আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। অবশ্য প্রতিদিনই তাকাই কিন্তু কখনো এই বিষয়টা গভীরভাবে খেয়াল করা হয়না। মেইন রোডের পাশেই আমার বাসা। রোডের উপর কতগুলো মানুষ দাঁড়িয়েছে। বাস যেখানে থামবে মানুষজন অনুমান করে তারো আগে দাঁড়িয়েছে যাতে তাড়াতাড়ি বাসে উঠা যায়। এই মানুষের তালিকায় গুড়া থেকে বুড়া (সব বয়সী মানুষ) পর্যন্ত আছে। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পরপর একটা বাস আসার সাথেই মানুষজন হুমড়ি খেয়ে বাসের দরজায় গিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। বাসে উঠার জন্য এ এক ভীষণ যুদ্ধ। মহিলারা এগিয়ে আসে বাসের উঠার জন্য কিন্তু পুরুষদের ধাক্কাধাক্কি জন্য তারা বাসের কাছে ঘেঁষতে পারে না। ফলাফলঃ পরেরটার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় নাই। এই মহিলাদের কারো মুখে এখনো ঘুমের ছাপ আছে। হয়ত কাল অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করে বাড়ি ফিরেছেন। রান্না বান্না করে খেতে অনেক রাত হয়েছে। সকালবেলা অফিস ধরার তাড়া তাকে খুব ভোড়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। ঠিক সময় অফিস যেতে না পাড়লে বসদের কথা শুনা লাগবে। অফিসে পৌছাতে দেরি করার কারণে বসদের কড়া কথা মহিলাদের অনেক দিন শুনতে হয়ছে। অনেকের ইচ্ছে হয়েছে চাকুরী ছেড়ে দিবে কিন্তু স্বামীর যা ইনকাম এবং ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচের হিসাব করে চাকুরিটা ছেড়ে দেয়া আর হয়নি।
আমরা হয়ত আর্থিকভাবে কচ্ছপ গতিতে দিন দিন উন্নত হচ্ছি, কিন্তু আমাদের সার্বিক উন্নতি হচ্ছে না। দেশের প্রধান সমস্যাগুলো আসল জায়গায় বরাবরের মতই থেকে যাচ্ছে।
হাটা আমার সখ। সময় পেলে আমি প্রায়ই হাটি। হাটলে বিচিত্র জিনিষ চোখে পড়ে। আজ দুপুরবেলা গুলশান এভিনিউতে হাঁটতে ছিলাম।রাস্তায় শতখানেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুইজন মানুষের মধ্যে সংঘটিত মারামারি দেখছে। কেউই এগিয়ে যাচ্ছেনা তাদের কে নিবৃত্ত করতে। যারা মারামারি করছে তাদের মধ্যে একজনের বয়স আঠারো থেকে বিশ বছর এবং অপরজন সাতাই থেকে আঠাইশ হবে। আমি সাহস করে রাস্তায় নেমে গেলাম এবং তাদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলাম। আমার দেখাদেখি আরেকজন ইয়ংম্যান নেমে আসলো। তারপরে আরো দুই তিন জন। সবাই এক সাথে চেষ্টা করার পর তাদের হাত এবং পা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল; কিন্তু দু’জনের মুখ তখনো সমান তালে চলতে ছিলো। উপায় না দেখে তখন আমি হাতের জামা ঘুটাতে ঘুটাতে বললাম এবার দুটাকেই আস্ত বানাব! তখন তারা একেবারে চুপ হয়ে গেল। তারা হয়ত ভেবেছিলো আমি গুলশানের মাস্তান টাইপের কেউ হবো। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত লোকজন তাদের কে জেরা শুরু করল, কেউ কেউ নিক্তি দিয়ে দোষের পাল্লা মাপা শুরু করে দিল। আঠার বাইশ বছরের ছেলেটা নরম সূরে জানালো তিনি পার্শ্ব রাস্তা থেকে মেইন রোডে মাইক্রোবাস নিয়ে উঠার সময় একটি মটর সাইকেল এসে তার গাড়ির গায়ে ধাক্কা লাগে। এতে মটর সাইকেল ও তার আরোহীর তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও মটর সাইকেলের ড্রাইভার রাস্তায় নেমে এসে তাকে চটাস করে গালে এক চড় বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে সেও (মাইক্রোবাসের ড্রাইভার) রাস্তায় নেমে এসে রেসলিং খেলা শুরু করে দেয়। তাদের কথা শুনে আমি মটর সাইকেলের ড্রাইভার কে বললাম, At first you made a mistake by hitting him. Do you understand? মটর সাইকেল ড্রাইভার চুপ হয়ে গেল।
বাঙ্গালি সব সময় মজলুমের পাশে থাকে। যখনি শুনেছে মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মটর সাইকেলের ড্রাইভার কে আগাম সংকেত না দিয়ে আঘাত করেছে, তখনি আঘাতপ্রাপ্ত ড্রাইভারের প্রতি সবাই সহানুভূতি দেখানো শুরু হয়েছে। কেউ কেউ মুখ দিয়ে মটরসাইকেল চালকদের চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করছে। এতক্ষণে পুলিশের একটি টহল দল ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলো। প্রথমে তারা জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝার চেষ্টা করে মটরসাইকেল ড্রাইভারকে শাসাতে লাগলো, গ্রেফতারের হুমকি ধামকিও দিলো, সাথে এটাও বললো সব কিছু সিসি ক্যামরায় রেকর্ড করা হচ্ছে। এবার ড্রাইভার ব্যাটা একেবারে চুপসে গিয়ে কাচুমাচু করে পুলিশের কাছে মাপ চাইল। আমি মনে মনে হেসে বললাম, দোষ করলি কার সাথে আর মাপ চাও কার কাছে! হায়রে দুনিয়া। পুলিশ এত সহজে কাউকে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। তারা মটর সাইকেল থানায় নিয়ে যেতে চায়। শেষমেষ একজন পুলিশ কে মটর সাইকেল ও তার ড্রাইভার সহ থানায় পাঠানো হলো!
কি ভাবছেন, পুলিশ এখানে মহৎ কাজ করেছে? মোটেও না। পুলিশ হয়ত লোকটিকে থানায় নিয়ে আইন ভাঙ্গার অযুহাত দেখাবে, জনগণের রোষাণলের থেকে উদ্ধারের জন্য টাকা চাইবে। টাকা না দিলে মারধরের ভয় দেখাবে, কোর্টে চালানের কথা বলবে, নয়তবা ইয়াবা দিয়ে ফাসানো হুমকি ধামকি দিবে। শেষ পর্যন্ত লোকটি ভয়ে পাঁচ হাজার থেকে বিশ হাজার টাকা দিয়ে রফাদফা করে শেষে বাড়ি ফিরবে। পকেটে টাকা না থাকলেও বিষয়টি ফোনে পরিবার কে বললে মহুর্তের মধ্যে টাকা পঁয়সা ম্যানেজ করে পরিবারের লোকজন থানায় এসে হাজির হবে।
আমরা দিন কে দিন অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারলেও সামগ্রিক উন্নতি করতে পারছিনা। আমরা হয়ত সহজে আর মানুষ হচ্ছি না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৭:১৩