মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত নিতে সেদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য- আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন ছাড়াও সুইডেন, জাপান, ইতালি ও মিশরের রাষ্ট্রদূতরাও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর পক্ষ থেকে দেওয়া ব্রিফিংয়ে।
জাতিসংঘ সদর দফতরে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর সামনে তুলে ধরেন।
এরপূর্বে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন ও রাশিয়াকে পাশে পাবে বাংলাদেশে- এমনটাই আশাবাদ জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জানিয়েছিলেন ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে’!! গত ১৯ সেপ্টেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে দেশটিতে সফর করে আওয়ামী লীগের ১৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল। সফরে কমিউনিস্ট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট লি জুনের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দেশে ফিরলে ফারুক খানসহ প্রতিনিধিদল জানিয়েছিল চীন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হল তাদের এসব বক্তব্য শেষপর্যন্ত মিথ্যা বলে প্রমানিত হয়েছে গতকালের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর, যেখানে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব ছাড়াই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্ক শেষ হয়েছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে চীন ও রাশিয়া। এবারও সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য দেশ দু’টি কথিত ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’দের দায়ী করেছে। নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার নিজের অবস্থানে অটল থেকে জাতিগত নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করে বরাবরের ন্যায় মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছে। ওদিকে, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের রাখাইন রাজ্যে নির্ধারিত সফর মিয়ানমার সরকার হঠাৎ করেই বাতিল করে দিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা কেন পালাতে বাধ্য হয়েছে সেটা রাখাইনে গিয়ে তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের মিয়ানমার সফর কথা ছিল।
সুচি বাংলাদেশ থেকে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিবে বলে বাংলাদেশকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে ঢাকা সফররত ব্রিটেনের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত হামলা বন্ধ করতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন!
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আরও ৫৩ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে চীন। অন্যদিকে আরেক দেশ ভারত গতকাল প্রায় ৭০০ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে বসবাসের সুযোগ ও তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। তিনি জাতিসংঘের কাছে এ সংক্রান্ত একটি ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেছেন, যাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের সুযোগ থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফ্যান রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে উদ্বাস্তু খাতের বিশেষ ঋন সহায়তা দিবে যার অর্ধেক পরিশোধযোগ্য। অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ করে হলেও রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে হবে বাংলাদেশের কেননা রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে থাকবার বাবস্থা করবার দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের!
অর্থাৎ বলা চলে অনাখাঙ্খিত ভাবেই ছোট এই বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগনের সাথে আরও অতিরিক্ত দশ লক্ষ নিরক্ষর, পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী যোগ হলো। যাদের জন্য কিছু খাদ্য সহায়তা হয়ত বিশ্বের কিছু দেশ দুই অথবা এক বছরের জন্য করবে। কিন্তু চূড়ান্ত ভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপ সামলানোর দায় আমাদের ঘাড়ে পড়ছে। আমাদের নতজানু কূটনীতি কারনে নিজ দেশের জনগনের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলেও অন্যদেশের দশ লক্ষ লোকের দায় নিজেরা বহন করতে চলেছি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৪৯