সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অফিসের যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে বাচ্ছাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে, পৌছে দিলাম যথারীতি। বর্তমাণে দেশের যা অবস্থা তাতে কখন জানি কি হয়ে যায় তা নিয়ে অভিভাবকদের আতঙ্কে থাকতে হয়। এখন পরিবারের জন্য যুদ্ধ নামার পালা। সড়কে গিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটি বাসে মানুষ বাদুরঝুলা হয়ে আছেন, একটিতেও ভালোভাবে উঠার জো নেই। শেষতক ভিড় ঠেলেঠুলে একটার ভিতর উঠে পড়লাম। উত্তরা থেকে বনানী যেতে হবে। বাসের মধ্যে হাত দুটিকে উঁচু করে দারিয়ে আছি, অনেকটা ফ্রন্ট লাইনে সদ্য পরাজিত সৈনিকের মত। ইউটিউবে সিরিয়ান আসাদ বাহিনীর কিছু সৈন্য কে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির নিকট এভাবে আত্মসর্মণ করতে দেখেছিলাম। আসলে আমরা ঐ সেন্যদের মত, আমাদের সরকার আছে, দেশ আছে, সবকিছু আছে তারপরেও আমরা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কাছে দিনের পর দিন বন্দি হয়ে যাচ্ছি। কন্ট্রাকটর ভাড়া কাটছেন। বাসের গায়ে সিটিং লেখা থাকলেও ভিতরের অবস্থা বাংলাদেশের জেলাখানার মত, যেখানে ধারণ ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত দুই গুণ তিন গুন কয়েদি রাখা হয়, এখানে ঠিক তার অনুরুপ প্যাসেঞ্জার রাখা হয়েছে। এই মহুর্তে নিজেকে কয়েদি মনে হলো।
আমার মাথার নিচে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা বসে আছেন, পরনের বেষভূষা দেখে মনে হলো মধ্যবিত্ত পরিবারের। অবস্থা দেখে মনে হলো, পরিবারের জন্য, স্বামী-সন্তানের জন্য খাটতে খাটতে নিজেকে নিয়ে ভাবার কখনো সময় পাননি। তিনি এখন বাসে মধ্যে নিজেকে নিয়ে ভাবছেন, হয়ত কৈশরে নদীতে ঝপাঝপ ডু দেয়া কিংবা বাড়ির আঙ্গিনায় বৌ-মাছি খেলার কথা ভেবে আবেগতাড়িত হচ্ছেন। মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। মহিলাটির ভাগ্য ভালো তিনি সিট পেয়েছেন। আমি মানিব্যাগ আর মোবাইলের হেফাজতে নিজেকে তটস্থ রেখেছি। তার হয়ত সন্তানের বয়সী প্যাসেঞ্জার কে দাড়িয়ে যেতে দেখে মায়া হলো। আমাকে কাছে পেয়ে বলল, বাবা আমি খিলখেত নেমে যাব, তুমি আমার সিটে বসবে। আমি ‘জি’ বলে তার সাথে বাক্য আলাপের লাইন কেটে দিলাম। কন্ট্রকটর ভাড়া নিচ্ছেন, গায়ে সিটিং লেখা তাই সিটিং ভাড়া উঠাচ্ছেন। বিষয়টি কেউ কেউ বিনা বাক্য মেনে নিলেও অনেকে অতিরিক্ত প্যাসেঞ্জার উঠানোর কারণে ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। এনিয়ে প্যাসেঞ্জার বনাম কন্ট্রকটরের মধ্যে উচ্চ ভলিউমে কিছুক্ষণ গলার এক্সারসাইজ হয়ে গেল। তারপর সব চুপ। আমাদের দৌড় ঐ পর্যন্ত।
বাস এয়ারপোর্টের সিগন্যাল ছাড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস ভেদ করে দ্রুত খিলখেতের দিকে ছুটে চলছে। কিছুক্ষণ পর কাওলা পার হয়ে খিলখেত ফুট ওভার ব্রিজের নিচে থামল। মহিলা নেমে যাওয়ার সময় হাতে ইশারা করে বসতে বললেন, আমি ধপাস করে ছিটের মধ্যে বসে পড়লাম। ঢাকা শহরে পাব্লিক পরিবহন থেকে মানুষ নামার আগেই উঠা শুরু করে দেয়। হেলপার কিছুক্ষণ পর পর বাসের দরজায় থাপ্পর দিয়ে গলায় হাঁক ছাড়ছেন ‘মহিলা সিট খালি নাই’, উদ্দেশ্য কোন মহিলা যাতে না উঠেন। কিন্তু অনেক মহিলা বাসে উঠার জন্য চেষ্টা করছেন। অনেকে ঠায় দাড়িয়ে আছেন পরবর্তী বাসের অপেক্ষায়। বাস থেকে যতজন মানুষ বাস নেমে গেছে তারচেয়ে বেশি মানুষ মহুর্তেই উঠে গেল। সাথে দুই মহিলাকেও দেখলাম অনেকটা জোড় করে উঠতে। তারা পুরুষের মাঝে কোন রকম জড়সড় হয়ে দাড়িয়েছে। সিট খালি নাই কিন্তু কেন তাদের উঠানো হলো এ নিয়ে দু’একজন প্যাসেঞ্জার কে দেখলাম হেলপার কে দোষারোপ করতে! আমি যা বুঝলাম, এ মহিলারা সময় মত অফিসে যেতে না পারলে হাজিরা থেকে একটি নির্দিষ্ট মাইনে কাটা যাবে, সাথে বস নামক আজব প্রাণীগুলো থেকে দু’চারটি ঝাড়িও খেতে পারেন!
আমি উঠে দাঁড়িয়ে একজন কে বসার অফার করলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বসে পড়লেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। আমার দেখাদেখি পাশেরজন উঠে দাঁড়ালেন এবং অপর মহিলাকে বসার জন্য অনুরোধ করার সাথে সাথে তিনি সিটে বসে গেলেন।
বাস চলছে। কতগুলো গন্ডারের চামড়াওয়ালা মানুষ বসে ও দাড়িয়ে আছে। কেউ কেউ একে অপরের সাথে টুকটাক আলাপ-সালাপ করছেন, অনেকে মোবাইলে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেড়ে নিচ্ছেন। এই মহুর্তে আমার একটি ভিটিওর কথা মনে পড়ে গেল। তাই ইচ্ছা হলো সবাইকে থামিয়ে মোনাজাত ধরি। মোনাজাতে সবাই এক সাথে বলে উঠি-
“হে আল্লাহ্ তোমার কাছে বিচার দিলাম-----”
এখন যা বলার আপনারা মনে মনে বলেন। আজকাল মুখ খুলাও নিরাপদ নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:৩৩