেতে বেশ ভালো হলেও প্রায়ই সমস্যা হয় দামে। তুলনামূলক সস্তায় খাওয়ার জন্য তাই মাঝেমধ্যে যাই বার্গার কিংয়ে। কখনো কখনো ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি বা ডমিনো পিজ্জাহাটে।
লেখতে লেখতে হাঁই উঠেছে। কিন্তু এই পোস্টটা কোন উদ্দেশ্যে, কার উপকারের জন্য আপ দিচ্ছি বুঝতেছি না। তবে এতে যে কোম্পানির প্রচার ও প্রসার হচ্ছে, মানে আমি যে মাঝেমধ্যে বাইরে গিয়ে খাই সেটা জানান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো সেটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না! যাকগা, ‘জিপিএ ফাইভ এবং এ পেপেলাশশ’ পাওয়া জাতি অন্তত এটা জেনে বড় হোক, চিপ ইন্ডিয়ান বলে যে গালিটা বাংলাদেশি-পাকিস্তানি-ইন্ডিয়ানদের লক্ষ্য করে বিদেশিরা দেয় তা আসলে সর্বাংশে সত্য না। বাঙালিরাও পছন্দের জন্য পকেটের টাকা খরচ করে। আপাতত সবাইকে কর্দমাক্ত আকাশ ও মেঘে ঢাকা মাঠে ক্রিকেট উপভোগ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে আলবিদা। ভালো থাকেন, সুন্দর থাকেন। ভালোলাগা ও ভালোবাসায় পাশে থাকেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭