মানবদেহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা তৈরি যা নিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার এবং কাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোন একটি কোষ অনিয়মিতভাবে বিভাজন শুরু করলে শরীরে সৃষ্টি হয় টিউমারের যাকে আমরা ক্যান্সার বলে থাকি। ক্ষতিকর টিউমার বা ক্যান্সার শুধু স্থানীয়ভাবেই বিস্তার লাভ করে না উপরন্তু রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে যাকে বলা হয় 'মেটাস্টেসিস'। কারো মেটাস্টেসিস হলে মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা কঠিন। তবে কিছু টিউমার নির্দোষ এবং বিস্তার লাভ করে না, ফলে এদেরকে প্রতিরোধ করা সহজ।
উন্নতদেশে এবং বাংলাদেশে ক্যান্সার হলো দ্বিতীয় প্রধান রোগ; হূদরোগের পরই এর স্থান। সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার হয় স্তন, ফুসফুস, জরায়ু, ত্বক, মলান্ত্র ও মলাশয়ে। এছাড়া লিউকেমিয়া ও যকৃতের ক্যান্সারও কম নয়। কিভাবে ক্যান্সার হয় তা এখনও সঠিকভাবে উন্মোচিত হয়নি। তবে কোষের জিনে কোন প্রকার ত্রুটি বা মিউটেশন হলেই কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজন শুরু করে। জিনের এ মিউটেশনের জন্য বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দায়ী। কয়লা ও কয়লাজাত দ্রব্য, আর্সেনিক, কীটনাশক দ্রব্য, ক্রোমিয়াম, নিকেল, হরমোন, তেজস্ক্রিয়তা, ধূমপান, তামাক সেবন, মদ্যপান, বিকৃত যৌন আচরণ, বায়ু ও পানিদূষণ, অত্যধিক চর্বিযুক্ত খাবার, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রভাব, ভাইরাস ইত্যাদি ক্যান্সারের জন্য দায়ী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলোকে এড়িয়ে চলা সম্ভব। ক্যান্সারের নিম্নলিখিত সতর্ক সংকেত বা বিপদ সংকেত দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যেমন- ফুসফুসে কাশি বা ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর, এমন কোন ক্ষত যা সহজে শুকাচ্ছে না, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, স্তনে বা অন্য কোথাও পিণ্ডাকার স্ফীতি, গিলতে অসুবিধা বা হজমের গন্ডগোল, মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন, তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন ইত্যাদি।
খাদ্যাভ্যাস বা জীবন-যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে/প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আঁঁশ জাতীয় খাবার অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ভিটামিন এ, সি, ই, বিটা ক্যারোটিন জাতীয় খাদ্য পাকস্থলি, মলান্ত্র, জরায়ু, পিত্তথলি, যকৃত, স্তন এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যেসব সবজির আহার্য অংশটি বীজ বা মূল -যেমন শুকনো মটর, মটরশুটি, শস্যজাত খাদ্য, আলু— এ সমস্ত খাবারে এমন উপাদান থাকে যা টিউমার বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায় হলুদ ফল ও শাকসবজিতে এবং গাঢ় সবুজ শাকসবজিতে। ভিটামিন 'এ' ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়তা করে। বাঁধাকপি, ফুলকপি মলান্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ভিটামিন সি ও ই এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন সি আছে আমলকি, পেয়ারা, জাম্বুরা, কমলা, লেবু ও কাঁচামরিচে। ভিটামিন 'ই' আছে সব্জির তেল, শস্যজাত খাদ্য এবং ডিমে।
অতিরিক্ত চর্বি খেলে হতে পারে স্তন ও মলান্ত্রের ক্যান্সার। লাল গোস্ত, ঘি, মাখন, দুধ, আইসক্রিম পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। যারা তামাক ও পান-সুপারি চিবান এবং জর্দা ও খৈনী খাওয়া যাদের অভ্যাস, তাদের মুখগহ্বরের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অতএব খাবার সম্পর্কে একটু সচেতনতাই আপনার ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী এন্ড ফার্মাকোলজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[দৈনিক ইত্তেফাক থেকে নেওয়া]
Click This Link