somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভুল বুঝাবুঝির অবসান হউক...

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৯:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিছুদিন আগে আমাদের এক বাংলাদেশী মেয়ের ফিবুলা ফ্র্যাকচার হলো, অপারেশনের খরচ পড়ল ৩০,০০০ইউয়েন (বাংলাদেশী টাকায় ৪ লক্ষ টাকা প্রায়)। এরপর কেরালার এক ছাত্রের ফিমার ভাংলো, অপারেশনের খরচ পড়ল ৫০,০০০ইউয়েন (বাংলাদেশী টাকায় ৬ লক্ষ ৭৫হাজার টাকা প্রায়)। এরা দু'জনেই আমাদের মেডিকেলের স্টুডেন্ট।আর অপারেশন হয়েছে আমাদের মেডিকেলেই। যারা বাংলাদেশে চিকিতসা করান বা করেন, তারা বলুনতো, আমাদের দেশে এই অপারেশনে কতো খরচ হয়? আমি যখন সিআরপিতে ছিলাম, বছর দু’য়েক আগের কথা বলছি, তখন প্রথমটার জন্য নিতাম ১০,০০০টাকা, আর পরেরটার জন্য নিতাম ১৫,০০০-১৮,০০০টাকা।তুলনা করে বলুন, যে দেশে চিকিতসার খরচ এত কম, অথচ মানের দিক থেকে তেমন হের-ফের নেই, সেখানে ডাক্তারদের বেতন এত কম কেনো? উত্তর হতে পারেঃ হাসপাতালের ইনকাম কম, তাই বেতন কম। বেশ, তবে চিকিতসার খরচ বাড়িয়ে দেয়া হউক, ডাক্তারের বেতনও বেড়ে যাবে।কিন্তু আমরা ডাক্তাররা তা চাইনা।এটা সঠিক সমাধান নয়।পড়ালেখার জটিল সিস্টেম, অর্থনৈতিক চাপ আর কাজের গুরুভারে ন্যুযমান ডাক্তারকে যদি তার পেশার গুরুত্ব অনুযায়ী সম্মান ও সম্মানী দেয়া হয়, তবে তার জন্য ঠান্ডা মাথায় সেবা দেয়া সহজ হয়ে যাবে।প্বার্শবর্তি রাষ্ট্র ভারতের একজন সদ্য পাশ করা ডাক্তার যেখানে ৪০,০০০রুপি (বাংলাদেশী টাকায় ৬০,০০০হাজার টাকা প্রায়) বেতন পায়, সেখানে আমার দেশের ডাক্তার কেনো ১৫-২০,০০০টাকা পাবে?আমার সাথে এখানে নেপালের একজন ডাক্তার এমডি করছেন, উনি বাংলাদেশ রাজশাহী মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন।উনি বললেন, নেপালের স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয় বাংলাদেশের এমবিবিএস ডিগ্রীকে ভারত-পাকিস্থানের চেয়েও অধিক কদর করে, কারন, বাংলাদেশের মেডিকেলের পড়ার মান ওই দুই দেশ থেকে অনেক ভালো।

নিজের কথাই বলিঃ আমি এখানে এমএস করতে এসেছি, ইউনিভার্সিটি আমাকে বিদেশী এমবিবিএস ছাত্রদের ক্লাশ নেবার দায়িত্ব দিয়েছে, দেশের পড়ার মান খারাপ হলে নিশ্চয়ই এ দায়িত্ব পেতাম না।আর আমাদের ইউনিভার্সিটিও চীনের মধ্যে অন্যতম সেরা ও বড়।

আমাদের স্যার বলতেন, রুগীকে যখন চিকিতসা দেও, মনে রাখবা,এরা তোমার বাবা-মা, ভাই-বোনের মতোই।আমার মনে হয় একথা শুধু আমার না, সব ডাক্তারেরই মনে বাজে, সেবা দানের সময় মনে থাকে।

তখন ইন্টার্নী করি সিলেট মেডিকেলে, এক রাতের বেলা সিএ-এর কল এলো, ইমাজেন্সী অপারেশন।বিয়ে করেই ইন্টার্নী শুরু করেছি মাত্র।স্ত্রীকে ঘরে একা রেখেই ছুটতে হলো রোগী বাঁচাতে…প্রচন্ড ঝড় তখন বাইরে…এখনো মনে পড়ে…।

আমি তখন শেরপুরে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করি।আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা।আর প্রথম মেয়ের বয়স দেড় হবে।রাত তিনটার সময়, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, ডাক্তার সাহেব আমার স্ত্রী অসুস্থ, আপনাকে যেতে হবে…হোন্ডায় করে শীতের রাতে দু’কিমি দুরে যাওয়া…ঘরে আমার অসুস্থ স্ত্রী…ছোট্ট মেয়েটা মায়ের সাথে একা।এমনতো একদিন নয়, প্রায় রাতই একই জিনিসের পুনরাবৃতি।

যেদিন সিআরপির চাকরী ছেড়ে দিলাম চীনে পড়তে আসবো বলে, রিসিপসনিস্ট আমিনুল ভাই জড়িয়ে ধরে বললেন, সাঈদ ভাই, আপনাকে ভুলবো না, কারন, আপনার রক্ত আমার শরীরে যে।মনে পড়ে গেলো, উনার হিপ প্রোস্থেসিস রিমুভ করার সময় যার রক্ত দেবার কথা ছিলো, উনি কি কারনে যেন রক্ত দিতে পারলেন না, কিন্তু রক্ত দরকার জরুরীভাবে, অপারেশনের পরপরেই।ডোনার না পাওয়ায়, অপারেশন শেষে আমাকেই দিতে হল এক ব্যাগ রক্ত, বলা বাহুল্য অপারেশনে তিন সার্জনের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন।

নিজের প্রচার না, নিজের ঢাক নিজে বাজানো না, আমার বিশ্বাস আমার ডাক্তার সহকর্মীরা একইভাবে রুগীর সেবা দিয়ে যান নিরবে, নিরলসভাবে।উত্তম কুমারের “অগ্নিস্বর” চলচিত্রটা আমাদের ডাক্তারী জীবনের বড় কাছ থেকে নেয়া। দেখেছেন কী? ডাক্তাররা বাহবা চায় না, কিন্তু তাই বলে লাঞ্ছনা তো তার প্রাপ্য হতে পারে না।

হাতের পাঁচ আংগুল যেমন সমান নয়, তেমনি সব পেশাতেই ভালো-মন্দ থাকে।আইনের উর্ধে কারো থাকা উচিত নয়, আর আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াও উচিত নয়।আমি অহংকারী নই, কিন্তু ডাক্তারী পেশা আমার অহংকার। কারন, এপেশার কারনেই আমি মানুষের জন্য তার অজান্তে যা করতে পারি, তা অন্য পেশায় কখনোই সম্ভব না। দেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে ডাক্তারদের সামগ্রিক অবমুল্যায়ন তাই সত্যিই কষ্ট দেয়।

মনে আছে কি, একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টার ১৯৯৩সালের সুদানের দুর্ভিক্ষের এক ছোট্ট মেয়ের ছবি তুলে পুলিতজার পুরষ্কার পেয়েছিলেন।মেয়েটা প্রচন্ড দুর্বলতার জন্য ফিডিং সেন্টারের কাছে যেতে পারছিলো না, তার কিছু দুরেই ছিলো এক বিশাল শকুন।ছবিটা ছাপানোর পরেই হাজার হাজার মানুষ ঐ মেয়েটার কি হয়েছিল তা জানতে চায়।কেভিন তার জবাব দিতে পারে নাই।মানুষ তাকে ধিক্কার দিয়েছিলো এইজন্য যে, সে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে ফিডিং সেন্টারে কেনো দিলো না। খ্যাতির জন্য মানবতার বিসর্জন কেন?পুলিতজার পুরষ্কারের ৩ মাস পরেই তাই কেভিন নিজের কৃতকর্মের দায় সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন।যারা নিজেদের সংবাদপত্রের কাটতির জন্য “ভুল চিকিতসায় রোগীর মৃত্যু” লিখে অপপ্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছেন, ডাক্তার-রোগীর সুসম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছেন, দেশের সুস্থ পরিবেশকে বিষাক্ত করার চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য কি কেভিন-এর ঘটনা যথেষ্ট নয়?

সমাজে কিছু লোক আছে যারা নিজের ছাড়া অন্যের ভালো বুঝতে চায় না।নিজের জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে না।এদের সংখ্যা কখনোই বেশী নয়, এরা সমাজের কীট, আর এই কীটগুলো সমাজে সবসময়ই কিছুটা রয়ে যাবে।তবে, এদের ব্যাপারে দেশের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।সিদ্ধান্তে এক থাকতে হবে।আমরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আমাদের এই চাওয়ায় কেউ ভুল বুঝুক- এ আমরা চাইনা; আমাদের এই চাওয়ায় কেউ বাঁধা হউক-আশা করি দেশের মানুষও এটা চাইবে না।

From 1st Affiliated Hospital, Zhengzhou University, China.
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×