সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কাতারের ওপর অবরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর লেবানন নিয়েও সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে সৌদি আরব। দেশটির ৩২ বছর বয়সী ক্রাউন প্রিন্স ও পরবর্তী সম্ভাব্য রাজা মোহাম্মাদ বিন সালমানের শক্তি প্রয়োগের কূটনীতিই বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ইসরাইলের সমর্থন নিয়ে সুন্নি বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার যে পরিকল্পনা তিনি করেছেলেন তা কার্যত ভেস্তে যেতে বসেছে। বরং সৌদি আরবের আগ্রাসী নীতি এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ও বিশ্বস্ততা বাড়িয়ে তুলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক দখলের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেজিম চেঞ্জের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে যুদ্ধের পর ইরাকে ইরানপন্থী শিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব মূলত দেশটি নিয়ন্ত্রণ করছে। শিয়া ধর্মীয় নেতারা ছাড়াও দেশটির প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি ইরানপন্থী হিসেবে পরিচিত। ইরাককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদার বলে স্বীকৃতি দিলেও দেশটিতে ব্যাপক আকারে ইরানের প্রভাব বর্তমান। আইএস বিরোধী যুদ্ধ ইরাক-ইরান কে একসুতায় বাঁধলেও সৌদি আরবের প্রতি ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবের সাথে ইরাকের ৮শ’ কিলোমিটার সীমান্ত থাকায়। দেশটির সাথে ইরানের সম্পর্কে সব থেকে উৎকণ্ঠায় রেখেছে সৌদি আরবকে।
লেবাননে ইরানপন্থী রাজনৈতিক ও মিলিশিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ সেখানের সুন্নি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। দেশটিতে অব্যাহতভাবে ইরানের প্রভাব বাড়ছে। ইরানের সবচেয়ে বিশস্ত মিত্র সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে উৎখাতে ব্যর্থতার পর তিনিই ক্ষমতাসীন থাকছেন। লিবিয়া আর ইয়েমেন হয়ে পড়েছে যুদ্ধক্ষেত্র। এ যুদ্ধের যেন কোনো শেষ নেই। অপর দিকে কাতারের সাথে বিরোধের কারণে দেশটি এখন সৌদি জোট থেকে ইরানের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আরব লিগের মতো সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট (জিসিসি) অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সৌদি রাজপরিবারে ক্ষমতার লড়াই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে একাধিক প্রিন্স, সাবেক মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীকে আটক করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতার মধ্যে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর কৌশল হিসেবে লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে সৌদি আরব ডেকে এনে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
সাদ হারিরিকে পদত্যাগ করানোর উদ্দেশ্য ছিল লেবাননে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। কারণ লেবাননে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিজবুল্লাহ। এর আগে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলেও তিনি তাতে রাজি হননি। লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তৎপরতায় সৌদি আরবকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে ইসরাইল। কারণ হিজবুল্লাহর সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরাইলের জন্য বড় হুমকি।
সাদ হারিরি সৌদি আরব এসে পদত্যাগ করে ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তাকে হত্যা চেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করে সৌদি টিভিতে বিবৃতি দিলেও হিজবুল্লাহ দেশটির সুন্নি প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। এমনকি লেবাননের সব রাজনৈতিক দল সৌদি নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাকে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করছে। ফলে হিজবুল্লাহর ওপর চাপ সৃষ্টির সৌদি কৌশল কার্যত ব্যর্থ হয়ে পড়ছে। দেশটির খ্রিষ্টান প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হারিরিকে অপহরণের জন্য সৌদি আরবকে দোষারোপ করেছে। দেশটির জনগন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে বরং তাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী জানাচ্ছে। সুতরাং লেবানন নিয়ে সৌদি ষড়যন্ত্র মাঠে মারা গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইয়েমেনের শিয়া হুতি বিদ্রোহিরা সৌদি আরবের রিয়াদ বিমানবন্দর লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। সৌদি আরব হুতিদের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র দেয়ার জন্য ইরানকে দোষারোপ করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে হুতিরা গোপনে উত্তর কোরিয়া থেকে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পেয়ে থাকতে পারে। ইয়েমেনের সাথে সৌদি আরবের ১৮শ’ কিলোমিটারের সীমান্ত আছে। যদি হুতিরা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র পেয়ে থাকে তাহলে সৌদি আরবের জন্য তা হবে বড় ধরনের বিপদের কারণ। এ ছাড়া বৃহৎ কোনো শক্তি বিশেষ করে রাশিয়ার নীরব সমর্থন ছাড়া হুতি যোদ্ধাদের হাতে এমন সমরাস্ত্র আসার কোনো কারণ নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নানামুখী স্বার্থের সম্পর্কের মধ্যে ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সামরিক সম্পর্ক বাড়ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল কেনার চুক্তি করেছে তুরস্ক। এই প্রথম কোনো ন্যাটো সদস্য দেশ রাশিয়ার সাথে সামরিক চুক্তি করল। তুরস্কে মার্কিন সমর্থনে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে তুরস্ক। বেশ কিছু দিন থেকে তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের পর দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক। কাতারের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে দেশটির আমিরের আহ্বানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে তুরস্ক। প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়েছে যা অ্যামেরিকা, সৌদিআরব ও ইসরাইলের জন্য অসস্থিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
সম্প্রতি ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাঁস হওয়া কিছু তারবার্তার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে তেলআবিব দেশটির কূটনীতিকদের নির্দেশনা দিয়েছেন সৌদি আরবকে যেন সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য তারা প্রভাব বিস্তার করেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সামনের দিনগুলো সৌদি আরবের জন্য হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ অঞ্চলে সৌদি আরবের চাপ প্রয়োগের কূটনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতা দেশটিকে বন্ধুহীন করে তুলছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইরান প্রভাব বিস্তার করছে। বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সাথে ইরান ও তুরস্কের ঘনিষ্ঠতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৩২