আসল কথায় ফিরি।
পুরো তুরস্ক দেশটাই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে। এখানেও এর ব্যতিক্রম না। পাহাড়ের বাঁকানো পথ ধরে চলতে চলতে প্রায়ই মনে হয় এই বুঝি খাদে পড়ে গেলাম। বাস এই নিচে নামছেতো, এই উপরে উঠছে। যাইহোক, গন্তব্যে পৌছানোর পর জায়গাটা পছন্দ হয় আমার। জনমানবশূন্য এ এলাকা দেখেই বোঝা যায় এটা মূলত ট্যুরিস্ট জোন। শুরুতে ভেবেছিলাম পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছোট যে রিসোর্টগুলো দেখা যায় সেগুলো বোধহয় সরকারি সম্পদ। পরে আমাদের কটেজের সিকিউরিটি গার্ড জানাল, এগুলো বড়লোকদের প্রাইভেট প্রমোদ হাউজ। বছরে ২/১ বার বউ বা গার্লফেন্ড নিয়ে তারা আসেন ছুটি কাটাতে। আর বাকি সময়টা খালি পড়ে থাকে।
সমতল ভূমি থেকে প্রায় এক হাজার মিটার উঁচুতে ছিল আমাদের কটেজ। চারপাশে পাহাড়, সে পাহাড় বরফে ঢাকা আর তার মাঝে কিছু বাড়ি আর কিছু ছোট ছোট ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলো সাধারণত গ্রীষ্মকালে ব্যবহার করা হয়। সেখানে পৌছে দেখি মোবাইলের নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট কিছুই কাজ করে না। নেই পত্রিকা পড়া বা টিভি দেখার কোন ব্যবস্থা। ফলে পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
সেদিন পৌছাতে পৌছাতে বিকেল। শরীর খুব ক্লান্ত হলেও বের হলাম বিকেল আর তার আকাশ দেখতে। তবে প্রচণ্ড শীত হওয়ায় বেশিক্ষণ বাইরে টিকতে পারলাম না। সন্ধ্যার পরপরই রুমে গেলাম ঘুমোতে। কিন্তু একি, রুমের হিটার কাজ করে না! তাপমাত্রা মাইনাস ৩০-৪০ এর মধ্যে হবে ধারণা। হিটার ঠিক হবে না জেনে খুঁজে একটা স্লিপিং ব্যাগ বের করলাম। তুর্কিশদের মাপে বানানো স্লিপিং ব্যাগটা বেশ বড়। পাশে কেউ থাকলে দু’জনে একটার মধ্যে ঢোকা যেত। আপসোস সেই সোয়ার খোঁজ আজও পেলাম না।
নেটহীন, যোগাযোগহীন দিনগুলো কেটে গেল খুব দ্রুত। যোগাযোগ বিপ্লবের এই যুগে কিছুটা সময় পুরো দুনিয়া থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার অনুভূতি অবশ্য বেশ ভালোই আমার। -৩৫ ডিগ্রীর মতো তাপমাত্রায় হিটারহীন রুমে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো ইশ, আমার হাতখানি আর দু’হাত লম্বা হলেই আকাশ ছুঁয়া যেত। আমি শুভ্র কোন রাজপুত্র হলে মেঘের ভেলারা আমাকে কোলে নিয়ে পাহাড় থেকে পাহাড় চষে বেড়াত। কত কাছে আকাশ আর পাহাড়। দু’পাহাড়ের মাঝে যেন জালরাশির দল হাসছে। মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে পাখির দল।
যেদিন ফিরব সেদিন তুষাড় ঝড় হচ্ছে। রেইনকোট বা ছাতা কোনটাই নেইনি। সুতরাং বৃষ্টিতে ভিজতে হলো। ও, আসার আগে পরিচয় হলো এক ফিলিস্তিনী প্রফেসরের সাথে। দীর্ঘ বছর লন্ডনে কাটিয়ে এখন তিনি থিতু হয়েছেন তুরস্কে। ৩০ বছর আগে ইসরাঈলের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল বেচারাকে। এরপর একদিন একমাত্র ভাই মরার খবর পান, জানাজায় যেতে পারেননি। তারপর মারা যায় বাবা, তারপর মা। কারো মুখই দেখা হয়নি শেষবারের মতো। এখন তিনি নিজে বৃদ্ধ। জানেন না মৃত্যুর আগে আর কোনদিন নিজ ভূমে ফিরতে পারেন কি না। এ প্রফেসরের জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে ভিজে আসে আমার চোখ। মনে পড়ে ৭১ এর কথা।
আহা! যারা আমাদের এনে দিয়েছিল এক টুকরো স্বাধীন ভূমি তাদের কাছে চিৎকার করে ঋণ স্বীকার করতে ইচ্ছে করে। শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে আসে মাথা। সশ্রদ্ধ সালাম নাও হে বীরের দল। হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা বিনম্র সালাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩৮