জনগনের মৌলিক অধিকারের একটি অধিকারও কোন সরকার পূর্ণ করতে পারেনি।হাজার সমস্যা থাকা সত্বে সরকার যুদ্ধাপরাধ বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বী নির্মূলের একটি নোংরা খেলা শুরু করা হয়েছে।তবে ইতিহাস ও বাস্তব প্রেক্ষাপঠ কি অনেকের জানার বাইরে।এই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পায়তারা চলছে। এই খেলার রেফারী হচ্ছেন বরাম ও বামপন্থী বুদ্ধিভ্রষ্ট কিছু সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ।তারা দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। এদের প্রধান টার্গেট হচ্ছেন ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।
যুদ্ধাপরাধ কি?আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ বা War Crime এর সংজ্ঞা হচ্ছে Violations of the laws or Customs of war, including but not limited to murder, the ill treatment or deportation of civilian residents of an occupied territery to slave labour camps, the murder or ill-treatment of prisoners of war, the killing of hostages, the wanton destmction of cities, towns, villages and any devastation not justified by military necessity.
আওয়ামী লীগ ও তাদের সুহৃদরা গত ৩৯ বছর ধরে এদের প্রথম রাজাকার আলবদর, পরে ঘাতক দালাল বলে আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ‘এতে কাজ না হওয়ায়', তাদের অপপ্রচার সত্ত্বেও দল হিসেবে জামায়াতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় একটি বিদেশী শক্তির ইন্ধনে ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে সেনা সমর্থিত বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে নতুন করে যুদ্ধাপরাধী শব্দটির অপব্যবহার শুরু হয়, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম নামে একটি সংগঠনের জন্ম দিয়ে তার ছত্রছায়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা শুরু হয়। যারা এই দাবি করছেন তারা সকলেই বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানকে ‘জাতির পিতা' বলে গণ্য করেন। আর স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে শেখ মুজিবর রহমানের শাসনামলে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের অপরাধের ফিরিস্তিও তৈরি হয় এবং বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য ১৯৭৩ সালে International (Crimes) Tribunal Act নামে একটি আইনও পাস করা হয়। প্রেস নোট জারী করে সরকার বিচার শুরুর একটা তারিখও ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তির ভিত্তিতে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। শেখ মুজিবর রহমান পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই ক্ষমা ঘোষণা দেন এবং বলেন যে, বাংগালীরা জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়। একইভাবে Collaborator Act এর অধীনে ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের জন্যও তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তবে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট-- এই চারটি অপরাধের সাথে যারা জড়িত ছিল সংগত কারণে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুবিধা প্রযোজ্য ছিল না। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকর্মীদের পাইকারী হারে দালালীর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাদের অনুপ্রেরণায় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা বিনা ওয়ারেন্টে এবং আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার ও হত্যা করেছিল। এই নিহতদের তালিকা ও বিস্তারিত ঠিকানা এবং হত্যাকারীদের নাম ধাম, পরিচয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনেকেই সংরক্ষণ করেছেন এবং এখনো তা আছে।
হত্যা নির্যাতনের পর যাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাদের মধ্যে ঐ সময় দালালীসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩৭৪৭১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। এর মধ্যে পুলিশী তদন্তে ৩৪৬২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুকূলে কোনো সাক্ষী প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২৮৪৮ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশীট গঠন করে এবং অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় এর মধ্য থেকে ২০৯৬ জন বেকসুর খালাস পান। অবশিষ্ট ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফৌজদারী অপরাধ প্রমাণিত হয় এবং আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হয়। এদের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্বাধীনতার আগে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যত হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে তার কোনটির সাথে অদ্যাবধি জামায়াতের সম্পৃক্তি প্রমাণ করা যায়নি। গত ৩৯ বছরের ইতিহাসে এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে জামায়াতই একমাত্র দল যারা সন্ত্রাসী লালন করে না, দলটি স্বয়ং কিংবা তার কোনো অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি অথবা দুর্নীতির সাথে জড়িত নয়। ১৯৭১ সালে জামায়াত অথবা তার তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।
সত্তুরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদী নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে যে গণহত্যা শুরু করেছিল, একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নেতাকর্মীরাও এ থেকে রেহাই পায়নি। এই সামরিক একশন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং ৩ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ছিল গেরিলা পদ্ধতির; ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার পর ১৩ দিন এই যুদ্ধ চলে এবং ১৪তম দিনে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং দেশ স্বাধীন হয়। এই যুদ্ধে দু'টি পক্ষ ছিল। এক পক্ষে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী এবং অন্যপক্ষে পাকিস্তান বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর সাথে সহযোগী বাহিনীও এই যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে তখন ইপিআর, আনসার এবং রাজাকার বাহিনী তৎপর ছিল। আল বদর, আল শামস, রাজাকার বাহিনীরই দু'টি শাখা ছিল। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সাথে সাথে তার সহযোগী বাহিনীর সদস্যরাও যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। জামায়াত যুদ্ধরত এই বাহিনীগুলোর কোনটিরই সাথে জড়িত ছিল না। মাওলানা নিজামীসহ জামায়াতের কোনো নেতা যুদ্ধরত কোনো বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন না। ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে প্রথমত সহস্রাধিক ও পরে যে ১৯৫ ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে জামায়াত অথবা অন্য কোনো দলের নেতাকর্মীদের নাম ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ করার কারণে কোথাও কোনো মামলা ছিল না। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞায়ও তারা পড়েন না। তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধী হন কিভাবে? যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞার ভিত্তিতেই ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করেছিলেন। চিহ্নিত করার এই কাজটি ছিল চূড়ান্ত। সরকারী প্রেস নোট অথবা গেজেট নোটিফিকেশনে এই কাজকে অসমাপ্ত বলা হয়নি অথবা দ্বিতীয় কিস্তিতে অপরাধীদের আরেকটি তালিকা তৈরীর প্রতিশ্রুতিও তৎকালীন মুজিব সরকার দেননি, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর যে সমস্ত সিনিয়ার কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বেসামরিক যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐ সময়ে কোন আভাসও দেননি। সামরিক যুদ্ধাপরাধীদের বিনাবিচারে মুক্তি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ৩৮ বছর পর আজ রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এবং বিচারের প্রহসনের আসল উদ্দেশ্য জ্ঞানপাপীরা না জানার ভান করতে পারেন কিন্তু দেশবাসী নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ৭:০৬