সরকার নিয়ন্ত্রিত বিটিভি এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ড ছাড়াও দেশে এখন চালু আছে অন্তত ৩০টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। প্রতিদিনের সর্বশেষ দেশী-বিদেশী খবর ছাড়াও আমাদের চ্যানেলগুলো সিনেমা, নাটক সিরিয়াল, স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান, বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টক শোসহ পাঠকদের চাহিদা মেটানোর জন্য সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। দর্শকদের ভিন্ন ভিন্ন রুচির চাহিদা মেটাতে গিয়ে চ্যানেলগুলোর কিন্তু প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু তাতে লাভ কি উলু বনেই যেন মুক্তা ছড়ানো হচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। দর্শকদের কিন্তু ফেরানো যাচ্ছে না বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোর এই প্রচেষ্টার দিকে। তারা ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রতিই আসক্ত। বিশেষ করে ঘরে ঘরে মহিলারা যেন মাদকের মতো আসক্ত হয়ে পড়েছেন ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি। এর কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সমাজ সভ্যতার ওপর। এমনকি এবারের ঈদ বাজারেও তার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ভারতের ফেনসিডিল আগ্রাসনে যুব সমাজ শেষ হবার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবার পর এবার ঐ দেশের টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির। মুসলিম জন্ম পরিচয় আর নামে আমরা যতই মুসলমান হই না কেন-চলনে, বলনে, কথনে, মননে আমরা হবো ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। নিজস্ব স্বকীয়তা বলতে আমাদের কিছু থাকবে না। এটাই যেন ভারতীয় সিরিয়াল নির্মাতাদের টার্গেট। একটা জাতিকে মননে ভারতীয় বানাতে পারলে স্বার্থ হাসিল করা কোন কষ্টকর ব্যাপারই নয়। তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ দখলের যুগ এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখনকার মনীষীদের ধ্যান-ধারণা হলো মানুষের মনের জগতটাকে দখল করা। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো বাংলাদেশের মানুষের মগজ ধোলাই কাজে বেশ পারঙ্গমতার পরিচয় ইতোমধ্যেই দিয়েছে।
একটু লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোর মূল বিষয়বস্তু তিনটি। প্রথমত : সিরিয়ালগুলোতে ভরপুর থাকে পারিবারিক ও সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা এবং ঝগড়া। এটাকে কেন্দ্র করে গোটা সিরিয়ালজুড়েই থাকে কূটবুদ্ধির চর্চা। প্রতিহিংসা রূপ নেয় একে অপরকে ধ্বংস বা হত্যা অথবা হত্যা ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে। গৃহবধূ, নারী এবং কিশোরীরা এই ঝগড়া-ঝাটি দেখতে বেশ পছন্দ করে। এটা তাদের মনের মধ্যে দাগ কাটে, নিজেদের প্রবৃত্তিটাও আস্তে আস্তে সেভাবেই বিকশিত হয়। পরিণত বয়সীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে এই সিরিয়াল দেখে। তাদের ভিতরের স্বভাবটাও আস্তে আস্তে ঝগড়াটে স্বভাবে রূপ নেয়। এটা যখন বাস্তবে রূপ লাভ করে তখন পরিবারগুলোতেও দেখা দেয় প্রতিহিংসা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও ঝগড়াটে পরিস্থিতি। এরূপ প্রতিহিংসার জন্ম হয় মা-বেটির মধ্যে, বোনে-বোনে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, বাপ-বেটায়, স্বামী-স্ত্রীতে, বউ-শাশুড়ীতে, বউ-ননদসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে। সব মিলিয়ে এক পারিবারিক দ্বন্দ যেন আমাদের পরিবার প্রথাকেই হেয় করে প্রস্ফুটিত করা এসব সিরিয়ালের উদ্দেশ। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মহব্বতের সম্পর্ক থাকার কথা আমাদের ধর্ম, আমাদের পরিবার প্রথা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুসারে। কিন্তু সেটাকে সুক্ষ্মভাবে ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা চলছে টিভি সিরিয়ালের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে।
ভারতের বাংলা চ্যানেল জি বাংলা, স্টার জলসা, ইটিভি, হিন্দি চ্যানেল জিটিভি এবং স্টার প্লাস সর্বাধিক সিরিয়াল প্রচার করে থাকে। এগুলোর সবই বাংলাদেশে জনপ্রিয়। এসব সিরিয়ালের দ্বিতীয় বিষয়বস্তু হলো ‘পরকীয়া’। এক নারীর সাথে একাধিক পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা, আবার এক পুরুষের সাথে একধিক নারীর দৈহিক সম্পর্ক ও মেলামেশাকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হয় ভারতের চ্যানেলগুলোর টিভি সিরিয়ালে। এগুলোকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবর্তে সৃষ্টি হয় সন্দেহের। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে সন্দেহ করে। ফলে সুখের সংসারে আগুন লাগে। কখনো কখনো নতুন বউ ঘরে আসতে না আসতেই এই সন্দেহ দানা বেধে ওঠে। মাতালের মতো আগ্রহ নিয়ে এইসব সিরিয়ালের কাহিনী পর্যবেক্ষণের কারণে আমাদের সমাজেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। স্বামী সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সারা দিন কি করে, সে কি চাকরি করে, না প্রেম করে, না আরেক বিবির কাছে সময় কাটিয়ে আসে, অফিসে কি সে তার কোন নারী কলিকের সাথে ফস্টি-নস্টি বা কোন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে কিনা। এমন সন্দেহ ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে এই টিভি সিরিয়ালের বদৌলতে। একইভাবে উল্টো সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক স্বামীর মাঝে। কারণ তিনি থাকেন সারা দিন বাইরে, ঘরে একা নারী অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে। এভাবে একে অপরকে সন্দেহ করা এখন আমাদের ঘরে ঘরে। এ কারণে বিশ্বাসের জায়গা, মহব্বতের জায়গা, একে অপরের অধিকারের জায়গাটা আগের মতো আর থাকছে না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলে ভারতের একেকটি সিরিয়াল। যার পুরোটাজুড়েই আবর্তিত থাকে পরকীয়া। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, মহব্বতের মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা এবং শান্তির আবাসস্থল। বিশ্বাস না থাকলে বাস্তবে পৃথিবীতে কোন সভ্যতাই গড়ে উঠতো না। সেই বিশ্বাস যেন ভেঙ্গে দিতে চাইছে সিরিয়ালগুলো।
সিরিয়ালগুলোর তৃতীয় মৌলিক বিষয়বস্তু হলো ধর্ম। সস্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, বা যা কিছু নিয়েই দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা বা প্রতিহিংসা যখন চরম পরিণতির দিকে যায় তখন ধর্মের কাছে গেলে তার সমাধান হয়ে যায়। ধর্মই সত্যের ওপর অবিচল থাকা নায়ক বা নায়িকার শেষ আশ্রয়স্থল। ভারতের বাংলা বা হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে সেটাই দেখা যায়। চরম সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতে যখন কেউই তার পক্ষে নেই বলে মনে হয় তখন দেখা যায় যে, সংক্ষুব্ধ নায়ক ,নায়িকা বা সংশ্লিষ্ট চরিত্রের ব্যক্তি দেবী দুর্গার কাছে, কখনো কালির কাছে, কখনো সরস্বতির কাছে, কখনো গণেশ, আবার কখনো রাম বা অন্য কোন দেবতার মন্দিরে মূর্তির কাছে কান্নাকাটি করছে। দেবতার কাছে পূজা দিচ্ছে তার কাছেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত সমাধানও তাদের ধর্মের কাছে গিয়েই হচ্ছে। একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলা মেগা সিরিয়ালের কাহিনী, কথোপকথন এবং ঘটনা পরম্পরায় যখন যে পূজা তখন সেখানে গিয়ে আবর্তিত হয়। সিরিয়ালের সুদক্ষ কাহিনীকার, পরিচালক, প্রযোজক পূজার পর্বগুলো এমনভাবে সাজান যেন কাহিনী এই পূজা উপলক্ষে সবেমাত্রই লেখা হয়েছে। সিরিয়ালের শেষ মীমাংসাও হয় ধর্মে। বাস্তবে কৌশলে সিরিয়ালগুলোতে তারা তাদের দেশের ধর্মটাকেই প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করছে। ধর্মকেই সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হচ্ছে সিরিয়ালগুলোতে। অথচ আমাদের দেশের সমস্ত নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল সব কিছুতেই খারাপ চরিত্রটি বলতে ধার্মিক ব্যক্তি বা ধর্মের লেবাসধারী কোন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। ধর্মটাকে এখানে সংস্কৃতির অঙ্গনে খারাপ অর্থেই ফুটিয়ে তোলা হয়। ধর্মের প্রতি সবাইকে বিদ্বেষ তৈরি বাংলাদেশের সংস্কৃতির অঙ্গনের হোতাদের কমন টার্গেট বলেই ধরে নেয়া হয়।
পবিত্র মাহে রমযানের শেষপ্রান্তে এসে সবাই ব্যস্ত ঈদ কেনাকাটায়। ঈদ শপিং-এ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো। এবার সেটা কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইতোমধ্যে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাকে পছন্দের ‘পাখি’ পোশাক কিনে না দেয়ার কারণে। আবার স্ত্রী কতৃক স্বামীকে তালাক দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই সিরিয়ালের পছন্দের পোশাক স্বামী কিনে না দেয়ার কারণে। এই দুইটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে, ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোর কুপ্রভাব আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা মহামারী আকার ধারণ করার আগেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ঈদ ফ্যাশনে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি, ফ্রক, গহনার স্থান দখল করে নিচ্ছে ভারতীয় আগ্রাসী টিভি সিরিয়াল। আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি তমদ্দুন হারিয়ে যেতে বসেছে , একসময় হয়তো হারিয়েই যাবে যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা সঠিক কাজটি না করেন।
এতো গেল ঈদ বাজারের কথা। বাস্তবে ঘটছে ঘরে ঘরে আরো জঘন্য ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, তার স্ত্রী খুই অসুস্থ। তবে বিকেল থেকে যখন ভারতীয় সিরিয়ালগুলো শুরু হয় তখন সে আস্তে আস্তে সুস্থতা বোধ করে। বাস্তবে সে অসুস্থতা ভুলে থাকে। আরেকজন জানান, রাতের খাবার তারা পরিবারের সবাই মিলে একসাথে খেতে পারেন না। কারণ সিরিয়াল মিস হয়ে যাবে। তাই স্ত্রী চলে যান ভাত নিয়ে টিভির সামনে। রোববার বোধহয় সিরিয়াল থাকে না, তাই ঐদিন একত্রে খাওয়া সম্ভব হয় কোন কোন সপ্তাহে। আরেকজন ভুক্তভোগী এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি সারা দিন সংসারের জন্য খেটেপুটে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরেন রাত ১০টা বা তারও পরে। সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীর দ্রুতই বিছানা চায়। কিন্তু স্ত্রীর সিরিয়াল দেখা শেষ না হলে বিছানায় যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তার টিভিটাও শোবার রুমে। রাত সাড়ে বারোটার আগে শুতে যাওয়ার কথা বললে বাসায় ক্রুক্ষেত্র বেধে যায়। কারণ এটা স্ত্রীর ভাল লাগার ওপর হস্তক্ষেপ হয়ে যায়! সারা দিনের কর্মক্লান্ত স্বামী কোনদিন অসুস্থ থাকলেও সেদিকে তাকানোর সময় নেই সিরিয়াল আসক্ত স্ত্রীর। ঐ ব্যক্তি আরো জানান, আমিতো লজ্জা শরম ত্যাগ করে মনের কথা, আমার ভোগান্তির কথা বললাম। খবর নিয়ে দেখেন গিয়ে যে, প্রতিটি ঘরেই একই চিত্র।
উল্লেখ্য, ভারতে বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের অনুমতি নেই। কিন্তু আমাদের দেশে ভারতীয় চ্যানেলের কোন লাগাম নেই। এভাবে আকাশ খুলে দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে নীরবে তার মহামারির রুপ ধারণ করতে দেয়ার মত দুর্ভাগা জাতি আর আছে কিনা তা জানা নেই। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল এবং তৃতীয় স্থান নির্ধারনী খেলার সময় মালয়েশিয়ায় থাকাকালে দেখেছি বিদেশী চ্যানেল দেখার বিষয়ে কতটা রেসটিকটেড ঐ দেশটি। কোন কেবল অপারেটরই একটি কানেকশনে দুনিয়ার সব চ্যানেল আমাদের দেশের মত দেখিয়ে দিতে পারেনা। তাদের জাতীয় টেলিভিশন ছাড়া যেকোন বেসরকারি বা বিদেশী চ্যানেল দেখতে হলে আগে পারমিশন নিতে হয়। এই পারমিশন অত্যন্ত সীমিত।আর সে কারনেই কুয়ালালামপুরে যে বাসাতে ছিলাম সেই বাসায় বসে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সুযোগ হয়নি। প্রিয়দল আর্জেন্টিনা আর জার্মানীর ফাইনাল খেলা সেই রাতে গিয়ে দেখতে হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটারিয়ায় গিয়ে।