সকালে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে তূর্যের । ভার্সিতে যাওয়ার পর অভ্যাস হয়ে গেছে , সাড়ে আটটার আগে ঘুম না ভাঙ্গার । অনেক আড় মোড় ভেঙ্গে অবশেষে উঠে বসে । অনেক দিনের পুরানো ওর এই খাটটি । স্কুলজীবন, কলেজ জীবন সে এই খাটে শুয়েই কাটিয়েছে । আজ অনেকদিন পর আবার সেই পরিচিত খাটটিতে শুয়ে ঘুম যেন ছাড়ছেই না । অনেক দিনের পুরাতন বন্ধুটিকে আকড়ে ধরে রাখতে চাইছে । তবুও জোর করেই উঠে পড়ে তূর্য । দাঁত ব্রাশ করতে করতে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায় । শীতের সকাল, পুব আকাশে রক্তিম সূর্যটা তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে , তবে এখনও চারিদিকে কুয়াশা মুড়ে আছে । রাস্তার পাশে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের জন্য ছোট কলস পাতা হয়েছে । একটা কাঠবিড়ালী এসে চুকচুক করে রস খাচ্ছে । কাঠবিড়ালীটির পিঠের উপর সাদা সাদা দাগ । তূর্যকে দেখেও সে ভয় পাচ্ছে না । আপন মনে রস খেয়েই চলেছে । কাঠবিড়ালী দেখে তূর্যের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায় । রোজ রোজ দাদুর কাছে গল্প শুনতো । দাদু তূর্যকে মুখে মুখে রামায়ন, মহাভারত, রাজকুমার, রাজকুমারী, পাতালপুরের দৈত্যদের কাহিনী , ভূতের গল্প, আরো কত কি শোনাত, গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত তূর্য । রামায়নে আছে, রামচন্দ্র যখন সীতাকে উদ্ধার করার জন্য সেতু বন্ধন করেন , তখন নাকি এই কাঠবিড়ালীও রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছিল । সে জন্য নাকি কখনও কাউকে ছোট মনে করতে নেই । দাদুর প্রায় প্রতিটি গল্পে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় থাকত । তাই দাদুর দেয়া এই শিক্ষাটি আজও তূর্য ভোলে নি । তাই সেও কাউকে ছোট মনে করে না । পাশের গ্রামের ছাদেক আলী গাছী মানুষ । খেজুর গাছ কেটে রস আহরণে উস্তাদ ,গাছেও উঠতে পারে হনুমানের মত । আশেপাশের দুই তিন গ্রামের খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের দায়িত্ব তাঁর একার । এই শীত মৌসুমে তার ইনকামও ভাল । ছাদেক আলী তূর্যকে দেখে বলল, “কেমন আছ বাজান ?” “জ্বি ভাল, আপনি কেমন আছেন চাচা ?” উত্তর দেয় তূর্য ।
ছদেক বলে, “ এই আল্লায় রাখছে ভাল , তা তোমার পড়ালেহা কেমন চলছে আব্বা ?” তূর্য সংক্ষেপে বলে, “চলছে ভালই” ।
ছাদেক আলী গাছে উঠতে উঠতে বলে, “তুমি নাকি কম্পিটার না কি যেন পড়তিছো, আমি বাপু অতশত বুঝি না ।
“জ্বি কম্পিউটার সাইন্সে পড়ছি, তা রস এখন কেমন হচ্ছে ?” প্রশ্ন করে তূর্য ।
“আর রস কই বাপজান ? মানুষেরও রস কস নেই, গাছেরও রস কস নেই, আগে দিনে দুইবার হাড়ি পাল্টানো লাগত আর এহন এক হাড়িও ভরে না ।” বলে গাছ থেকে নেমে আসে ছাদেক আলী । ছাদেক ব্যস্ত
মানুষ । তাড়াতাড়ি হাড়ি থেকে রস ঢেলে ছুটে যায় অন্য গাছে । রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট পড়ে ফিরছে । এরা সবাই ক্লাস ওয়ান থেকে এইটে পড়ে । এক সময় এই রাস্তাটি কাঁচা ছিল । তূর্যরা পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত । বর্ষায় এক হাটু কাদা হত রাস্তায় আর শীতের সময় ধুলা । ওদের পাড়ার একটা মেয়ে ছিল, নাম সুনিতা । তূর্য ছিল ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র আর সুনিতা ছিল ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রী । তবুও কোন এক অজানা কারনে সুনিতাকেই তূর্যের সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত । সে বার হল কি, রাস্তায় দৌড়াতে গিয়ে একটা ইটে লেগে তূর্যের পা কেটে রক্ত বের হচ্ছিল , কেউই খেয়াল করি নি । সবাই তূর্যকে ছেড়ে আগে চলে গেছে । তখন সুনিতা লক্ষ করেছিল তূর্য পেছনে, কাছে গিয়ে দেখে পা থেকে রক্ত ঝরছে । সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে দূর্বা ঘাস মুখে নিয়ে পিসে ওর পায়ের রক্ত বন্ধ করে দিয়েছিল । সুনিতা পড়ালেখা ঠিকমত না করায় দুই বছরের জুনিয়র হয়ে যায় । তূর্য ভেবেছিল যে, একদিন সুনিতাকে ওর ভাল লাগার কথা বলবে , কিন্তু সে কথা আর বলা হয় নি । কারণ তার আগেই বিয়ে হয়ে যায় সুনিতার । আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা । তখন তূর্য কলেজে পড়তো । সুনিতার একটা মেয়েও হয়েছে , খুব সুন্দর ফুটফুটে বাচ্ছা । সুনিতা এসেছে বাপের বাড়ি , তবে এবার এখনও দেখা হয় নি । হঠাৎই পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে সুনিতার মেয়েটি ওর দিকেই আসছে । মেয়েটি মামা, মাম বলে কোলে উঠতে চাইছে । দেখে সুনিতাও পেছন পেছন আসছে আর মুচকি মুচকি হাসছে । সুনিতার মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আদর করছিল আর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছিল তূর্যে । সে অনুভূতি কাউকে বোঝানো যায় না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:১৪