আজকাল মাথায় নানা রকম বিষয় ঘোরপ্যাঁচ খায়। যেমন; আমি জন্মের আগে দাদা-দাদী কী ভাবছেন; আমি ছেলে হব নাকি মেয়ে হব। নানাজান ভাবার সময় পায়নি । তার আগেই ইন্তিকাল ফরমায়াছেন। নানী হয়ত ভেবে ছিলেন আমি মেয়ে হয়ে জন্ম নিব, তাহলে তার মেয়ে মানে আমার মা’র জন্য সুবিধা হয়। কারণ এর আগে আমার তিন তিন জন ভাই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছেন। এখন সবার প্রত্যাশা আমি মেয়ে হয়েই জন্ম নিব। না, আমি মেয়ে হয়ে জন্মায়নি, ছেলে হয়েছি। বাবা মায়ের কাছে ছেলে মেয়ে মুখ্য নয় কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ্য। তাদের মুখে নানান কথা ঘুরে বেড়ায়। নিজের প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে অন্যের অপ্রয়োজনীয় বিষয় কে অধিক গুরুত্ব দেয়।
আমাদের বড় চাচির পাঁচ পাঁচটি মেয়ে, এ নিয়ে চাচা কিংবা চাচা কে কখনও মন খারাপ করতে দেখিনি। অজান্তে করেন কিনা জানি না। কিন্তু প্রতিবেশীদের এ নিয়ে মাথা ব্যাথার অন্ত ছিল না। দুই তিন জন পাড়া প্রতিবেশী মহিলা এক সাথে হলে রাজ্যের নানান আলাপ আলোচনায় মেতে উঠেন, তার মধ্যে সাংসারিক আলোচনাই বেশী প্রাধান্য পায়। সে সময় চাচি কে অন্য মহিলারা নানা রকম ইঙ্গিতে খোঁটা দিতেন। সব দোষ যেন চাচির! মাঝে মাঝে চাচির মুখখানা কালো হয়ে যেত। তা দেখে আমাদের খুব মায়া হত। কিন্তু বড়দের মুখের উপর কোন কথা বলা উচিত নয় বিধায় চুপ করে থাকতাম। আমার চাচি সব সময় একটি কথা গর্ব করে বলতেন, আল্লাহ আমায় ভালবেসে পাঁচটি মেয়ে দান করেছেন, এই মেয়েগুলো মানুষ করতে পারলে তার বদৌলতে পাঁচটি বেহেস্ত দান করবেন।
জানিনা, এটা চাচীর মনের শান্তনা ছিল কিনা। তবে, তার বড় মেয়ের বিয়ের সময় সেকি কান্না; তিনি কান্নায় বিলাপ করে বলেছেন, আজ আমার ঘরের লক্ষীকে বিদায় করে দিলাম।
সেদিক দিয়ে আমার মা বড় ভাগ্যমান। তার চার চারটি ছেলে। চার ছেলের মা বলে কথা। এ নিয়ে মাকে কখনও বড় গলা করতে দেখিনি। আমাদের সাথে চাচাদের ছিল পারিবারিক দ্বন্দ, জায়গা জমি নিয়ে দ্বন্দ কিন্তু কখনও যদি চাচা-চাচি কিংবা চাচাত বোনদের নামে কোন কথা বলতাম তাহলে মা বলতেন, ওর মায়ের পেটের ভাই নেই, তোরাই ওর ভাই। মাঝে মাঝে দু’পরিবারের মধ্যে ছোট খাট বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হত, ফলে বাবা-মায়ের সাথে চাচা-চাদিদের মুখ বিনিময় কিছু দিন বন্ধ থাকলেও পরিবারের ছেলে সন্তানদের উপর এর প্রভাব পড়তে না। বাবা মাঝে মাঝে চাচাত বোনদের এমনভাবে আদর করত তা দেখে আমাদের হিংসা হত, যেন ওরাই সব আমরা কিছু না। আর বোনগুলো একটু বড় হওয়ার পর তাদের মায়ের থেকে আমাদের মায়ের কাছে বেশী সময় ব্যায় করেছে। মায়ের সাথে সারাদিন এটা ওটা কাজ করত। কোথাও গেলে মা তাদের সাথে করে নিয়ে যেতেন। নানু বাড়িতে আমাদের চাইতে তারা বেশী গেছে। এখন বুঝেছি মা-বাবাও তাদের সংসারে একজন মেয়ের অভাব অনুভব করতেন। এই অভাব হয়ত তাদের মাঝে মাঝে পীড়া দিত। হয়ত আফসোস করত। কিন্তু সেটি কি চাচা-চাচীর থেকে বড়? চাচাও আমাদের ভাইদের কে সন্তানের মত আগলে রাখতেন। হয়ত তার জন্ম না দেয়া ছেলের স্বাদ আমাদের কে দিয়ে মিটাতেন। প্রকৃতি মানুষের আশা অপূর্ণ রেখে দেয়। এটা না করা হলে মানুষ প্রকৃতিকে ভুলে যাবে। নিশ্চয় চাচী ছেলের সন্তান জন্ম দিতে পারেনি বলে সারা জীবনের আক্ষেপ নিয়ে পর পারে চলে গেছেন। সেই সময়ে ব্যক্তি বা সমাজের দায়িত্ব ছিল সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হব- তা পিতার উপর নির্ভর করে এই তথ্যটি জানানো। এবং কন্যা কিংবা পুত্র সন্তানের জন্য গর্ভধারণের বিষয়টি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত বিষয়। তারা বিজ্ঞানে জটিল (গ্রামের মহিলাদের জন্য) বিষয়টি বুঝাতে পারতেন;
মানুষ তার যৌন প্রজননের সময় অর্ধেক এক্স ক্রোমোজোম এবং বাকি অর্ধেক ওয়াই ক্রোমোজোম বহন করে। এই পদ্ধতিতে একটি এক্স ক্রোমোজোম এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম মিলিতভাবে ভ্রনের লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে ওয়াই ক্রোমোজোমে কিছু জিন থাকে যা ভ্রুণে পৌরুষত্ব্য সৃষ্টি করে। তাই যদি ভ্রুণে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম থাকে তবে সন্তানে পুরুষ চরিত্রের অর্থাৎ ছেলে হবে এবং যদি ভ্রুণে দুইটিই এক্স ক্রোমোজোম থাকে তবে ভ্রুণ নারী হবে অর্থাৎ মেয়ে হবে। অথবা, বিষয়টি এভাবে বুঝাতে পারতেন, মায়েদের সেক্স ক্রমোজম থাকে XX আর বাবাদের XY ধরণের। মায়েদের ডিম্বানু তে থাকে শুধু X আর পুরুষের শুক্রানু তে থাকে X অথবা Y ক্রমোজম।
X শুক্রানু ডিম্বানুকে নিষিক্ত করলে মেয়ে (XX) আর Y শুক্রানু ডিম্বানুকে নিষিক্ত করলে ছেলে (XY) সন্তানের জন্ম হয়।
হয়ত বিজ্ঞানের ছোট এই বার্তাটি চাচীকে দায়মুক্তি নিয়ে মড়তে সাহায্য করতে পারত। শান্তণা এই যে, চাচী-চাচীর দাপত্য জীবনে কোন দিন অসুখী দেখিনি আর চাচাকেও কোন দিন চাচীর প্রতি অবমূল্যায়ন কিংবা নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। কিন্ত যে পাঁচটি বেহেস্তের আশা নিয়ে চাচী মৃত্যু বরণ করেছেন সে আশা নিশ্চয় খোদা পূর্ণ করে দিবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:০৯