জীবনের অত্যন্ত সংবেদনশীল একটা সময় কেঁটেছে আমার বিষন্নতায়; যে বিষন্নতাকে ব্যাখ্যা করা যায়না, ধরা যায়না আবার অগ্রাহ্য ও করা যায়না। নেতিবাচক শব্দ হিসেবে পরিচয় ঘটলেও ‘বিষন্নতাকে’ বরাবরি আমি উপভোগ করেছি, জীবনের অসংখ্য জটিল সমস্যার সুন্দর সমাধান আমি খুজে পেয়েছি বিষন্ন অবস্থায়।
সময়টা ২০০০-২০০১ সাল। কদিন আগেই বাবা মারা গেছে। প্রায়ই স্ব্প্নের মাঝে বাবাকে ফিরে পাই, স্বপ্ন শেষ হলে বাবাকে আবারো হারিয়ে ফেলি। অভিমানে গলা ধরে আসে, নিজের উপরই রাগ হয় নিজের বোকার মতোন্ চিন্তা-ভাবনায়। কাউকেই বুঝতে দেইনা আমি বোকা। সারাদিন বুদ্ধিমান সেজে ঘোরাঘুরি করার চেষ্টা করি। রাতে আবারো বোকা বনে যাই।
এর মাঝে আমার এস.এস.সি. পরীক্ষা শেষ হোল। নিজেকে আবিষ্কার করি অখন্ড অবসরের মাঝে। কিছুই করার নেই সারাদিন। বাবা মারা যাওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলাম, আবার বাসাতে ও ভাল লাগে না। অস্থিরতায় কাটতে থাকে সময়। ভাইয়ার সাথে বাবার ব্যবসার এক-আধটু বোঝার চেষ্টা করি, আর উদাস-উদাস ভাব নিয়ে থাকি। ত্রাণকর্তা রুপে আবির্ভূত হয় খালাতো ভাই মঈন আর বন্ধু নোবেল।
মঈনের বয়স আমার কাছাকাছি হলে ও অভিজ্ঞতায় নিশ্চিতভাবেই সে ছিল আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে। কি করলে গাছে ফল বেশি ধরে, কিভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হওয়া যায়, যে কোন পরিবেশে কিভাবে ভাবলেশহীন থাকা যায়, মানব সম্পর্কের মাহাত্ম্য কি, এসবের কোন কিছুই সে আমাকে শেখাতে বাদ দেয়নি। আমার সে সময়কার সুপার হিরো ছিল আমারই সমবয়সী এই খালাতো ভাই। হেন কোন বিষয় নেই যে সে জানেনা, আর আমি ও চোখ বড়-বড় করে সেসব গিলতাম।
অন্যদিকে নোবেল ছিল উল্টো ক্যারেক্টার; আমার চাইতে ও নবিশ। এস.এস.সি পরীক্ষার এই বিশাল অবসরে সে শুধু উপন্যাস গিলছে। একটা শেষ তো আরেকটা শুরু হচ্ছে, কোন বিরতি ছাড়াই। খুব বিরক্তি নিয়েই বোঝার চেষ্টা করলাম কি গিলছে। ঐ যে শুরু, তারপর আর আমি ও বিরতি নেয়ার সময় পেলাম না। সমরেশের গর্ভধারিণী পড়ে জয়িতার প্রেমে পড়ে গেলাম, শার্লক হোমস আর মাসুদ রানা পড়ে নিজেকে গোয়েন্দা ভাবতে শুরু করলাম, হুমায়ুন আহমেদের এপিটাফ পড়ে ক্যান্সার আক্রান্ত সেই ছোট্ট মেয়েটিকে মাথা থেকে আর তাড়াতে পারলামনা। কত বই যে পড়লাম! হাতের কাছে পেয়েছি তাই পড়েছি। আর বাকি সময় কাটাতাম নোবেলের বাসার দোতলায়। সুন-সান নীরবতা আর নির্জনতার কারণে দোতলার নোবেলের রুমটা ছিল আমার অসম্ভব পছন্দের যায়গা। দোতলায় এক পাশে ছিল গ্রিল ছাড়া এক বারান্দা আর অন্য পাশে ছিল নোবেলের রুম। রুমের দরজা খুললেইই সামনে বিশাল এক খালি যায়গা। খালি যায়গার মাঝে একটা একাকী নারকেল গাছ। একাকী গাছটা দেখলে এমনিতেই মন খারাপ হয়ে যায়, তার উপর সে গাছের উপর বসে থেকে-থেকে ডাকতো একটা কোকিল পাখি। কোকিলের ডাকের মধ্যে যে প্রচন্ড হাহাকার ছিল, তা যেন ঠাঠা করে এসে বুকে বিঁধত। বিষন্নতা ক্রমেই আমাকে এক ধরনের নেশা ধরিয়ে দিল।
গল্প-উপন্যাসের নানান চরিত্র আমার মাথায় ঘুরতে থাকে, ক্রমেই আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই। পরবর্তীতে এসব চরিত্রই আমার জীবনের অনেক রহস্য উন্মোচন করে। বাস্তবতাকে ধীরে ধীরে বুঝতে ও মেনে নিতে শুরু করি। বাবাকে ফিরে পাবার মিথ্যা আকাঙ্ক্ষায় মাটি চাপা পড়ে। খুব দ্রুত সময় বদলাতে থাকে, এইচ.এস.সি করার জন্য কুমিল্লার মায়াময় পরিবেশ ছেড়ে যান্ত্রিক নগরীতে চলে আসি আমি। জীবন কে এক ভিন্ন ভাবে আবিষ্কার করতে থাকি প্রতিদিন। বড় হয়ে যাই আমি হঠাৎ করেই। শিখে যাই সব পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে, সব কিছুকে মেনে নিতে।
কিন্তু শৈশবের সে কোকিলের ডাক আমি আজো ভুলতে পারিনি। আজো আমি কোকিলের ডাক শুনে অদৃশ্য চোখে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গছের একাকীত্ব অনুভব করি, নিঃসঙ্গ কোকিলের হাহাকার অনুভব করি।