somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সেলিম আনোয়ার
পেশায় ভূতত্ত্ববিদ ।ভালো লাগে কবিতা পড়তে। একসময় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালবাসতাম। এখন সময় পেলে কবিতা লিখি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল ভালো লাগে খুব। ভালোলাগে রবীন্দ্র সংগীত আর কবিতা । সবচেয়ে ভালো লাগে স্বদেশ আর স্বাধীন ভাবে ভাবতে। মাছ ধরতে

বাংলাদেশের রাঙামাটি ও পার্বত্য এলকায় সাম্প্রতিক ভূমিধসের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি এবং ভূমিধস প্রতিরোধে করনীয়

২৬ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
একনজরে সামপ্রতিক ভূমিধ্বসে আক্রান্ত রাঙামাটি জেলার বর্তমান চিত্র:



----------------------------------------------------ছবি: সাপছড়ি, নিজস্ব এলবাম

• ২৫,৬০০ জনের বসবাসের জায়গা রয়েছে রাঙামাটি পৌরসভায়
• ৬ গুণ বেশি মানুষ থাকছে সেখানে
• ১৬ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে
• ৬৪.৭৫বর্গকিলোমিটার আয়তন রাঙামাটি পৌরসভার
• ৩২ বর্গকিলোমিটার কাপ্তাই লেক ও বসবাসের অনুপযোগী অঞ্চল
• ৩২.৭৫ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা বসবাসের উপযোগী পৌরসভার হিসাবের চেয়েও প্রায় এক লাখ বেশি মানুষ শহরে বসবাস করায় এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।


• প্রতিবছর রাঙামাটি বেড়াতে যায় কয়েক লাখ পর্যটক। তাদের অনেকেই রাত কাটায় শহরে। পর্যটকের বাড়তি চাপও সইতে হচ্ছে শহরটিকে। (সূত্র: রাঙামাটি পৌরসভা)
• রাঙামাটি জেলার বর্তমান জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার। আয়তন ৬ হাজার ১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। ( জাতীয় তথ্য বাতায়ন )।
• ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের পর রাঙামাটি শহরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। শহরে আসা নতুন মানুষের জন্য পরিকল্পিত বসতি স্থাপনের বিষয়ে রাঙামাটি জেলা ও পৌর কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নজরদারি ছিল না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষগুলোও কোথাও উদাসীন ছিল, আবার কোথাও অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনে জড়িত ছিল বলে জানান পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে রাঙামাটির পাহাড়-গুলোতে যে বসতি গড়ে উঠেছে, তা নির্মাণের সময় ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড (গৃহনির্মাণ কোড) মানা হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মানুষের বসবাসের কারণে পাহাড়গুলোর বহনক্ষমতা হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ফলে বসবাসে ঝুঁকি বেড়েছে রাঙামাটি শহরের জেলা প্রশাসকের বাংলো, পুলিশ সুপারের বাংলোসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা খুবই অপরিকল্পিতভাবে হয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় এসব বাংলো ও স্থাপনা দৃষ্টিনন্দন করার ক্ষেত্রে যেভাবে নজর দেওয়া হয়েছে, সেভাবে পরিকল্পিত উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। (অধ্যাপক অলক পাল , ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষের কারণে জেলার প্রত্যন্ত এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন বিভিন্ন সময়ে শহরে এসে থাকতে শুরু করে। পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং পাহাড়ে আনারস, আদা ও হলুদের চাষাবাদকে কেন্দ্র করে বাঙালিদেরও বসতি বাড়তে থাকে। গত দুই দশকে পৌরসভার জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

গত ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনায় রাঙামাটিতে ১২০ জন মারা যান।এর মধ্যে শহরে মারা যায় ৭৩ জন। শহরের ভেদভেদী এলাকাতেই ৪৬ মানুষ মারা যায়। আহত হন অন্তত ৮৮ জন। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ। তখন রাঙামাটিতে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলে জেলা প্রশাসন। ৩ হাজার ৪৯০ জন ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষ এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। গত ২৭ জুন থেকে ধীরে ধীরে আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেন লোকজন। ৮ আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ৯৪ জন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছেন। এখন ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৩৯৬ জন রয়েছেন।

শহরের বিভিন্ন পাহাড় ও টিলার চূড়া, ঢাল ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি স্থানে
এখনো প্রায় ১০ হাজারের বসতি রয়েছে। নতুনপাড়া, শিম্বুলতলী, রূপনগর, পশ্চিম মুসলিম পাড়া, বিএডিসি কলোনি, পোস্ট অফিস কলোনি, উলুছড়া, আলুটিলা, কিনামনি ঘোনা, মোনতলা, যুব উন্নয়ন এলাকা ও মোনঘর আবাসিক এলাকায় এসব বসতি গড়ে উঠেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বসতিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ (এই ব্যবস্থা না করলে চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করত। চুরি ঠেকাতে যে জনবল দরকার, তা তাঁদের নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিয়েছে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ) রয়েছে।।

শহরের রূপনগর এলাকার গৃহবধূ ফাতেমা বেগম প্রায় তিন বছর আগে সরকারি পাহাড়ে বসতি গড়ে তোলেন। তাঁর স্বামী কবির আহমেদ দিনমজুর।বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে তাঁরা নোয়াখালী থেকে রাঙামাটি শহরে আসেন। প্রথমদিকে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তিনি বলেন, মিথ্যা বলে লাভ নেই, কয়েক বছর আগে এই জায়গাটি দখল করে তাঁরা ঘর তুলেছেন। পাহাড়ধসে তাঁদের ঘরটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সূত্রঃ প্রথম আলো)
‘এখানে পাহাড়ের ৯০ ভাগ বসতি অবৈধ। তাদের কাছে কোনো আরএস কিংবা বিএস খতিয়ান নেই। এগুলো চিহ্নিত করতে অনেক সময়ের দরকার। আবার এসব বসতিতে বিদ্যুৎ-সংযোগও দেওয়া হয়েছে। আবার বসতিগুলো পৌরসভার হোল্ডিংভুক্তও। এখন আমরা কোথায় যাব বলেন?’(অবৈধ বসতির বিষয়ে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান)



পর্যটন খাতে ক্ষতি:
ভয়াবহ পাহাড়ধস রাঙামাটির পর্যটনশিল্পকে বড় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা বেহাল হয়ে পড়ায় দুই মাস ধরে রাঙামাটি প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। রাঙামাটি চেম্বারের হিসাবে, জেলায় পর্যটনের পাঁচটি খাতে দিনে গড়ে অন্তত ৩০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। খরচ কমাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই চলছে।

পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কয়েকটি কারণে সাম্প্রতিক পাহাড়ধস ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এই কারণগুলোর মধ্যে এগারোটি মানবসৃষ্ট এবং পাঁচটি প্রাকৃতিক।

গত জুনের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে অন্তত ১৬২ জনের মৃত্যু হয়।
পাহাড় ধসের মানবসৃষ্ট কারণ:
১) নির্বিচারে বন ও গাছপালা ধ্বংস করা।
২) লাগসই পরিকল্পনার অভাব।
৩) অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন,
৪) রাস্তা ও সড়ক নির্মাণ এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক স্থাপনা নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানা।
৫) উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
৬) পাহাড়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব।
৭) মাটি পরীক্ষার ফলাফল যথাযথভাবে অনুসরণ না করে পুরোনো অ্যালাইনমেন্টের ওপর কাজ করা।
৮) অপরিকল্পিত জুমচাষ। জুমচাষে আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করা।
৯) পাহাড়ের পরিবেশ-প্রতিবেশ অনুযায়ী ফসলাদি চাষ না করে আদা, হলুদের চাষ করা।
১০) পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ না লাগিয়ে বেশি লাভের আশায় অধিক হারে সেগুনগাছ লাগানো।
১১) পানিনিষ্কাশনের সুযোগ না রেখে উন্নয়নমূলক কাজ করা। পাহাড় থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন।

পাহাড়ধসের পেছনে পাঁচটি প্রাকৃতিক কারণ:

১। অতিবৃষ্টি,রাঙামাটিতে গত ১০ থেকে ১৫ জুন সময়ে ৯৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়; যা গত ১০ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ডের প্রায় নয় গুণ বেশি।
২। মাটির প্রকৃতি। ওই অঞ্চলের বেলে-দোআঁশ মাটি বৃষ্টির পানিতে সহজে নরম হয়ে যায়।
৩। দীর্ঘ খরার পর একটানা গভীর বৃষ্টি,
৪। ভূমিকম্পে পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হওয়া
৫। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

এক সপ্তাহ রাঙামাটিতে সরেজমিনে ঘুরে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবসতিহীন যে পাহাড়গুলোতে ধস হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই ছিল সেগুনবাগান। আর কিছু ছিল আম-লিচু ও অন্যান্য ফলের বাগান। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে সেগুন বন করা হলেও এই গাছটি ওই অঞ্চলের নিজস্ব (ইনডিজিনাস) প্রজাতি নয়। যেসব পাহাড়ে সেগুনবাগান করা হয়, সেখানকার মাটিতে দূর্বাঘাস জন্মায় না। আম-লিচুর বাগান করার জন্যও পাহাড় কাটা ও প্রাকৃতিক বন উজাড় করা হয়। ফলে অব্যাহতভাবে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় হতে থাকে এবং পাহাড়গুলো নাজুক হয়ে পড়ে।

পাহাড়ধসের অরেকটি কারণ বলা হচ্ছে জুম চাষ। কিন্তু রাঙামাটি সদর, বরকল, কাপ্তাই ও কাউখালী উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, যেসব পাহাড়ে ধস হয়েছে, সেগুলো মধ্যে জুম চাষের পাহাড়ের সংখ্যা কম। ধসের কারণ হিসেবে কাপ্তাই হ্রদ অনেকটা দায়ী। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, ৭২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদের বর্তমান যে বিস্তৃতি, তা প্রাকৃতিক নয়। প্রাকৃতিক হ্রদটি ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেক ছোট, পাহাড়ের উপত্যকায় প্রবাহিত। সেই হ্রদের দুই পারে ছিল রাঙামাটি শহরসহ জনবসতি ও চাষাবাদ। দুই পারের পাহাড়গুলো ছিল আরও দূরে।

পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রাকৃতিক হ্রদের দুই পাড় তলিয়ে পানি পৌঁছে যায় পাহাড়গুলোর পাদদেশ পর্যন্ত আর জনবসতি স্থানান্তরিত হয় পাহাড়ের ওপরে। তখন থেকে প্রায় ৫৭ বছর ধরে পাহাড়ের পাদদেশ হ্রদ্রের পানিতে নিমজ্জমান। ফলে পাহাড়ের মাটির প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। বালু ও মাটির এই পাহাড়গুলো অনেক নাজুক হয়ে পড়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। গত এক দশকে এই অঞ্চল ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পন হয়েছে। ফলে পাহাড়গুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়া ১৩ জুন পাহাড়ধসের আগে, তিন-চার দিন ধরে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে (তিন দিনে প্রায় ৫৯০ মিলিমিটার)। সেই বৃষ্টিতে নাজুক পাহাড়গুলোর মাটি ধসে পড়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে আদি বাসিন্দাদের অনেকে ১৩ জুনের পাহাড়ধসের তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে বজ্রপাতকেও দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির পাশাপাশি ওই সময় অস্বাভাবিক রকম বজ্রপাত হয়েছে। ১২ জুন দিবাগত রাতের শেষ প্রহরে প্রায় চার ঘণ্টা মুহুর্মুহু বজ্রপাত হয়েছে। বজ্রপাতে সৃষ্ট কম্পন পাহাড়ধসের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী বলে রাঙামাটির প্রবীণ বাসিন্দাদের কেউ কেউ মনে করেন। হুমায়ূন আখতার স্যার সহ ভূমিধ্বস বিশেষজ্ঞদের অনেকে এর সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। স্থানীয় লোকজন ভূমিকম্পের সময় কম্পন অনুভব করলেও সেটি বজ্রপাতের ফলে প্রতিধ্বনির জন্য হয়নি।

কম্পন হয়ে থাকলে আমার বিবেচনায় এর জন্য দায়ী কাপ্তাই ড্যাম। মাত্রাতিরিক্ত পানি জমা হওয়ায় সৃষ্ট প্রচন্ড পোর ওয়াটার প্রেসার এই কম্পন সৃষ্টি করেছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । তাই কম্পন অনুভূত হয়ে থাকলেও তা বজ্রপাতের কারণে নয়। এটা দৃঢ় ভাবেই বলছি ।
পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে ওই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়াই রাস্তাঘাট ও স্থাপনা নির্মাণেরও দায় থাকতে পারে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, পাহাড়ি অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য সমতলের চেয়ে আলাদা। কাজেই পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ভবনাদি নির্মাণের আগে ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ভবনাদি নির্মিাণ করা হলেও কোনো ক্ষেত্রেই ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়নি। ফলে ভূতাত্ত্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হয়তো অনেক রাস্তা, বাড়ি নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলো ধসের কবলে পড়েছে।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ হুময়ায়ূন আক্তার স্যারের বর্ণনামতে , “বাংলাদেশের পূর্বাংশে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত টারশিয়ারি যুগের পাহাড়শ্রেণি (হিলরেঞ্জ) পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। এই পাহাড়শ্রেণিগুলো পূর্ব ভারতের মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমার পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমান্তরালভাবে গঠিত হওয়া পাহাড় শ্রেণি ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট এবং সক্রিয় প্লেটের ওপর অবস্থিত। এই পাহাড়ের শিলার স্তরগুলো ঊর্ধ্বভাজ (অ্যান্টিকলাইন) এবং নিম্নভাঁজের (সিঙ্কলাইন) কাঠামো দ্বারা গঠিত। এই স্তরগুলোর মধ্যে শেলপ্রধান, বালুপ্রধান ও শেল-বালুর আন্তস্তরের বিন্যাসের কারণে কিছু অঞ্চল অধিক ভূমিধসপ্রবণ, কিছু মধ্যম ভূমিধসপ্রবণ এবং নিম্ন ভূমিধসপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই শিলাসমূহের মধ্যে তিন ধরনের ছোট-বড় অসংখ্য ফাটল (জয়েন্ট): উত্তর-দক্ষিণ বরাবর, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর এবং আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত। সাম্প্রতিককালের ভূমিকম্পে এই ফাটলগুলো আলগা হয়ে গেছে। প্রতিটি ঊর্ধ্বভাঁজ এক একটি পাহাড়শ্রেণি সৃষ্টি করে। একটি পাহাড়শ্রেণির মধ্যে পাশাপাশি অসংখ্য পর্বত ও উপত্যকা থাকে। পর্বতগুলো প্রতিরোধী শিলা ও উপত্যকাগুলো অপেক্ষাকৃত অপ্রতিরোধী শিলা দিয়ে গঠিত। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এই পাহাড়গুলোর দুটি প্রধান ঢাল-পশ্চিম ও পূর্ব দিকে। স্তরীভূত শিলার ভূতাত্ত্বিক বিন্যাসের কারণে পর্বতসমূহের পূর্ব ও পশ্চিমের উভয় ঢালের মধ্যে নতি-ঢাল বিদ্যমান।”
কোনো একটি কারণে এ রকম ভয়াবহ পাহাড়ধস হয়েছে বলে কেউই মনে করেন না। সবাই বিশ্বাস করেন, এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রাকৃতিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের সৃষ্ট কারণও।

পাহাড়ধস ঠেকাতে করণীয়:

ক) নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ ;
খ)পাহাড়ে ব্যাপকহারে পাহাড়ের জন্য উপযোগী বনায়ন (তাল ও সুপারিগাছ লাগানো);
গ) পাহাড়ের গায়ে থাকা গুল্ম জাতীয় গাছ ও জঙ্গল পোড়ানো বন্ধ করা;
ঘ) জুমচাষে আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার বন্ধ;
ঙ) আর পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা নির্মাণের সময় পাহাড়ের ঢাল কোনোক্রমেই যাতে ৩৫-৪০ ডিগ্রির বেশি না হয়;
চ) পাহাড়ের ঢালে সিমেন্ট ব্লক (শর্টক্রিট) বসানো অথবা ঘাসের আচ্ছাদন লাগানো;
ছ) পাহাড় কেটে সমান করে এবং পাহাড়ের ঢাল ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করা;
জ) পাহাড়ের বেডগুলির নতির দিকে না কাটা;
ঝ) পরিবেশ আইন মেনে পাহাড়ের উপযোগী অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা ;
ঞ) পাহাড়ের অবৈধ বসতি স্থাপন নিরুতসাহিত করার জন্য সেবা সংযোগসমূহ ( বিদ্যুৎ, পানি,
গ্যাস ইত্যাদি) বিচ্ছিন্ন করা ;


ভূমিধসের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে করণীয়

১) পাহাড়ী এলাকায় ভূমিধস ফ্রিকোয়েন্সি এসেস করে এলাকার ভূমিধস প্রবণতা নিরূপন ।
২) মানচিত্রে ভূতাত্ত্বিক জরিপ সম্পাদনপূর্বক নিরাপদ, অনিরাপদ ও অতি নিরাপদ স্থান সনাক্ত করা।
৩) পার্বত্য জেলার প্রতিটি ভূমিকম্প প্রবন এলাকায় ভূমিধস পূর্বাভাস কেন্দ্র প্রতিস্থাপন করা।
৪) জনসচেতনতা সৃষ্টি করা ।
৫) অতিবর্ষনের সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ত্যাগ ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ ।

জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের অর্থ ফেরত: দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যসূত্রমতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ১৮৯ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। প্রতিশ্রুত অর্থের ১৩০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের ফান্ডে জমা পড়ে। কিন্তু জমাকৃত অর্থের ৮৫ মাত্র মিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারে বাংলাদেশ। বাকী ৪৫ মিলিয়ন ডলার এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তহবিলে ফেরত গেছে।

ভূমিধস বেড়ে যাচ্ছে । শুধু বাংলাদেশ নয় সারাপৃথিবীব্যাপী। য্রক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ভূমিধসে অন্তত একজন মারা যাচ্ছে। এবছর সিয়েরা লিওনে মারা গেছে ৪শতাধিক , চীনে মরেছে, শ্রীলংকা ভারতেও প্রচুর লোক মারা গেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ২০১৭ সালে মারা গেছে প্রায় ১৮০ জন। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ভূমিধ্বস রীতিমত আতঙ্ক।

তথ্য সূত্র: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের ভূতত্ত্ববিদ , নেট ও বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:১১
১৫টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×