গতকাল ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ নিহত হয়েছেন। হুথিদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজধানী সানা থেকে আবব-আমিরাত নিয়ন্ত্রিত মারিব শহরে পালিয়ে যাওয়ার পথে হুথিদের একটি চেকপোস্টে সালেহ তার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ নিহত হয়।
আলী আব্দুল্লাহ সালেহ নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সানার অধিবাসীরা মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। হুথিদের হাতে সালেহের এক ছেলেও গ্রেফতার হয়েছে বলা জানা যায়। আল-জাজিরা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে হুথি সমর্থকরা আজ রাজধানী সানায় খুব বড় ধরনের শোডাউন করেছে।
দীর্ঘ ৩৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এক বছরের গণ আন্দোলনের মুখে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন সালেহ।
১৯৪২ সালে সেনাবাহিনীর কর্নেল পদে যোগ দেন তিনি। সরকারের বিরুদ্ধে ক্যুয়ের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে তিনি উত্তর ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে তিনি সম্পূর্ণ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সালেহ সাবেক ইরাকি এক নায়ক সাদ্দাম হোসেনের বন্ধু ছিলেন এবং সৌদি আরবের শাসকদের সাথে তার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল, সৌদি সমর্থনের জন্যই তিনি তিন দশক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন বলেই মনে করা হয়। ২০০০ সালে তিনি অ্যামেরিকাকে আল-কায়েদা দমনের জন্য সহায়তা চুক্তি করে কয়েক বিলিয়ন সহায়তা লাভ করেন। কিন্তু প্রকারন্তরে ধীরে ধীরে ইয়েমেনে আল-কায়েদা জঙ্গিগোষ্ঠী ছড়িয়ে পরে। স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহ ৩৩ বছরে দেশটি থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ৩,২০০ থেকে ৬,০০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্যানেল। সালেহের বিরুদ্ধে ২০ টি দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনে নিরাপত্তা পরিষদের ওই প্যানেল। পরবর্তীতে মার্কিন মধ্যস্থতায় দায়মুক্তির নিশ্চয়তা নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তিতে সই করেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। সালেহ তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আল হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন হাদি। এ পদক্ষেপ সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)। এদিকে সরকারবিরোধী গণজোয়ার কিছুদিনের মধ্যে গণরোষে পরিণত হয়। দেশজুড়ে দেখা দেয় অসন্তোষ। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলনের ফলে দেখা দেয় জাতীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এদিকে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় জন্ম নেয় একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, আনসারউল্লাহ হুথি আন্দোলন। হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের শিয়া অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। দেশটির সামরিক বাহিনীতেও মেরুকরণ শুরু হয়। হাদি সরকারের সেনাবাহিনীর অনেকেই হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের অভিযানে শরিক হয়। ২০১৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ তার সমর্থকদের নিয়ে হুথিদের সাথে জোট গঠন করে। সালেহ-হুথি জোট ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে। হুথিরা সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণা দেয়। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ হাদি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরব পালিয়ে যায়। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট তাদের পন্থী হাদি সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে ইয়েমেনে বিমান হামলা শুরু করে। তিন বছর ধরে চলা এই বিমান হামলায় অন্তত দশ হাজারের বেশি লোক নিহত হন। অন্যদিকে সৌদি আরব জোটের আরোপিত নৌ-স্থল-বিমান অবরোধে ৭০ লক্ষ ইয়েমেনী নিরাপদ পানি এবং খাদ্য সংকটে পরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
৩ বছর ধরে হামলা চালিয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ অর্জনে ব্যার্থ হয়ে সৌদি জোট তাদের সাবেক মিত্র সালেহের সাহায্যে পুনরায় রাজধানী সানা দখলের চেষ্টা করে। মাত্র ৫ দিন আগে দীর্ঘ ৩ বছরের জোট ভেঙ্গে হটাত করেই সালেহ তার তিন বছরের মিত্র হুথিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা পোষণ করে। পরবর্তীদিন সালেহপন্থী মিলিশিয়ারা রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা থেকে হুথিদের সরিয়ে দেয়। সালেহকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে হুতিরা এবং সকল ইয়েমেনিদের সালেহপন্থী মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে আহব্বান জানায়। পরবর্তী দুইদিনে হুথিরা আবার রাজধানীর সকল চেকপোস্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। অন্যদিকে সালেহর সমর্থনে রাজধানীতে ব্যাপক ভাবে বিমান হামলা শুরু করে সৌদি জোট। হুথিরা সালেহের বাড়ি দখলের পর সেটা উড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে সালেহ তার কয়েক জন সঙ্গীসহ রাজধানী সানা থেকে পালিয়ে আরব-আমিরাত নিয়ন্ত্রিত মারিব শহরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দ্রুত তার গাড়ি হুথিদের একটি চেকপোস্টেের থেকে পালাতে গেলে রকেট প্রোপেলড গ্রেনেড (RPG) হামলার শিকার হয়। পরে হুথিরা সালেহ ও তার সঙ্গীদের বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
হুথিদের বিরুদ্ধে সালেহ হটাত করেই বিদ্রোহের ঘোষণা দিলেও হুথিরা অনেক আগ থেকেই দিনটির জন্য প্রস্তুত ছিল। কেননা সালেহর সাথে তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব থাকলেও তারা প্রথম থেকেই তার ব্যাপারে সংশয়ে ছিল। বিভিন্ন মাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় হুথিদের আন্দোলন ২০০০ সাল থেকেই বিস্তার লাভ করে, এমনকি ৬ বার করে সালেহ সরকারের সাথে তাদের দন্দ হয়। এমনকি হুথি আন্দোলনের বর্তমান নেতা আবদুল মালেক আল-হুথির বড় ভাই হুথি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হুসেন বদ্রুদ্দিন আল হুথিকে সালেহ সরকার ২০০৪ সালে হত্যা করে।
ইয়েমেনের হুথি আন্দোলনের নেতা আবদুল মালেক আল-হুথি রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ ও তার অনুগত বাহিনীকে পরাজিত করে হুথি যোদ্ধারা ইয়েমেনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি নস্যাৎ করে দিয়েছে আনসারুল্লাহ প্রধান বলেন, সালেহর বাহিনী এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে যোগাযোগ ছিল যার কারণে সৌদি আরব রাজধানী সানা দখল করার জন্য তাদেরকে বিমান সমর্থন দিয়েছিল। আবদুল মালেক জোর দিয়ে বলেন, ইয়েমেনের জনগণের প্রতিরোধকে দুর্বল করার জন্য সৌদি আরব ও তার কয়েকটি মিত্র দেশ ইয়েমেনের ওপর কঠোর অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইয়েমেনের মুসলিম জনগণ, তাদের প্রতিরোধ ও হুথি যোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন আগ্রাসীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, সৌদি আরব, আমেরিকা ও ব্রিটেনের সমস্ত তৎপরতা ইয়েমেনের জনগণকে আরো বেশি প্রতিরোধকামী করে তুলবে। সালেহর ব্যর্থ ষড়যন্ত্র থেকে শত্রুদের শিক্ষা নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন আবদুল মালেক আল-হুথি।