আমি সময় পেলেই হাঁটি। হাটতে আমার ভালো লাগে। আমাদের বাড়ির পাশেই বাজার, বাজারের সাথে স্কুল এবং তার অল্প কিছু দূরে মেঘনার শাখা নদী। পূর্বে পাশে বিশাল বিল। এই বিলের সর্বশেষ মাথা এসে ঠেকেছে আমাদের বাড়ির কাছে। ন্যাংটাকালে এখান থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালে শুধু শস্য ক্ষেত ছাড়া কিছুই দেখা যেত না। পূর্ব দিকে প্রায় দুই ঘন্টা হাটলে মূল মেঘনা নদীতে যাওয়া যেত। এখন বিলের মাঝে বাড়ি ঘর উঠেছে এবং কোথাও কোথাও চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করে বার্লিন দেয়ালের মত আলাদা আলাদা স্টেট তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিক এই অবকাঠামো কারণে আমাদের এলাকায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। ফলে বাধ্য হয়ে ছোট বেলায় হাটতে হয়েছে প্রচুর। বাড়ির পাশে বাজার এবং স্কুলের মাঠ থাকার কারণে শৈশব কেটেছে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলে। এখনো গ্রামে গেলে জুনিয়র পোলাপাইনের সাথে ফুটবল ক্রিকেট খেলি। খেলায় দৌড়ের গতি কিছুটা কমলেও পোলাপাইনের সাথে তাল মিলাতে তত একটা সমস্যা হয়না।
2014 সালের শুরুতে কপালের ফেরে ঢাকা চলে আসি। ঢাকাতেও সময় পেলে হাটি। দশ বিশ টাকার রিক্সা ভাড়া হেঁটে পকেট ভাড়ি করছি। রিক্সাওয়ালা যখন বলে, মামা যাইবা? তখন আমি মাথা ঝুলিয়ে ‘না’ সূচক জবাব দেই আর মনে মনে হেসে উঠি। যাক; আমিও তাহলে মানুষ কে বঞ্চিত করতে পেরেছি।
অফিসে দুপুরে খাওয়ার পর পাঁচ দশ মিনিট না হাটলে আমার ভালো লাগেনা। হাঁটার সময় ভালো করে খেয়াল করলে বিচিত্র সব জিনিষ চোখে পড়ে। আপনার চোখ সচরাচর যা দেখে তা যদি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে পৃথিবীটা আপনার কাছে মিনিংলেস মনে হবে। আজকেও বের হলাম কিছুক্ষণ হাঁটব। হাঁটার এক পর্যায়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল। বৃষ্টি নামলে আমার খুব ভালো লাগে। বৃষ্টিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য আমি ভবন বা ঘরের ভিতরে না গিয়ে একটু বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকি, যাতে বৃষ্টির পানিকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এতে করে নিজের ভিতর পরিশুদ্ধ ভাব চলে আসে। আজকে নির্মাণধীন বিল্ডিংয়ের উপরে যে নিরাপত্তা টিনের ছাদ দেয়া হয় সেখানে দাড়ালাম। উপর থেকে ঝপঝপ বৃষ্টির পানি পড়ছে। আমার সাথে আরে দশ-পনের জন লোক সেখানে দাঁড়ানো। দুইজন কে দেখলাম খুব আরাম করে সিগারেট ফুঁকছে। কেউ কেউ ফোনে কথা বলছেন। আমি আকাশ এবং চারিদিক দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির আসল রূপ দেখে নিচ্ছি। আমাদের থেকে খানিক দূরে ফুটপাতের উপর চারদিকে খোলা একটি ফাস্টফুডের দোকান। দোকানের উপর পলিথিনের ছাঁদ দেয়া, যাতে আপাতাকালীন সময় কাজ দেয়। সেখানে কিছু ছেলেকে দেখলাম পিঁয়াজু, সিঙ্গারা এবং কেউ কেউ নুডলস খাচ্ছে। দুপুরে হোটেলে ভাত খেতে গেলে ৯০-১৫০ টাকা লাগে কিন্তু পিঁয়াজু, সিঙ্গারা কিংবা নুডলস খেলে লাগবে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। পিঁয়াজু সিঙ্গারা খেয়েই তারা দুপুরের খাবার পর্বটা চালিয়ে নিবে। তাদের হাতে ফাইল দেখে মনে হলো চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।
রোডে ওপারে একটি ভবনের নিচে গাড়ি পাকিং করার যে প্রবেশ পথ রয়েছে সেখানে তিন চারজন ছেলে মেয়েকে দেখলাম পরস্পর দুষ্টুমি, মাস্তি- মজা করছে। বেশভূষা দেখা মনে হলো উচ্চ বিত্তের সন্তান। দুনিয়ার কোন চিন্তা-চেতনার লেশ তাদের স্পর্শ করেনি। যেন পৃথিবীটা তাদের জন্য পারফেক্ট।
বৃ্ষ্টি কিছুটা কমে এসেছে, দু’চার জন পথচারী রাস্তায় নেমে যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে অর্ধভেজা অবস্থায়। আমার ভিতর তাড়া নেই, তাই মানুষের জীবন যুদ্ধের সাক্ষী হচ্ছি। কিছুক্ষণ পর রাস্তার ওপারে তাকালাম। তাকিয়ে দেখলাম এক বৃদ্ধ মহিলা মাস্তি-মজা করার পোলাপাইনের নিকট হাত পেতে বলছে; বাবা দুপুরে খাওয়ার জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু টাকা দাও। পোলাপাইনের মাস্তি-মজার ভিতরে বৃদ্ধা মহিলাটি ডান হাত দেয়াতে তারা কিছুটা বিরুক্ত হয়েছে। এটা তাদের চেহারায় অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছে। তাদের মধ্য থেকে একজন বলল; খুচরা নেই, অন্য আরেকজন বলল সরকার কিযে করে! আরেকজন বলে উঠল; গুলশান জোনে সরকার ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছে, এটা আপনার জানা উচিত?
মহিলাটি আশাহত হয়ে ফাস্টফুডের দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। সেখানে পিঁয়াজু-সিঙ্গারা ভক্ষনরত চাকুরী প্রত্যাশী ছেলেদের নিকট হাত পাতলেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বৃদ্ধা মহিলার হাতে নুডলসের প্লেট, নুডলসের উপরে ঘরে তৈরি সসের লাল প্রলেপ দেয়া। মহিলাটি চামচ রেখে হাত দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে আমার ভিতর দার্শনিক ভাব চলে এসেছে। কিছুক্ষণ পর মন থেকে একটি কথাই বের হয়ে এসেছে, লেভেল মেনটাইন করে চলতে হয়, না হলে আশাহত হয়ে খালি হাতে ফিরতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৫