somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ বিকেলে

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বারান্দার চেয়ার বসে আছেন আমিন খা। বয়স সত্তুরের কাছাকাছি, হাতে বেতের লাঠি, চোখে পাওয়ারের চশমা। এই চেয়ারের এক সময় জৌলুস ছিল, পারিবারিক দাপট ছিল, আজ সব অতীত। চেয়ারের সারা শরীল চকচক করত, দেখলে মনে হতো সদ্য তেল মাখানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চেয়ারের হাতল দুটি গুনে ধরেছে এবং তিনটি পায়ার মধ্যে একটি পায়া নড়বড়ে অবস্থা। এই চেয়ারটি তার জীবনের উত্থান পতনের সাক্ষী। আমিন খা এখন নিসঙ্গ জীবন যাপন করেন, যা অতীতে কল্পণা করা যেত না। কি না ছিল তার এই বাড়িতে। বাড়িতে প্রকান্ড উঠান, বড় বড় চার দুয়ারী ঘর, বিশাল গোয়ালা, কয়েকটি শস্যের গোলা, প্রায় বিশ জনের মত কামলা। মানুষ ও ফসলের ভারে সারা বাড়ি গমগম করত। অত্র অঞ্চলের তার সমান কারো জায়গা জমিন ছিলনা। অথচ আজ তিনি নিঃসঙ্গভাবে জীবন যাপন করেন। বাপ দাদার আমললে উঠানো ঘরগুলো এখন ভঙ্গাংশে পরিণত হয়েছে। তিনি যে ঘরটিতে রাত্রি যাপন করেন শুধু সে ঘরটি কোন রকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। মূল বাড়ির অদূরে তার কয়েক ঘর রায়াত আছে।এই রায়াত বাড়ির আম্বিয়ার মা মাসিক 1500 টাকার মাইনে রান্নাবান্না করে দেন।

চেয়ারের বসে আছেন আমিন খা। তিনি বিকাল বেলা এই চেয়ারে বসে প্রকৃতি উপভোগ করেন। সে সময় পাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তার পাশে এসে দুষ্টমি করে। তাদের প্রতি প্রথম প্রথম বিরুক্তি আসলেও এখন তাদের প্রতি অতিরিক্ত মায়া জন্মেছে। মাঝেমধ্যে তাদের কে গাছের ফল খেতে দেন। সময় পেলে খোশগল্প ও দুষ্টুমিও করেন। তার গাছে প্রচুর ফল ফলে, চাইলে তিনি বিক্রি করে প্রচুর টাকা আয় করতে পারেন, কিন্তু অভিজাত্যে আঘাত লাগবে বিধায় করেন না। আজ তিনি বসে আছেন সম্পূর্ণ একা। আশেপাশে কোন পোলাপাইন নাই, তারা স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে গেছে। তাই বিকালটা সম্পূর্ণ একা একা কাটাতে হবে। কিছু ভালো লাগছেনা, কিছুক্ষণ পর পর চেয়ার থেকে উঠে ঘরের ভিতরে যান তারপর আবার বাহিরে আসেন।

চেয়ারে বসে আছেন আমিন খা। বসে বসে ছোট ছেলে মুরাদের কথা ভাবছেন। সে ঢাকার একটি প্রাইভেট স্কুলে আবাসিকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটিও তার মত আপনজন ছাড়া নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। ছেলের কথা মনে হওয়াতে ছেলের মার কথা মনে পড়ে গেল। আমিন খা’র বয়স তখন পঞ্চশ ছুঁই ছুঁই। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুই আগে। অনেক দিন বাড়িতে একা একা থেকেছেন। পরে্ ছেলেরা এসে তাকে ঢাকা নিয়ে যায়। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে তার ভালো লাগত না। আর বউ মা গণ তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। সেজন্য পুনরায় গ্রামে ফিরে আসেন এবং নিঃসঙ্গভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে নিজের মধ্যে খুবই একাকিত্ববোধ করেন। মাঝেমধ্যে রাতে দুস্বপ্ন দেখেন। ভর রাতে অজানা পাখিদের ডাকে বুক ধরফর করে উঠে। রাতের অন্ধকারে চোখের সামনে নানান কিছু ভাসতে দেখেন। একজনে পরামর্শ দিলো নিকাহ করার জন্য! প্রথম অবস্থায় সে রাজি ছিলোনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থা চিন্তা করে বিবাহ করতে সম্মত হন। আর এই বিবাহই তার জীবনে কাল হয়ে দাড়ায়। প্রথম পক্ষের ছেলেরা বিষয়টি ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা এই বিবাহের বিরুদ্ধে বিরুপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং বিবাহচ্ছেদ করার জন্য হুমকি ধামকি দিতে থাকে। ফলে ছেলেদের সাথে তার এক প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

চেয়ারে বসে আছেন আমিন খা। ফলোয়ান এড়াতে টেষ্ট ম্যাচে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তার জীবনে সদ্য বোলিং করতে আসা হোসনা ছিল একজন অভিজ্ঞ বোলার! ইয়রকার, ইনসুয়িং, আউট সুয়িং তার দখলে ছিল। হোসনার এর পূর্বে একটি বিবাহ হয়েছিল এবং সে ঘরে একজন দেড় বছর বয়সী ছেলে সন্তান আছে। তার আগের স্বামী মদ্যপ ও নেশাখোড় ছিল। তাকে প্রায়ই মারধর করত। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়ে তালাক দিয়ে বাপের চলে আসেন এবং শেষে আমিন খা’র ঘাড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাফ ছেড়ে বেচেছেন। অপর দিকে আমিন খা’র প্রথম ঘরের সন্তানেরা বাপের ২য় বিবাহ করা মায়ের সাথে অতিরিক্ত একজন ছেলে সন্তান মেনে নিতে পারেনি। তারা এর বিরুদ্ধে গোপনে কূটকৌশল করতে থাকে। এই কূটকৌশলে আমিন খা’র সরলতা কারণে তারা দ্রুত সফলতার মুখ দেখে। কারণ পূর্বে তার নগদে যা হ্যান্ড ক্যাশ ছিল তা পুত্রদের ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখেন। এমনকি সম্পত্তির অর্ধেক অংশ তাদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। এথন বাকী অর্ধেক হাতিয়ে নেওয়ার জন্য নানামুখী চক্রান্ত করছেন। অপর দিকে হোসনা গরীব ঘরের মেয়ে হলেও খুবই বুদ্ধিমতী ছিলো। সে বুঝতে পেরেছিল বুড়া আমিন খা মরে যাওয়ার পর তাকে রাস্তায় বের করে দেয়া হবে। তাই এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হলো আমিন খা’র ঔরসজাত সন্তান গর্ভে ধারণ করা। এতে স্বামী-সন্তানের অধিকার সমুন্নত থাকবে।

চেয়ারে বসে আছেন আমিন খা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য অস্ত যাবে। তারপর রাতের আঁধার নেমে আসবে। পুনরায় আবার অন্ধকার ভেদ করে সূর্য় আলোকিত করবে গোটা পৃথিবী। তেমনি একদিন হোসনার অন্ধকার গর্ভ ভেদ করে আলোকিত করেছিলো একটি ফুটফুটে সন্তান। এই সন্তানের নাম রেখেছিলেন মুরাদ। মুরাদের আগমনে হেসে উঠেছিল হোসনার মুখ, হেসে উঠেছিল এ বাড়ির প্রতিটি বালুকণা। কিন্তু অন্তরে রক্তক্ষরণ করেছিল আগের ঘরের সন্তানদের। তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। সদ্য জন্ম নেয়া নতুন ভাইকে তারা কিছুতেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলোনা। এতে তারা ষড়যন্ত্রের জাল দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে। এভাবে দিন চলে গিয়ে বছর আসে….। তারপর পাঁচ বছর অতিক্রম হলে এক দিন আমিন খা তার কণিষ্ঠ পুত্রকে শিুশু শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। মনে হয় বৃদ্ধা বয়সের সন্তান লাভ মনের ভিতর আলাদা আনন্দ ও গুরুত্ব বহন করে। মুরাদের প্রতিটি কদমের হিসাব তার বাবা মায়ের মুখস্ত ছিলো। একদিনকার ঘটনা- হোসনা গোলা ঘরের মটকা পরিস্কার করতে ছিলেন। মটকার ভিতরে হাত দেয়ার সাথে সাথে ভিতর থেকে জাতি সাপ সামনের দুটি দাঁত বসিয়ে দেয়। হোসনার আর্তচিৎকারে মানুষজন এসে প্রথমে উপজেলা সদরে প্রেরণ করেন, সেখানে ভ্যাক্সিম না থাকার কারণে জেলা সেদরে প্রেরণ নিয়ে যান, কিন্তু ততক্ষণে সমস্ত শরীল বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যায়। ফলে মুখ দিয়ে লালা ও বমি করে পরপারে চলে যান।

হোসনা চলে যাওয়াতে আমিন খা মানুষিক আঘাতে ভেঙ্গে পড়েন এবং সেন্সলেস হন। প্রথম ঘরের সন্তানরা এসে তাকে ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেখানে প্রায় তিন মাস ভর্তি থাকেন। তারপর গ্রামের বাড়িতে পুনরায় চলে আসেন। বাড়িতে এসে তিনি এক নিকট আত্মীয়ের মাধমে জানতে পারেন, ঢাকায় অসুস্থ্যকালীন থাকা অবস্থায় প্রথম ঘরের সন্তানেরা কৌশলে বিলের জমি নিজেদের নামে করে নিয়েছে। এতে তিনি আরো শকড হন। আবার জীবন দশায় পরপর দুই বউ মারা যাওয়াতে পাড়ায় মানুষ নানা কথা বলে বেড়াতে থাকে। এরই মাঝে হোসনার আগেরকার স্বামীর সন্তান তার নিজ বাপের বাড়িতে চলে যায়। এখন শুধু শেষ আশা ভরসা বলতে কণিষ্ঠতম পুত্র মুরাদ রয়েছে। তাই মুরাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে ঢাকার একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। তাপরপর স্ত্রীদের কবর ও নিজের স্থায়ী ঠিকানা ধরে রাখতে ভিটাবাড়িটি মুরাদের নামে নিখে দেন।

চেয়ারে বসে আছে আমিন খা। মাগরিবের আযান চলছে, এখন তিনি অযূ করে নামাজ পড়তে যাবেন। তার আগে পাশাপাশি শায়িত দুই স্ত্রীর কবরের পাশে গেলেন। কবরের উপর ঝড়া পাতার স্তুপ জমে আছে। সেখান থেকে দুটি ঝড়া পাতা হাতে নিলেন, তারপর কতক্ষণ কি যেন ভাবলেন। অতঃপর নিজে নিজের সাথে বলে উঠলেন, প্রিয়তমারা, একটু ধৈর্য ধর, তোমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলল। তোমাদের দেখাদেখি আমিও একদিন ঝড়া পাতা হয়ে যাব। তোমাদের সানিধ্যে আজীবন ঝড়া পাতা হয়ে থাকব। তখন কি তোমরা দু’জন মিলে আমার সাথে জগড়া করবে? একটু জগড়া....।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৪
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×