somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উনিশ শ’ একাত্তর -১

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


,
ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের রবিবাবের সকালটা পানসে হয়ে গেল। মিনিট দুই আগে কোয়ারটার মাষ্টার জানিয়েছে, ঢাকা থেকে হেলিপ্যাড রেডি করতে বলা হয়েছে। তার মানে সিনিয়র কারো আসার কথা, অথচ তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ঢাকায় ফোন বুক করলেন। কোর্সমেট জাহাঞ্জেব আবরার ঢাকায় ৫৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক। তিনি বললেন “আশ্চর্য তুই কিছুই জানিস না? চীফ যাচ্ছেন, কিঊএমজিকে নিয়ে, জিওসিও যেতে পারেন”।
মার্চের শুরু থেকেই একের পর এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ২ তারিখে হঠাত করেই তাঁকে যোনাল মার্শাল ল এডমিনশট্রেটরের দায়িত্ব নিতে বলা হল। চট্টগ্রামের সিনিয়ারমোস্ট অফিসার হিসাবে এই দায়িত্ব তার আগেই পাবার কথা। তখন বলা হয়েছিলো ইবিআরসি (ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার) যেহেতু শুধুমাত্র ট্রেনিং সেন্টার, ফাইটিং ট্রুপস নেই, তাই স্টেশন কমান্ডারের চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে তাঁর ঝামেলা হবে। মজুমদার এসব নিয়ে কোন কথা বলেননি। সময় ভাল নয়। দেশ রক্ষার যে শপথ নিয়ে তিনি ১৯৫০ সালে কমিশন পেয়েছিলেন, তার অনেকটায় এই একুশ বছরে বদলে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আসলে তাদের আর বিশ্বাস করতে পারছে না।

দু’বছর আগে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ভেঙ্গে দেবার কথা উঠেছিলো। তিনি তখন সবে কমান্ডান্ট হিসাবে ইবিআরসিতে যোগ দিয়েছেন। জি এইচ কিঊ তে অলুক্ষুণে প্রস্তাব নড়া চড়া হতে দেখে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো। তিনি সব চেয়ে সিনিয়ার বাঙালি অফিসার খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে ব্যাক্তিগত চিঠি লিখলেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট রক্ষা করার অনুরোধ করে। খাজা ওয়াসিউদ্দিন তখন এমজিও (মাস্টার জেনারেল অব অরডন্যান্স)। অনেক ব্যস্ততা তাঁর। চিঠির উত্তর এলো না। পরের বছর সেকেন্ড বেঙ্গলের রি ইউনিয়নে জয়দেবপুরে দেখা হলো ভদ্রলোকের সাথে। এক ফাঁকে খাজা সাহেবের কাছে কথাটা পাড়লেন মজুমদার, তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মজুমদার ডু ইউর জব, হোয়াট ইজ ডেস্টাইন্ড দ্যাট উইল হ্যাপেন।

সে বছর প্রজাতন্ত্র দিবস প্যারেডে বেঙ্গল রেজিমেন্টের স্বতন্ত্র কন্টিনজেন্ট রইলো না। বাঙালি সৈনিকদের প্যারেড করতে হলো এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোরস) আর বেলুচ রেজিমেন্টের সাথে মিলেমিশে। তবে বেঙ্গল রেজিমেন্ট শেষ পর্যন্ত টিকে গেলো ইয়াহিয়া খানের চালাকিতে। এক সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চাকুরি করেছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর তাঁর একটু মায়া ছিলো, আর প্রেসিডেন্ট হিসাবে এরকম একটা আদেশ দিয়ে তিনি বাঙ্গালিদের আস্থা হারাতে চাইলেন না। একদিকে জিএইচ কিউতে বলা হলো বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হবে আরেকটু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর। অন্যদিকে নতুন দু’টি বেঙ্গল ইউনিট গঠনের আদেশ দেওয়া হলো। ৩০ সেপ্টম্বর তাঁর একটির (৮ বেঙ্গল) জন্ম হলো চট্টগ্রামে। বাঙালি বিদ্বেষী লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঞ্জুয়ার পোষ্টিং হল অধিনায়ক হিসাবে। সেকেন্ড বেঙ্গল থেকে মেজর জিয়াকে আনা হলো টুআইসি (উপ অধিনায়ক) করে। এছাড়া বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে অফিসার আর জোয়ানদের বদলী করা হলো নতুন এই ইউনিটে। তিনি নিজেও ট্রেনিং অফিসার ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামানকে ছেড়ে দিলেন ৮ বেঙ্গলের কথা চিন্তা করে। তবে ইউনিট টা এখন পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেনি অস্ত্র শস্ত্রের অভাবে। না হলে পদাতিক ইউনিটে কোন মেশিন গান নেই ভাবা যায়! এলএমজি আছে গোটা কয়েক, মর্টার একটি আছে বটে, তার এমনই অবস্থা যে খোলা জোড়া শেখানো ছাড়া আর কোন কাজ হয়না তাদিয়ে। সপ্তাহ খানেক আগে ইবিআরসি থেকে ২০০ ডিপি রাইফেল ধার দেওয়া হয়েছে, কিন্ত নানান কাজে ৮ বেঙ্গলের কোয়ার্টার মাষ্টার ওলি আহমেদ তা এখনও নিয়ে যেতে পারেন নি।

এই সব ভাবতে ভাবতে তিনি ইউনিফর্ম পরে রওনা দিলেন হেলিপ্যাডের দিকে। ছুটির দিনে ইউনিফর্ম পরতে দেখে একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেন মজুমদার গিন্নি। যেডএমএলে হবার পর থেকেই স্বামীর ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। দায়িত্ব নেবার দিন থেকেই একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে। প্রথমে ওয়্যারলেস কলোনিতে বিহারি বাঙালি দাঙ্গা লেগে গেলো। সেই দাঙ্গা ঠেকাতে কম কষ্ট করতে হয়নি।মীরা আসামের মেয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা তিনি দেখেছেন। বিহারি বাঙালি দাঙ্গা নাকি তার চেয়ে ভয়াবহ। দু’দিনেই লাশ পড়েছে কয়েক শ’। বেলুচ রেজিমেন্টের সৈনিকরাও নাকি সাদা পোষাকে বিহারীদের মদদ দিয়েছে। মজুমদারকে জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে কিছু বলতে চাননি। অনেক চাপাচাপি করায় বলেছেন আমি এসপিকে বলে দিয়েছি, দরকার হলে আরমোরি খুলে বাঙ্গালিদের হাতে অস্ত্রদিয়ে দিতে।

হেলিপ্যাডে এসে অবাক হয়ে গেলেন মজুমদার চীফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদের সাথে এসেছেন, মেজর জেনারলে আবু ওসমান মিঠা, খাদিম হোসেন রাজা আর ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনসারি। মিঠা ক’দিন আগেও কুমিল্লায় ৫৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। প্রমোশন পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ারটার মাস্টার জেনারেল হয়েছেন। খাদিম হোসেন রাজা ১৪ ডিভিশনের (ঢাকা) জিওসি। কিছু না বলে কয়ে এসব হেভিওয়েট জেনারেলের আগমন তাঁকে ভাবিয়ে তুললো। পেছনে যে কখন লেঃ কর্নেল ফাতি্মী এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি টেরও পাননি। তিনি আরও অবাক হলেন তাঁর সাথে কুশল বিনিময়ের পর জেনারেলদের ফাতিমীর সাথে চলে যেতে দেখে।
ফাতিমীকে আগে থেকেই তাঁর পছন্দ হতনা। অয়ারলেস কলোনীর ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার কথা শুনে ফাতিমীর উপর তিনি মনে মনে রেগে ছিলেন। ২০ বেলুচ প্রশাসনিক ভাবে তাঁর অধীনস্থ হলেও তাঁর অপারেশনাল কমান্ডার ছিলেন কুমিল্লায় ৫৩ ব্রিগেডের কম্যান্ডার, ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। কার্যত ইকবাল শফির হয়ে তিনিই সামরিক আইন পরিচালনা করতেন চট্টগ্রামে। এখন মজুমদার যেডএমএলে হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে এড়িয়ে ফাতিমীর অফিসের দিকে জেনারেলদের যেতে দেখে তাঁর অভিমান হলো। একবার ভাবলেন বাসায় ফিরে যাবেন। কিন্তু ব্যাপারটা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবেনা ভেবে তিনি ২০ বেলুচের অফিসের দিকে রওনা হলেন।

সূত্রঃ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, সামরিক জীবনের স্মৃতি, একাত্তরের বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র ৯ম খন্ড, Witness to Surrender, Bangladesh at War, The way it was, মুক্তি যুদ্ধে নয় মাস। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাথে ১৯৯৯ সালে মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া ও আমার আলাপচারিতা
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×