রেজা ধানমন্ডি থানার ওসির সামনে বসে আছে। ওসি সাহেব এর টেবিল এর ওপর কাগজপত্রের স্তূপ এর বদলে নান রুটি আর গরুর মাংস রাখা। রেজা ব্যস্ত ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে। ওসি সাহেব রেজার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। প্লেটের খাবার শেষ হলে রেজা অনেক কায়দা করে তার হাতের আঙ্গুল চেটেপুটে খেলো। ওসি সাহেব তার টেবিল এর ড্রয়ার থেকে টিস্যু পেপার বের করে দিলেন। রেজা টিস্যু পেপার নিতে নিতে বলল “আলমগির ভাই, মানুষজন যে আপনাদের এত গালি দেয়, জিনিসটা কিন্তু অত্যন্ত খারাপ। ওরা যদি একবার আপনারে চিনতো তাইলেই কিন্তু কেল্লা ফতে। আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হবো তখন কিন্তু আপনারে আমি পুলিশের হেড বানায়া ছাড়বো। আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না। চিন্তা কইরা দেখেন বিজয় দিবসের মঞ্চে আমি দাড়ায়ে আছি আর আপনি পুরো পুলিশ বাহিনিরে নিয়ে এসে আমারে সেল্যুট করতেছেন। জিনিসটা চিন্তা করতেই আমি পিনিকে আটকাইয়া আছি।
ওসি সাহেব গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।তার সামনে যে ছেলেটা বসে আছে তাকে এতো আদর যত্ন করে খাওয়ানোর কোন প্রয়োজন ছিল না। তিনি যখন প্রথম বনানি থেকে ধানমন্ডি থানায় বদলি হয়ে আসেন তখন থেকেই একে চেনেন। চার বছর তো হবেই।চার বছর আগের কথা। থানায় এসে ওসি সাহেব শাদা পোশাকেই বের হলেন তার এলাকাটা ঘুরে দেখবার জন্য। এই সুযোগে মানুষজন কে কিরকম তাও একটু খোঁজ খবর নেয়া হয়ে যাবে।একবার সবাই চিনে গেলে এই সুবিধে টা আর পাওয়া যাবে না। সাপ যেমন খোলস পাল্টায় মানুষও তেমন খোলস পাল্টায়। তফাত টা হচ্ছে সাপের টা দেখা যায় আর মানুষেরটা দেখা যায় না। যদি দেখা যেত তবে টা যে সাপের চেয়েও বর্ণিল ও ধাধাময় হতো তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তো যাই হোক ওসি সাহেব আসর এর আজান এর পর পরই বের হয়ে পরলেন তার মোটরবাইক টা নিয়ে।মাগরিব পর্যন্ত এ পাড়া ও পাড়ায় চষে বেরুলেন। তার এলাকাটা আয়তনে খারাপ না। বেশ ক্লান্ত হয়েই বড়সড় দেখে এক রেস্তরায় ঢুকলেন ওসি সাহেব। রেস্তরার মালিকের বিশাল কুস্তিগিরের শরীর।কালো আলখাল্লা পরে আছে লোকটা। এর সাথে ন্যরা মাথা হওয়ায় বেশ ভয়ানক দেখাচ্ছে লোকটাকে। পুলিশ হওয়ার পর থেকেই যখন সাথে অস্ত্র থাকে না আর বড়সড় কোন মানুষের সাক্ষাত পান, ওসি সাহেব বেশ ভয়ে ভঁয়েই থাকেন। পরিষ্কার দেখে একটা টেবিলে বসে পরলেন। উর্দি গায়ে থাকলে এতক্ষনে তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হয়ে যেত। অবশ্য বেশিক্ষন বসতে হলো না বাচ্চা একটা ছেলে তার অর্ডার নেয়ার জন্য এসে গেল।
“কি খাইবেন বস?”
“আগে এক গ্লাস পানি নিয়া আয়”
“ঠিক আছে। অক্ষনি আন্তাসি” ছেলেটি ঘুরে পানি আনতে চলে গেল। আলমগির সাহেব এর বাইরে বের হওয়ার আরেকটা গোপন উদ্দেশ্য আছে। অনেকদিন ধরে এই লাইন এ কাজ করতে করতে অনেক জিনিস দেখা হয়ে গেছে আলমগির সাহেব এর। সাধারণত যারা প্রতিনিয়ত অপরাধ করে তারা গ্রুপিং করেই কাজগুলো করে। আর প্রতি এলাকাতেই এইরকম অজস্র গ্রুপ বা গ্যাং থাকে। মজার কথা হচ্ছে কিছু লোক আছে যারা সব গ্যাং এর সাথেই খাতির রেখে চলে। ওসি সাহেব এর দরকার এইরকম এক লোকের।এইরকেমর লোকেরা পুলিশের কাজ অনেক কমিয়ে দিতে পারে। উনি এইরকম এক ইনফরমার এর খুজে আছেন। তবে ব্যাপারটা সহজ হবে না। মানুষজন তো আর তাকে খুজে বের করে এসে বলবেনা “স্যার আপনে কি আমারে খুজতেসেন”?। এর জন্য চোখ থাকা দরকার। অভিজ্ঞ্য ওসি সাহেব এর সেই চোখ আছে।
এর মধ্যে পানি চলে এসেছে। পানি নিতে হাত বাড়াবেন ঠিক তখনি ঘটলো দুর্ঘটনা। ছেলেটার হাত থেকে পরে গেল গ্লাস টা। কাচের গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে রেস্তরার অন্যান্য সবকিছু থমকে গেল ক্ষণিকের জন্য। আর ঠিক তার পর পরই ওসি সাহেব চোখের কোনে দিয়ে কিছু একটা আসতে দেখলেন। কিচ্ছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটার গালে বিরাশি সিক্কার এক চড় পড়ল। চড়টা বসিয়েছেন স্বয়ং রেস্তরার মালিক। ওসি সাহেব হতভম্ভ হয়ে আছেন। একে তো গ্লাস ভেঙ্গে সে এমন কোন অপরাধ করেনি যে তাকে এইরকম চড় মারা হবে। তার চেয়েও যে বিষয়টা নিয়ে তিনি অবাক হচ্ছেন সেটা হচ্ছে এই লোক এত বিশাল শরীর নিয়ে যে খিপ্রতা দেখাল তা শুধুমাত্র চিতা বাঘের সঙেই তুলনীয়।কাউন্তার থেকে কখন যে উঠে এসেছে তিনি টের ও পেলেন না।
ছেলেটা চড় খেয়ে প্রায় তিন চার হাত দূরে ছিটকে পরেছে। গালে হাত চেপে বসে আছে। তার মনে হচ্ছে তার উপর আরও খারাপ কিছু আছে। ওদিকে ওসি সাহেবও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কি করবেন। শুধু মিন মিন করে একবার বলার চেষ্টা করলেন “আরে বাদ দেন বাচ্চা মানুষ”। লোকটার কানে ঢুকল কিনা ঠিক বুঝা গেলনা।লোকটা এগিয়ে গিয়ে বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে দিতে বাচ্চাটার গায়ে আরও একটি মাঝারি সাইজ এর লাথি বসিয়ে দিলো। ঠিক তার পর পরই যা ঘটলো তাতে পুরো রেস্তরা থমকে গেলো। ওসি সাহেব যে টেবিলে বসে আছেন তার ঠিক পাশের টেবিলের বিশ বাইশ বছর বয়েসই ছোকরাটা উঠে দাড়িয়ে বডিবিল্ডার এর গালে বেশ টানিয়ে এক চড় বসিয়ে দিল। বডিবিল্ডার হতভম্ব হয়ে গেল। চড়ের চেয়ে তার ধাক্কা বেশি লেগেছে। তবে মুহূর্তেই সামলে নিলো। ঝাপিয়ে পরতে যাবে ছোকরার উপর তার আগেই ছোকরার সাথে থাকা সাত আট জনের দলটা তাকে কোণঠাসা করে ফেলল।ঠিক দুই মিনিট এর মাথায় ওই রেস্তরার দৃশ্যপট পালটে গেল। নতুন দৃশ্যপটে ছোকরার টেবিলে ছোকরা আর রেস্তরার মালিক মুখোমুখি বসে আছে। রেস্তরার মালিকের পাশে বসে আছে ছোকরার অন্য বন্ধুরা। রেস্তরার কাজ কাম সব বন্ধ। ওয়েটার যারা ছিল তারা টেবিলের পাশে গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে। দুই একজন একটু গলা উঁচু করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ছোকরাদের অশ্রাব্য গালিগালাজ আর হুমকি ধামকিতে সুবিধে করতে পারল না। এখন তারাও মজা দেখতে টেবিলের পাশে দাড়িয়ে পরেছে। পিন পতন নিরবতা। এর মধ্যেই সিগারেট ধরাল ছুঁকরা।
নিরবতা ভাঙল রেস্তরা মালিক “আমার হোটেলে ধূমপান নিষেধ। অইজে লিখা আছে”
লিখার দিকে তাকাল ছোকরা সিগারেট এ ফোক দিতে দিতে বলল “তোর বউরে যে আম জনতা লাগাতে পারবে না এই কথা টা লেইক্ষা টাঙাইয়া রাখবার পারলি না। শালা বেইঞ্ছদ”। বডিবিল্ডার কিছু বলল না। পাঠকেরা নিশ্চয়ই এতক্ষনে বুঝে গেছেন ছোকরাটা রেজা ভাই ছাড়া কেউ না।
“ কালাছানের নাম কি?” পাশে থেকে রফিক জিজ্ঞেস করল। জবাব দিল না বডিবিল্ডার। ঠাশ করে আরেকখানা চড় খেলো। নিরুপায় হয়ে বুঝতে পারল আসলেই ফেঁসে গেছে লোকটা।এই ছোকরার দল এত সহজে ছাড়ার পাত্র না। যত তাড়াতাড়ি কথা বলবে তত তাড়াতাড়ি মুক্তি।
“আমার নাম বদি”
“ বদি?? হম তোর বাপ তোর জন্মের সময়ই বুঝতে পারছে তুই বদ বদ কাম কইরা বেড়াবি। এইজন্যই তোর নাম বদি। অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ তোর বাপ। এখন কাজের কথায় আসি। তুই কি জানস তোর কি অপরাধ?”
“হ জানি আমি পিচ্ছিরে মারসি”
“হুম তো এখন তোরে কি শাস্তি দেওন যায় বলতো?”
“চড় তো দুইটা খাইলাম”
“দুইটা খাইছস আরো দুইটা খাবি। কোন সমস্যা? মনোযোগ দিয়ে শোন কি বলি। তুই এই মাসের পুরো বেতন পিচ্ছিরে এখনি দিয়া দিবি। আমার পরিচিত দোকান আছে পিচ্ছি এখন থাইক্কা অইখানেই কাজ করবো। কি করবিনা রে পিচ্ছি? আমার ভাল কইরাই জানা আছে পিচ্ছি রে এইখানে রাইক্ষা গেলে আমরা যাওয়ার পর তুই তার শিয়াল কুকুর এর মতো ছিরে খাবি। কথা কি কানে গেছে”
এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল বদি “ফাইজলাম নাকি? আমি পুলিশে কমপ্লেইন করুম। তোদের সবকয়টারে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। কি...” কথাটা শেষ করতে পারল না আবারো ঠাশ করে চড় খেলো বদি। এইবার চড় টা মেরেছেন রেজা ভাই
“ শোন শূয়রের বাচ্চা, তুই যে পুলিশের কথা বলতাসস তাগো লগেই আমগো চলা ফেরা। আজকে সকালেও ওসি সাহেব এর সাথে থানায় বইসা একসাথে পরোটা আর গরুর মাংস দিয়া পেট পুরে খেয়ে আসছি। তুই তোর কমপ্লেইন লেখাইস। তোর পুলিশের কমপ্লেইনে আমি পিচ্ছাব করি। ওই জব্বার ক্যাশ বাক্স থাইক্কা টাকা নিয়া আয়। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবনা। পিচ্ছি তোর বেতন কতো?”
“আডশহ টাহা”
“ ওই ক্যাশ থাইক্ষা এক হাজার টাকা নিয়া আয়। দুইশ টাহা চড়ের জরিমানা। কাহিনী শেষ। পিকছার খতম”
ওসি সাহেব পুরো বিষয় টা পাশের টেবিলে বসেই অবলোকন করলেন।
দশ মিনিট এর মাথায় রেজা তার দলবল আর পিচ্ছি রে নিয়ে বের হয়ে আসল। ওসি সাহেবও পেছন পেছন বের হলেন। তিনি দূর থেকেই রেজার নাম ধরে ডাক দিলেন। রেজা ঘুরে তাকিয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। ছেলেটার স্পর্ধা দেখে গা জ্বলে গেলেও এগিয়ে গেলেন ওসি সাহেব।
“জে, জনাব রে কি আমার কোন কারনে ছেনার কথা”
“না আমি এই ভিতরে ছিলাম তো। পুরো ব্যপারটা দেখলাম আরকী। বেশ ভাল ছিল”
“হুম রেজার মধ্যে কোন খারাপ কিছু নাই যা আছে সবই ভাল। আমারে কি খালি এই কথা বলার জন্য ডাকছেন। নাকি আর কিছু বলবেন?”
“না মানে তোমার সাথে একটু আলাদা বসে কথা বলা দরকার”
“আপনার সাথে তো আমার এমন কোন পরিচয় হয় নাই যে আলাদা বসে বিবাহের রাইতে কে কি করসি এইতা নিয়া কথা বলত হইব। আজাইরা প্যাছাল পারার অভ্যাস আমার নাই। আপনে ফুটেন”
“না ভিতরে শুনলাম তুমি নাকি ওসি সাহেব এর সাথে সকালের নাস্তা করে আসছ। আমার মনে হয় আমিই সেই নাদান ওসি। এই যে আমার কার্ড। বয়স হয়েছে তো সকালের ঘটনা বিকেলে ভুলে যাই। অনেক কষ্ট করে মনে করতে পারলাম না পরোটা আর গরুর মাংশ খাবার কথা। তুমি যদি একটু মনে করিয়ে দিতা বড়ই উপকার হইত” গলা নামিয়ে প্রায় রেজার কানে কানেই বললেন কথাগুলো ওসি সাহেব।
রেজা ভাই ভেতরে ভেতরে চরম ভাবে চমকে উঠলেও তার চেহারা দেখে কিছু বুঝা গেল না। এক হাত দিয়ে ওসি সাহেব এর কার্ড টি হাতে নিতে নিতে বলল
“চলেন জনাবের সাথে এক কাপ চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে”।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১২