তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, বয়স চৌদ্দ কি পনের হবে। এ বয়সে পৃথিবীর রঙ্গিন রুপটা আসল চেহারায় ধরা দেয়। কাছাকাছি সব মানুষের সাথে ভালো সম্পর্কে গড়ে উঠে। সে সময় আমাদের বাড়ির পাশে একটি একটি নদী ভাংগা পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সে পরিবারে আমার সমবয়সী সাদিক নামে একটি ছেলে ছিল। তার পুরো নাম ছিল আবু বক্কর সিদ্দিক। আমরা তাকে সংক্ষেপে সাদিক বলে ডাকতাম। সাদিকের আট নয় বছরের ছোট একটি বোন ছিল, নাম ছিল মরিয়ম।
অল্প কয়েক দিনের ভিতরে সাদিকের সাথে আমার ভালো বোঝাপড়া হয়ে গেল।স্কুল বন্ধুদের বাহিরে সে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। তার অত্যাধিক সাহস ও দূরন্তপণার কারণে আমার অন্যান্য বন্ধুদের নিকটেও সে অল্প সময়ে প্রবেশ করতে পেরেছিল। সকাল বেলা আমরা যখন ঘুম থেকে উঠে আরবী এবং স্কুলের পড়া ঝালাই করে নিতাম তখন সে তার বাবার সাথে মাছ ধরতে যেত। তার বাবার মই জাল (মাছ ধরার এক প্রকার সূতা দিয়ে বোনা জাল, যার গঠন আকৃতি অনেকটা মইয়ের মত) দিয়ে মাছ শিকার করতেন। সাদিক ডোলা (মাছ, ধান ইত্যাদি রাথবার জন্য চাঁচারি-হোগলা ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত আধার বা ভান্ড) রাখত। আমাদের স্কুলে যাবার সময় হলে সাদিক মাছ ধরে ফিরত। মাছ যখন ডোলা থেকে ডালায় কিংবা খাঁচিতে ঢালা হতো তখন আমরা দৌড়ে তাদের বাড়িতে হাজির হতাম। তাদের জালে শিকার করা মাছের মধ্যে নব্বই ভাগ ছিল চিংড়ি, অন্যান্য প্রজাতি মাছের মধ্যে যেমন; ছোট জাতের বাইন, পুঁটি, টেংরা, কাইক্কা ও কাঁকড়া ইত্যাদি থাকত। মাছ থেকে আবর্জনা বেঁছে পরিস্কার করা হত বাজারে বিক্রি করার জন্য। তখন কাঁকড়ার বাচ্চাগুলো অহেতুক ছুটাছুটি করত পূর্বের পরিবেশ ফিরে পাওয়ার আশায়। আমরা কাঁকড়ার বাচ্ছাগুলো নিয়ে খেলা করতাম। সাদিকের শরীল নদীর পানিতে দীর্ঘক্ষণ ভিজার কারণে ত্বকের অংশ বিশেষ খানিকটা ফ্যাকাসে দেখাত। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে রোদে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে এবং সাদিকের মা’ সরিষার তেলের বোতল এগিয়ে দিতেন শরীলে তেলে মেখে ত্বক কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারতাম না, কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাকা পড়ত স্কুলে যাওয়ার জন্য।
স্কুলের আঙ্গিনায় সাদিকের মত বন্ধুর অভাব আমরা সর্বদা অনুভব করতাম। কিন্তু সাদিকের ভাগ্য খারাপ, নদী ভাঙ্গনের পূর্বে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার বাবার জায়গা জমি নদীতে গ্রাস করার কারণে এখন বাবার সহযোগী হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। সন্ধ্যার পর আমি যখন বই পড়তে বসতাম তখন সাদিকে আমার পাশে বসে থাকত এবং মনে মনে অস্ফুট স্বরে কি জানি আওড়াত । পড়া লেখায় ডিস্টার্ব হবে বিধায় প্রথম অবস্থায় মা রাজি ছিলেন না, সে আমার পাশে থাকুক। কিন্তু সাদিক আমার পড়ার সময় কোন কথা বলত না। তবে মাঝে মাঝে ক্লাসের পাঠ্য বই গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করত। এবং খাটে শুয়ে বাংলা সাহিত্য ও কিছু গল্পের বই পড়ত। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের পরিবারের সাথে সহজে মিশে গেছে।
সাদিক বিকাল বেলা আমাদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট খেলত। ফুটবলে তার দূর্দান্ত গোলগুলো ছিল মনে ধরার মত। ক্রিকেটে ওপেনিং ব্যাটসম্যান কাম ওপেনিং ফাস্টবল বোলার ছিল। তার বলে যেরকম ছিল বাউন্স এবং সেরকম ছিল গতি। নিজেদের মধ্যে খেলা হলে সবাই চাইত তাকে যেন মোকাবেলা করতে না হয়। কিন্তু অন্য পাড়ার সাথে খেলা হলে সাদিক সব সমময় ফার্স্ট চয়েজ থাকত। অন্য পাড়ার সাথে খেলা থাকলে যদি কোন কারণে সাদিকের মাছ ধরা থেকে ফিরতে দেরি হত, তাহলে আমারা বিভিন্ন অজুহাতে খেলা শুরু করতে দেরি করতাম। প্রতিপক্ষ তখন বুঝে যেত আমরা কেন এমন নাটক করছি।
দেখতে দেখতে সাদিকের সাথে দুই বছর সময় পার করেছি। ইতোমধ্যে শীত এসে গেছে। তার মায়ের পুড়ানো দিনের কি যেন রোগ বেড়ে গেছে। মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার বাবা দেনায় ডুবে গেছেন। শীতকাল হওয়ার কারণে তার বাবা আগের মত নদীতে মাছ ধরতে পারছেন না। কেন জানি মাছও আগের মত নদীতে পাওয়া যায় না। ফলে সংসারের মৌলিক চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায়। এনজিও এবং দেনাদারদের অব্যাহত তাগাদার কারণে তাদের পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে।
ঠিক ওই সময় সাদিকের ছোট মামা সাদিক কে ঢাকা নিয়ে যায় কাজে লাগানোর জন্য। যাওয়ার সময় তাকে আড়ালে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি, হয়ত চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি ফেলেছে। আমরা লঞ্চ পর্যন্ত তার সাথে গিয়েছিলাম। সে ঢাকা যাওয়া পর অনেক দিন তার সাথে যোগাযোগ ছিলনা। আমরা সবাই পড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে বন্ধুরা আড্ডায় কিংবা মাঠে গেলে সাদিকের কথা খুব মনে পড়ত। আমরা তার কথা ভেবে মন খারাপ করতাম।
এবছর শীতে সাদিকের মায়ের অবস্থা একে বারেই খারাপ হতে থাকে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি তাদের বাড়ি থেকে বিলাপ করে কান্নার আওয়াজ আসছে এবং কিছু মানুষের জটলা। আওয়াজের ধরণ দেখে বুঝতে বাকি নেই যে সাদিকের মা আর বেঁচে নেই। মরার আগে নাকি সাদিক কে খুব দেখতে চেয়েছিল, মাথায় হাত রেখে একটু আদর করতে ছেয়েছেন। কিন্তু তার মায়ের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। পাড়ার মুরুব্বিরা বাজারের গণ কবরাস্থানে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। সাদিকের কাছে মায়ের মৃত্যুর খবর পৌঁছাতে দুই দিন লেগে গেছে। তৃতীয় দিনের মাথায় সাদিক বাড়ি ফিরলে আমরা যে যেভাবে পেরেছি তাকে শান্তনা দিয়েছি। তার মাতৃ বিয়োগ কষ্টের কারণে ঢাকাতে কিভাবে আছে, কেমন আছে তা আর জানার সাহস হয়নি। কিছুদিন পর মা আমাকে জানালেন সাদিক ঢাকা চলে গেছে। যাওয়ার সময় আমাকে খুঁজে ছিল। আমি সে সময় স্কুলে ছিলাম।
সাদিকের পরিবারটা একেবারে নিঃশ্ব হয়ে গেছে। তার বোন মরিয়মের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ইদানিং মরিয়ম ঠান্ডা জনিত রোগে ভুগছে, কিন্তু তার বাবা টাকার অভাবে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। ফলে যে রোগ পাঁচ দিনে সাড়ার কথা সেটি পঁচিশ দিনেও সাড়েনি। মরিয়ম পৌষ মাসের হিম শীতল বাতাসে থরথর কাঁপলেও তার বাবা একটি গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। যখন ঠান্ডায় রক্তে জমে যাওয়ার উপক্রম হত তখন তার বাবা উঠানের মাঝে খেড়কুটা জ্বালিয়ে রক্তের চাঞ্চল্যতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতেন। তবে সাদিকের বাবাকে কখনো শীতে কাঁপতে দেখিনি। তার শীত মোকাবেলা করার একটি মোক্ষম অস্ত্র ছিল, সেটি বিড়ি। শীতের সময় তাকে ঘনঘন বিড়ি ফুকতে দেখতাম। আমার মাথায় আসত না বিড়ির মাথায় ওইটুকু আগুনে এত বড় শরীলের শীত নিবারণ কিভাবে সম্ভব হয়! তিনি বিড়ি ধরিয়ে মুখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মুখ ও নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেন। মাঝে মাঝে ধোঁয়া দিয়ে একা একা বিভিন্ন কসরত দেখাতেন। এ সময় সংসার ও পরিবারের চিন্তা তাকে স্পর্শ করত না।
আমরা বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে মরিয়মের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং বাপ ও মেয়ে কে গরম কাপড় কিনে দিব। সবাই মিলে চাঁদা দেয়ার ফলে অনেক টাকা উঠেছিল। আমরা সেই টাকা দিয়ে গরম কাপড় কিনেছি এবং কেনার পরেও অনেকগুলো টাকা হাতে ছিল যা দিয়ে মরিয়মের অনায়াসে চিকিৎসা করা যাবে এবং কিছু টাকা বেঁচে থাকবে। পরদিন সকালবেলা আমরা যখন সাদিকদের বাড়িতে গেলাম গরম কাপড় এবং নগদ টাকা তোলে দিব, তখন সম্ভবত আরো বেশী কষ্ট পেয়েছি। গিয়ে দেখি তাদের বাড়ী ফাঁকা। ঘরে কেউ নেই। অনেক খোঁজাখোজি করেও আর তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের এলাকা ছাড়ার খবর চাউর হয়ে গেছে। এতে পাওনাদার এবং কিস্তির অফিসারগণ বাড়িতে এসে হাজির। সবাই বাড়ির মালামালের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। কিন্তু ঘরে টিনার চালা ছাড়া উল্লেখ করার মত কিছুই ছিল না। শেষ পর্যন্ত সাদিকের পরিবার কে অকাথ্য ভাষায় গালাগালি করে সেগুলোও মহাসমারোহে খুলে নিয়ে গেছে। আমরা বন্ধুরা সেই দৃশ্য বুকে কষ্ট নিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম।
পরে বাড়িতে এসে মায়ের কাছে জানতে পারি, সাদিকের বাবা এবং তার বোন সুদের পাওনাদার এবং এনজিওদের অব্যাহত চাপের কারণে রাতের আঁধারে পালিয়ে শহরে চলে গেছেন। এবং যাওয়ার সময় চুপি চুপি আমাদের বাড়িতে এসে বলে গেছেন; ‘সাদিক একদিন বড় হয়ে পাওনাদার এবং এনজিওদের সব ঋণ পরিশোধ করে দিবেন। কিন্তু তার কষ্ট এই যে, সাদিকের মা’কে দূরদেশে একলা কবরে রেখে যেতে হচ্ছে!
গতকাল মা আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, সাদিক আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। এক যুগের তিক্ত স্মৃতিকে পিছনে ফেলে সব কিছু নতুন করে শুরু করবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৭ ভোর ৬:২০