somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক জন প্রফেসর সাহেব

১২ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রামের পাশের খালের উপর বাঁশের সাঁকোটা পার হতে হয় অনেক কষ্টে। পা পিছলে যে কোন সময়ে নীচে পড়ে যাওয়াটা তেমন কোন বিচিত্র ঘটনা নয়। তার পর আবার পায়ে চামড়ার বাটা জুতো। সকালের শিশির ভেজা বাঁশের উপর হাঁটা কি এতোই সোজা। অনেক কষ্টে পা টিপে টিপে তবে না পার হলাম। আবার হাঁটা। একটু হাটার পর ইট বিছানো পাকা সড়কে উঠা যায় । এখানে একটু দাঁড়ালেই অনেক রিক্সা । ভাড়া দিতে হবে ৫ টাকা। আমার কাছে ৫ টাকা তখন (২০০৩ সালে) অনেক টাকা । বেকার মানুষ। একটি টাকাকে মনে হয় এক শত টাকা। রিক্সা চড়া তখন মার্সিডিজে চড়ার মতো বিরাট এক বিলাসিতা। তার চেয়ে ১০ মিনিট হাঁটতে রাজি। হাঁটলে তো আর পয়সা খরচ হচ্ছে না। এমন যদি হতো যে হাঁটলেও পয়সা দিতে হবে সরকারের লোককে তাহলে তো বেকার লোকদের হতো জ্বালা। রাস্তার নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে ১০ মিনিট পার করে দেয়া আমার কাছে তো কোন বিষয়ই না। প্রতি দিনই তো তাই করি।

দ্রুত বেগে ১০ মিনিট হাঁটার পর আরাম বাস স্ট্যান্ডে আসতে পারলাম। বাসের নামটি আরাম। এটি তখন এক মাত্র বাস যা কিনা কাগজে কলমে সরাসরি ঢাকা যায়। বাকি সব বাসের ভাড়া ৪০ টাকা হলেও এর ভাড়া ৫০ টাকা। বাসটি কোন মালিক সমিতির হলেও এর কাউন্টার স্কুলের জায়গায়। স্কুলের হোস্টেলের একটি রুমও তারা ব্যবহার করছে। শুনতে পেলাম এর মধ্যেও নাকি রাজনীতি আছে। রাজনীতি তো থাকতেই পারে। নইলে কি আর স্কুলের মধ্যে বাস কাউন্টার বসানোর সাহস কারো হতে পারে।

আমি টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট চাইলাম।
ভাই, একটা টিকিট দেন, শ্রীনগরের। বলে ২০ টাকা এগিয়ে দিলাম।
আজ শ্রীনগরের টিকেট শেষ। ঢাকার টিকেট নেন।
কিন্তু আমি তো যাব শ্রীনগর, ঢাকার টিকিট তো ৫০ টাকা দাম। আমি ৫০ টাকা দিয়ে শ্রীনগরের টিকেট কেন নেব?
যদি যেতে চান তাহলে তো নিতেই হবে।
হাতে সময় নেই। তাছাড়া আরামের সার্ভিস একেবারে খারাপ নয়। এই কারণে ৫০ টাকা দিযেই ২০ টাকার পথের টিকিট নিলাম। অনেক বড় বোকামী হয়ে গেল। পরের স্টপেজে ঠিকই টিকিট পাওয়া যেত। ৩০ টাকা লস হয়ে গেল সকাল বেলায়। সময় মতো বুদ্ধি খেলে না । মাথায় কি কেবল গোবর ভরা!



এই পথ আমার অনেক চেনা। জয়পাড়া থেকে লৌহজং পর্যন্ত পথের আশে পাশের প্রতিটি বাড়ি প্রতিটি গাছ যেন আমার কাছে অনেক চেনা। যেন এক রকম মুখস্থ। কিন্তু কেন যে বোকার মতো ৫০ টাকা খরচ করে ফেললাম। পরের স্টেশন দোহার বাজারে গিয়ে ২০ টাকা দিয়ে টিকিট নিলেই ৩০ টাকা বেঁচে যেত। এখন আমার টাকা বাঁচানো অনেক জরুরী।


মানুষের জীবন চক্রের একটি কষ্টকর সময় হচ্ছে বেকার কাল। বেকার কাল সবার জীবনে অবধারিত ভাবে আসবেই। একে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। তবে যাদের বাবার বড় ব্যবসা কিংবা কোন উপায় আছে তারা সরাসরি সেখানে গিয়ে বসলে বেকার জীবন তাদের নাও পোহাতে হতে পারে। বেকার জীবনে অর্থ সংকট একটি খু্ই সাধারণ ঘটনা। আয়ের কোন উৎস না থাকাতে নিজেকে অনেক গুটিয়ে রাখতে হয়। তবে বেকার জীবনের মজাটাও উপভোগ করতে হবে। এর একটা অন্য রকম আমেজ আছে। আমার সময়ের একটা অংশ কাটে টিউশনী করে। পড়াতে হয় স্কুলের ছাত্র। বিনিময়ে কিছু টাকা পাই।


শ্রীনগরের সাথে যেখানে দোহারের সড়ক গিয়ে মিলেছে সেই মোহনাকে বলে ছনবাড়ি। এখানে কোন বাস থামতে চায় না। তবে গাঙচিল পরিবহনের একটি কাউন্টার আছে যার কাজ ওয়েবিল চেক করা। প্রফেসর পরিচয় দিতেই কাজ হল। চেকার সাহেব আমাকে গাড়ীতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করলেন । এখানেই শেষ নয়। গাঙচিল যে সব সময় পাওয়া যাবে না নয়। যখন পাওয়া যাবে তখন হয় ভয়াবহ লোকাল বাসে কিংবা শ্যালো ইনিঞ্জনের গাড়ীতে চড়ে যেতে হবে। বেশীর ভাগ সময় এটাই করতে হয়। শ্যালো ইঞ্জিনের ফট ফট শব্দ তো আছেই । প্রায়ই ড্রাইভারের পাশে বসতে হয় বলে ইঞ্জিনের কালিতে মাঝে মাঝে পোশাকের অবস্থাও সঙ্গীন হয়।


কলেজের প্রভাষকের চাকরিটি কিভাবে পেলাম তাও এক ইতিহাস। হঠাৎ করেই পত্রিকা উল্টাতে গিয়ে দেখি কলেজে এক জন প্রভাষক নেয়া হবে। আবেদন করলাম। হয়েও গেল। তবে বেতন ভাতা শুণ্য। আমি তাতেই খুশী। দারুণ খুশী। না হোক বেতন। বেকারত্ব নামের আইবুড়োত্ব তো ঘুচল। এটাই বা কম কিসে। তার চেয়ে বড় কথা অনেকেই আমাকে প্রফেসর সাব বলতে শুরু করল। এই জিনিসটা অনেক মজা লাগত। গ্রামের মানুষ কলেজের মাস্টার বলতেই মনে করে প্রফেসর।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মো: জমির হোসেন লোকটি অসাধারণ। মাস্টারীর প্রতি তার টান প্রবল। প্রতি দিন ঢাকা থেকে গাঙচিল নামক বাসে চড়ে আসেন আবার বিকেলে ক্লাস শেষে ঢাকা ফিরে যান। যাতায়াতের এই ধকল কাটিয়ে তিনি আবার ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় লেখালেখি করেন। তার বেশ কটি লেখা আমি পড়েছি। সাহিত্য নিয়ে তার বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করত। তার পত্নী শাহানা আপাও এক জন মাস্টার। তিনি বিক্রমপরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। সন্ধ্যার পর বাসায় আবার বাসায় শখের হোমিওপ্যাথি চর্চা করেন। তিনি আবার আমার বিয়ের ঘটকালির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষকতা আর হোমিও চর্চায় তিনি সফল হলেও ঘটকালিতে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ। কারণ তিনি আমার কুমারত্ব ঘুচাতে সফল হননি। মাস্টার বিশেষ করে বেসরকারী কলেজের মাস্টারের জন্য পাত্রী এতো সুলভ ছিল না।

ইংরেজির নুরুন্নাহার আপা। তিনি এক জন সংগ্রামী নারী। পিতার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরেছেন। ভাইবোনদের মানুষ করেছেন। কিন্তু নিজের দিকে তাকানোর মতো সময় তিনি করে উঠতে পারেননি। তাই তিনি ছিলেন অকৃতদার। তিনি, জমির ভাই আর আমি মাঝে মাঝে পদ্মার পারে নদীর ভাঙন দেখতে যেতাম। উন্মমত্ত পদ্মার হিংস্রতা তখনো থামেনি। কলেজ ভবনটা ভেঙ্গে নিয়ে যাবে এই আশংকা আমাদের সকলের।

সব কিছুর পর একটাই সান্ত্বনা যে আমি তো বেকার নই। একটা চাকরি তো আছে। হোক তাতে বেতন নেই। বেতন না হোক । আমার পরিচয টা অনেক বড়। কলেজের মাস্টার মানেই গ্রামে তার পরিচয প্রফেসর সাব। আমি আপাতত প্রফেসর সাব হয়েই রইলাম। না হোক টাকা। না হোক বেতন।


এক একটা সময় ছিল যখন মাস্টারদের দাম সমাজে ছিল কল্পনাতীত। এরশাদ সাহেবের পতনের পর দেশে নেতা হবার জোয়ার আসে। ঘরে ঘরে গজিয়ে উঠে হাজারো নেতা আর পাতি নেতা। মানুষের পরিচয় দাঁড়ায় দলের পরিচয়ে। ছোট ছোট বাচ্চারাও নেতা হয়ে গেছে। ফলে আদব কায়দার মাত্রাটা আর আগের মতো থাকেনি। যারা নিখাঁদ ভদ্রলোক ছিলেন সময়ের প্রয়োজনে তারা চুপ মেরে গেলেন। মান-সম্মান বাঁচানার জন্য তারা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শুরু করলেন। রাজনীতির চক্র সহজে কি আর পিছু ছাড়ে? ফলে শিক্ষকদের কেউ কেউ আবার রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে শুরু করলেন। দেশটা পচে যেতে শুরু করল তো এই ভাবেই ।

মাঝপথে কটি জিন্স আর গেঞ্জি পড়া ছেলে উঠল। তারা নাকি সামনের কলেজে (দোহারের পদ্মা কলেজ) পড়ে। কিন্তু যাবে ঢাকা । ভাড়া চাইতেই তারা হৈ চৈ শুরু করল। কলেজে পড়লে তো ভাড়া দিতে হয়না। তারপর তারা রাজনীতি করে। তাদের তো বাস ভাড়া দেয়া শোভা পায় না। মান ইজ্জতের একটা ব্যাপার আছ না। ছাত্ররাজনীতি করে যদি বাসে চড়েও ভাড়া দিতে হয় তাহলে আর মান ইজ্জত থাকে কই। টাকা বড় না ইজ্জত বড়। অবশ্যই ইজ্জত বড়। ২০/৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে ইজ্জত খোয়ানোর কোন মানে হয়? এই নিয়ে প্রায় হাতাহাতি। কন্ডাক্টর পোলাটাও বড্ড বেয়াড়া। সে আইডি কার্ড দেখতে চায় । আরে ব্যাটা, তোকে কি আইডি কার্ড দেখাতে হবে? তোর কি আর আইডি কার্ড দেখার কোন যোগ্যতা আছে। সেটাই যদি থাকত তাহলে কি আর বাসের ভাড়া কাটতি, ফাজিল কাহাকা!

বোরখা পড়া বেশ কটি মেয়ে উঠল সামনের স্টপেজ থেকে। কারোরই মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে অনেক ব্যস্ত তারা। মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটছে যেন। এক জন বলছিল তার পাশের জনকে। তার ছোট্ট মেয়েটির শরীর খারাপ। কলেজে আসতে মন চাচ্ছিল না। কিন্তু কলেজে না এলে তার ভাল লাগে না। এতো আগে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে কলেজ জীবনটাকে সে ঠিক মতো উপভোগ করতে পারছে না। এরই মাঝে সন্তানের মা হয়ে গেছে সে। তার জন্য সে নানান আকুতি প্রকাশ করছিল বান্ধবীদের কাছে। দোহারে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা হয় না বললেই চলে। অনেক বিদেশী ছেলে আছে। সুন্দরী মেয়েদের তো এসএসসি পাস করাই দায়। ঘটকরা তাদের উচ্চ শিক্ষার পথে বিরাট বাঁধা। কোন বিদেশী (দোহারী পোলা কিন্তু থাকে ইউরোপে) ছেলে পেলেই বিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করে। এই কাজে তারা বেশ সফল।



আমার কলেজে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গার্ড দেবার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এটা একটা কঠিন কাজ। বসার কোন সুযোগ নেই। পাক্কা ৩ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
পরীক্ষা চলাকালীন এক ছাত্রীর কাছে যেতেই সে বলল, আমার এটাই জীবনের শেষ ক্লাশ স্যার।
বললাম, কেন, কেন? শেষ ক্লাশ কেন,বলতো?
স্যার, আমার তো বিয়ে ঠিকঠাক।
বিয়ে কেন ঠিকঠাক? মাত্র তো দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছ। এটাই শেষ ক্লাশ হলে চলবে কেন। বিয়েই বা কি করে ঠিকঠাক হল।
বাবা মা একটা ভাল ছেলে পেয়েছে। তাই সব ঠিকঠাক । এই দেখুন আংটি। বলে হাত তুলে আঙ্গুল দেখাল
আমি দেখলাম আসলেই তার চম্পক অঙ্গুলিতে জ্বল জ্বল করছে একটি আঙটি।
ছেলে কি করে?
কিছুটা লজ্জিত আর কিছুটা আনন্দি স্বরে মেয়েটি বলল, ইতালিতে থাকে স্যার। এতো ভাল ছেলে তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না।



ক্লাসে আরেকটি মেয়ে ছিল। সে ছিল ক্লাসের সব চেয়ে রুপবতী মেয়ে। কলেজের ড্রেসেই তাকে এতো বেশী অসাধারণ লাগত যে মনে হতো বিধাতা কোন বিশেষ নজর দিয়ে মেয়েটিকে তৈরী করেছে। রুপবতী মেয়েরা সাধারণ ছাত্রী ভাল হয় না। অথচ আশ্চর্য। এই মেয়েটি পড়াশোনায় অসাধারণ। ক্লাসেও বেশ নিয়মিত। হঠাৎ দেখি মেয়েটি আর ক্লাসে আসছে না। কে জানে কোন খারাপ কিছু কিনা। এরই মাঝে আমি নিজেও অনেক দিন অনিয়মিত হয়ে গেলাম। তারপর আবার কলেজে যেতে শুরু করলাম। হঠাৎএকদিন দেখি সেই রুপবতী মেয়েটি ক্লাসে । তবে তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন। বোরখা পড়ে এসেছে। কেবল ক্লাসের ভিতর সে মুখ বের করছে। বাইরে তাও না। পরে সম্ভবত দুলাল মিয়ার মারফত খবর পাওয়া গেল ইটালীতে চাকরিরত কোন এক যুবকের সাথে তার বিবাহ হয়েছে। বরের কঠোর নির্দেশ বোরাখা পড়তে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই আমি ২০০৫ সালের জুলাই মাসে কলেজ ছেড়ে দিই । ফলে আর জানা হয়নি তার রেজাল্ট কেমন ছিল। তবে আমার ধারণা এই মেয়েটির ঐ সময়ে বিবাহ না হলে এবং ভাল সুযোগ দিলে সে যথেষ্ট ভাল রেজাল্ট করতে পারত। লৌহজং উপজেলার হলদিয়া এলাকার ঐ মেয়েটির ডাকা নাম আমার জানা হয়নি। শিক্ষকরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রীদের ডাক নাম জানতে পারে না। কেননা, নাম জিজ্ঞেস করলে কেউ তো আর ডাকা নাম বলে না। বলে সার্টিফিকেট নাম। তাই মাস্টাররা যারা কেবল ফরমাল ক্লাস নেয় তারা তো জানতে পারেই না। সঙ্গত কারণেই আমি ঐ মেয়েটির কেন আমার ক্লাসের কোন মেয়ের নামই এই লেখায় উল্লেখ করলাম না।


কলেজে কোন এক অজ্ঞাত কারণে দেখতাম মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশী। লাইব্রেরিয়ান সাহেব বলতেন, ছেলেরা এসএসসি পাস করেই বিদেশ চলে যায়। মেয়েরা আসে। তার একটা কারণ উপবৃত্তি আর অবৈতনিক শিক্ষা। তবে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীও ছিল অনেক। বেশ কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে আমার কাছে অনেক মেধাবী আর চৌকষ মনে হত। তাদের নিয়ে আমার অনেক মজাদার আর কিছু বিব্রতকর স্মৃতি আছে। কোন কোন ছেলে মাঝে মাঝে তাদের হৃদয় ঘটিত সমস্যার কথা আমাকে জানাত। যে যাকে ভাল বাসে তাকে কেন পায় না চিরন্তন এই প্রশ্নের মাঝে তারা পড়ে গেছে কলেজের প্রথম বর্ষে এসেই । বড় কঠিন তাদের সমস্যা। যার কোন সমাধান নেই।



এই অঞ্চলে পড়াশোনার চল অত ব্যাপক নয়। অথচ মজার ব্যাপার, অনেক জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির তীর্থ ভূমি এই অঞ্চল । এই খানে অতীতে যেমন অতীশ দীপংকর , জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো জ্ঞানী ব্যক্তিরা জন্মেছেন তেমনি এই যুগের অনেক জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিও জন্মেছেন। ড: ফখরুদ্দিন আহমেদ, বি চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ এরা তো এই অঞ্চলেরই গুণী সন্তান। সেই অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা আজকাল পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এটা কি ভাবা যায়? অথচ এটাই তো এখনকার বাস্তবতা ।

দুলাল মিয়া পুরোপুরি এক জন পরিতৃপ্ত মানুষ। তাকে দেখে এতো বেশী তৃপ্ত আর সুখী মনে হয় যেন তার আজীবনের স্বপ্নই ছিল এই কলেজের দফতরীর চাকরীটি পাওয়া। সেটা পেয়েই তিনি সুখী। এলাকার কত জন তাকে চেনে জানে। অনেক বড় ধনী ব্যক্তি ও তাকে দুলাল ভাই বলে ডাকে । এর চেয়ে আনন্দেও কথা আর কি হতে পারে।


দুলাল মিয়া এসে বললেন, স্যার, প্রিন্সিপার স্যার আপনেরে সালাম দিছেন। ছুটির সময় দেখা কইরা যেতে বলছেন।


আমি জানি তিনি কি বলবেন। প্রতিবারই আমি যখন ক্লাস নিতে আসি তিনি আমাকে ডেকে পাঠান । কিছু কমন কথা বার্তা বলার পর বলবেন: পাঁচদিন ক্লাশ নিলে কি ভাল হয না?

বরাবরই আমি এই প্রশ্নের জবাবে চুপ করে থাকি। আজও চুপ করে থাকব।


আমি তাকে এখনো বলতে পারছি না যে এই চাকরিতে আমার পোষাচ্ছে না । আমার বেতন মাত্র ৪৮০ টাকা। তাও আজ পর্যন্ত পাইনি। এদিকে আরেক ঝামেলা। ঝামেলাটি প্রাকৃতিক। আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। সরকারী কোন অফিসে আর আবেদন করতে পারছি না। গত বছর থেকেই । চোখের সামনে দিয়ে আরেকটি বিসিএস চলে গেল। অনেক জুনিয়র পোলাপান্ও টিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার অফিসার হয়ে গলায় টাই বেধে আরামসে ঘুরে বেরাচ্ছে। আমি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় মরে যাচ্ছি। কি যে করব বুঝতে পারছি না। কলেজের এই চাকরিটা ছাড়তেও পারছিনা। বর্তমানে যে বাজার তাতে একটি স্কুলে ঢোকাও অনেক কঠিন। না হোক বেতন । সবাই তো জানে আমি একটি কলেজের মাস্টার। বন্ধুরা দুষ্টুমী করে বলে: প্রফেসর সাব... ... । এই বা আমার জন্য কম কিসে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হতে তো বাঁধা নেই।


একটি ব্যাপার প্রতিনিয়তই ঘটছে। সকালে আরাম বাসে উঠার খানিক পরই কেন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুমানোর পর এমন সময় ঘুম ভাঙ্গে ঠিক যখন আরাম বাসটি শ্রীনগর বাজারে এসে পৌছে। কন্ডাক্টরের হাঁক-ডাকে উঠে যেতে হয়। কারণ ২০ টাকার টিকেটের যাত্রীদের বৈধতার সীমানা এই পর্যন্তই। এর চেয়ে বেশী যেতে চাইলে নানা অপমানজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। তার চেয়ে নেমে য্ওায়াই উত্তম। এই সময় শ্রীনগর বাজারের আরেকটি ব্রিজ পার হয়ে বেজগাঁও নামক স্থানে পৌছাতে চাইলে সহজ উপায় হেঁটে যাওয়া তো বটেই। তবে ভাগের রিক্সা পাওয়া যায়। একা গেলে ৩ টাকা । ২ জনে ভাগে গেলে পড়বে ৪ টাকা । সেই ক্ষেত্রে নিজের ভাগে পড়ে মাত্র ২ টাকা। তবে ১ টাকার জন্য কেই বা ভাগে যেতে চায়। তাই পকেট থেকে আবার বের হয়ে গেল ৩ টাকা। সকালে ১০০ টাকার ১ টি নোট নিয়ে বের হলে শেষ পর্যন্ত ৫ টাকাও থাকে না। অথচ ইনকাম বলতে গেলে এখনো শূণ্য।


এই দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে এতো বেশী ক্লান্ত থাকি যে বাসে উঠে বসামাত্র রাজ্যের যত ঘুম আমার চোখে ভীড় করে। একবার কলেজ থেকে ফেরার পথে শ্রীনগর থেকে বাসে ২০ টাকার টিকেট নিয়ে বাসে উঠেছি। সিট পাওয়ামাত্র যেই না বসেছি অমনি চোখে বাঁধভাঙ্গা ঘুম। মনে নেই কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। আরাম বাসের একটি সুবিধা জয়পাড়া গিয়ে স্কুলের হোস্টেলের আশেপাশে পার্ক করে রাখে। ঘন্টা ২ পরে ঘুম ভাঙ্গল। চমকে উঠলাম আমি। কোথায় আমি। চোখ মেলে দেখি বাসে আমি আমার সিটে ঘুমিয়ে আছি। বাসটি পার্ক করা আছে পুকুরের পারে। ড্রাইভার-হেল্পার পরের ট্রিপের সিরিয়াল পাবার জন্য চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা মারছে। কেউ আমাকে ডেকে তুলেনি। বড্ড প্রীত হলাম তাদের উপর আমাকে এমন একটা ঘুমের সুযোগ দেবার জন্য। তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে আবার ছুটলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় দফা গোসল করে বিলম্বিত মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে তো।

সর্বশেষ ভাইবাটি দিয়ে বের হলাম। প্রতি দিনের পত্রিকার পাতা দেখি। রেজাল্ট দেয় কিনা। একদিন ভোরে আমার এক সরকারী কলেজের মাস্টার বন্ধু আমার মোবাইলে এসএম এস দিয়ে জানায় বিসিএস এর রেজাল্ট বের হয়েছে। তাড়াতাড়ি জয়পাড়া যাই। ইত্তেফাক ,দেখি, যুগান্তর দেখি, প্রথম আলো দেখি, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ দেখি। কোথাও আমার রোল নম্বর নাই । হতাশায় বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। কেউ জানতেও পারে না। কত কষ্টে কাটছে আমার দিনকাল।


তবু বাঁচতে হবে। মরে যাবার কোন উপায় নেই। বাঁচতে হলে আয়ের একটা পথ থাকতে হবে। তার জন্য চাই কাজ। কাজ ছাড়া বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।


২০০৪ সালে উপাধাক্ষ্য মহোদয় আমাকে বললেন যে আমি ৬০০০ টাকা যোগাড় করতে পারব কিনা।

আমি বললাম, স্যার, আমি টাকা কোথায় পাব? আমার তো কোন আয়-রোজগাড় নেই। আপনি তো সবই জানেন।

তারপর তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল- শিক্ষা ভবনে তার এক জন চেনা-জানা লোক আছেন যাকে কিছু টাকা দিলে আমার এমপিওটা হয়ে যেতে পারে। অনেক ভেবে, অনেক চিন্তে, ধার-দেনা করে ৩০০০ টাকা যোগাড় করি। আমার কাছে মনে হল যেন ৩ লাখ টাকা যোগাড় করলাম। সেই টাকা তুলে দিলাম তার হাতে। তিনি অনেক চালু লোক। সব দিক সামলে চলা তার অভ্যাস। গণিতের ক্লাশ নেন। জীবনের অনেক অঙ্ক তিনিও নাকি মেলাতে পারেননি। তবে শিক্ষাভবনে আমার এমপিও তিনি ঠিকই বাগিয়ে আনলেন। আমার বেতন হয়ে গেল ৪ হাজার ৩ শত ২০ টাকা।


প্রতি দিনকার মতো আবারও সকাল বেলায় সেভ করি। জামা-কাপড় পড়ি। আবারও সাঁকো বেয়ে পাড় হই। সড়কের পাড় ধরে হাটতে থাকি। গন্তব্য আরাম বাস স্ট্যান্ড। ৫০ কিমি পথ পার হয়ে আমাকে যেতে হবে মাস্টারী করতে। আমি একজন মাস্টার। কেউ কেউ বলে প্রফেসর সাব।


**********************************************************************************************************************
পাদটীকাঃ
(২০০৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০০৫ সালের ৩১ শে জুলাই পর্যন্ত আমি লৌহজং কলেজের মাস্টার ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় অনেক ভালো লাগা আর অনেক মন্দ লাগার অনুভূতি আছে। কষ্টের স্মৃতি যেমন আছে তেমনি সুখের স্মৃতিও আছে।

এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়, আধা বেকার ছিলাম ভালোই তো ছিলাম। মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি মাস্টার হয়ে যেতে মন চাইতো। কয়েক বার পণও করেঠিলাম যে, সত্যি সত্যি মাস্টার হয়ে যাবো। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো যে, আমি সত্যি সত্যি মাস্টার হতে পারিনি। তাই ২০০৫ সালে ৩১ শে জুলাই তারিখের অলস বিকেলে আমি প্রভাষক পদে ইস্তফা দিয়ে ভার মুক্ত হয়ে আমার নিজ গ্রামে চলে আসি। এখনো আমার মাঝে মাঝে মনে পড়ে কলেজে মাস্টারীর নানান কথা )


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:১১
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×