শ্রাবনী
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
শ্রাবনের মেঘ গুলো জড়ো হলো আকাশে
একটু পরেই নামবে বুঝি শ্রাবনী ধারা এই
আজ কেন মন উদাসী হয়ে দূর অজানায়
চায় হারাতে ...........................।
অনেক দিন ধরে যেন এমনই একটি সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছিল শ্রাবনী। তাই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যখন দেখল ঝুম বৃষ্টি নেমেছে, আকাশ যখন তার সব দুঃখ জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে , নিজেকে সে আর ধরে রাখতে পারলনা, সে ও আজ ভাসাবে তার সব দুঃখ কথা, সব কিছু আজ বিলিয়ে দেবে নোনা জলের ধারায়। শ্রাবন ধারায় নোনা জলের নোনতা হালকা হবে হয়ত , কিন্তু শ্রাবনীর মন। সে উত্তাপ কি কমবে, নিজেকে একবার এ প্রশ্ন করেই সে চিন্তা বাদ দিল শ্রাবনী, শ্রাবন ধারায় আজ সে হারাবেই।
বসার ঘরে কেউ ছিলনা। শ্রাবনী দরজাটা টেনে দিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সন্ধ্যা হতে এখন ও অনেক বাকী থাকলেও আকাশের চেহারা দেখে তার মনে হল কোন বাচ্চা মেয়ে নিজের মনের মত করে পুরো মুখ জুড়ে কাজল লাগিয়েছে, ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢেকে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কোন কোন ঘরের সন্ধ্যাবাতিও জ্বলে উঠেছে।
সিঁড়ি ঘরের শেড থেকে সে সোজাসুজি ছাদের মাঝখানে চলে আসল। শ্রাবন ধারার প্রথম ঝাপটায় শীত শীত লাগলেও সয়ে আসছে। গাড় সবুজ রঙের জামাটি ভিজে যাওয়ায় মনে হতে লাগল সে কালো জামা পড়েছে। শেষ কবে এমন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছে শ্রাবনী মনে করার চেষ্টা করল। কেউ দেখলে কি ভাববে এ নিয়ে একটু লজ্জা কাজ করলেও শ্রাবনী তা মাথা থেকে দূর করে দিল। স্কুল পড়ুয়া কিশোরীর এমন ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা স্বাভাবিক হলেও তাকে কেমন লাগছে এ নিয়ে খুব একটা বিচলিত বোধ করলনা সে।
সে , রুহী, সুতপা, নিলয় আর জাহেদ ঝুম বৃষ্টিতে হেটে চলেছে ক্যাম্পাসের মুল সড়ক ধরে, ছাউনীতে দাঁড়ানো লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এমন পাগলামীর মানে খুজে চলেছে। সেটা ভাবার কোন অবকাশ তাদের ছিলনা ।সে , রুহী, সুতপা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে, হালকা নাচানাচিও করছে বলা চলা, নিলয় আর জাহেদ বাধ্য হয়ে এই পাগলামীর সাথী হয়েছিল। শুরুতে নির্লিপ্ত থাকলেও কিছু সময় পরে এ উচ্ছাসে তারাও গা ভাসিয়ে দিল। গলা ছেড়ে গান ধরল সবাই মিলে। হঠাৎ করে আসা সে বৃষ্টি হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। নিলয় আর জাহেদ ক্ষেপে উঠল। এই তোদের পাগলামীতে সায় দিয়ে এখন ভেজা কাপড় নিয়ে ঘুরতে হবে বলে তাদের মেজাজ একটু চড়ে গিয়েছিল বলা চলে। ভাজা কাপড় নিয়ে টং দোকানে চা খাওয়া শেষে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে জামা কাপড় মোটামুটি শুকিয়ে গিয়েছিল তারা খেয়াল করেনি। বাদল ধারার সাথে হালকা বাতাসের ঝাপটা আসায় সে ও যেন বাস্তবে ফিরে এল। মনটা তার হঠাৎ করেই আবার বিসন্ন হয়ে গেল। হারিয়ে গিয়েছিল সেই সব দিনে, যে দিন গুলো জীবনে আর আসবেনা, জীবনের সেরা দিন গুলো, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা সেই সব দিন গুলো।
কয়েকদিন আগে এমনই এক বৃস্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করার পর লিটন তাকে বলেছিল আমার মাথা খারাপ হয়নি, আমি স্কুলে পরিনা, মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। একন মন আরও খারাপ হলেও এই ভেবে ভাল লাগছে যে লিটনের সাথে সেদিন বৃষ্টিতে ভেজেনি বলে, বন্ধুদের সাথে বৃস্টিতে ভেজা সে সুখ স্মৃতিটুকুই সে ধরে রাখতে চায় জীবন ভর।
শ্রাবনী খেয়াল করেনি কখন যে তার চোখ দিয়েও লোনা জলের ধারা বয়ে চলেছে। লোনা জলের ধারা আর বাদল ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নিলয় এর সাহসহীনতার কথা ভেবে তার কান্নার বেগ যেন আরেকটু বেড়ে গেল। সদ্য কর্ম জীবনে প্রবেশ করা নিলয়কে সে যখন জানাল তার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে সেদিন ও সে নির্লিপ্ত। কি যেন বলতে চেয়েছিল, শ্রাবনী তাকে জিজ্ঞেস ও করেছিল, তুই মনে হয় কিছু একটা বলতে চাচ্সিস, না নিলয় সেদিন সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি। ক্যাম্পাস লাইফে কতবার তাকে বলেছিল তোর সাথে একটা কথা আছে, সে কথা সে কোন দিনও বলতে পারলনা। কান্না ধারা আরেকটু বাড়ল এই ভেবে সে কেন কিছু বলেনি, নিলয় যা বলত, সেওত তাই বলতে চেয়েছিল। মেয়ে হয়ে আগে বলবে এই সঙ্কোচ বোধ যে তার জীবন কে আজ এমন সিচুয়েশনে নিয়ে আসবে এমনটি দুঃস্বপ্নেওত সে ভাবেনি। কেমন আছে আজ নিলয় কানাডাতে, সেখানে কি বৃষ্টি হয়, নাকি শধু তুষারপাত। তুষারপাত কি বৃষ্টির মত এমন করে কান্না কে মুছে দিতে পারে। ভাবতে ভাবতে শ্রাবনীর গলা ধরে আসে। শ্ারবন ধারার সাথে সাথে তার কান্না ধারাও তীব্রতর হতে থাকে।
বাবা মার পছন্দ আর পাত্র পক্ষ তাকে পছন্দ করাই বরমাল্য পড়িয়ে দিতে খুব বেশী ভাবেওনি সে। নিলয়ের জন্য একটু অপেক্ষা ছিল বৈকি মনের গহীন কোনে, নিলয়ের নির্লিপ্ততা শুরুতেই সে আগুন নিবিয়ে দেয়। ভালইতো চলছিল সব। স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল এক একটা দিন। অবচেতন মনে ও সে কখনও ভাবেনি এমন করে বৃষ্টি দিনে তাকে কান্না লুকাতে হবে।
দুটি মোবাইল আর পকেটে বেশ কয়েকটি সীম থাকলেও লিটনের এ ব্যাপারটি নিয়ে সে কখনও ভাবেনি। দাম্পত্যে যার কোন অবহেলা নেই তাকে নিয়ে অযথা নেতী বাচক চিন্তা করাও পাপ। এমনই বিশ্বাস বোধে বেড়ে উঠা শ্রাবনীর পৃথিবী দুলে উঠেছিল এক শুভ্র সকালে যেদিন লিটন ভুল করে একটি মোবাইল বাসায় রেখে অফিসে চলে গিয়েছিল।
বারবার কল প্রথমে অগ্রাহ্য করলেও শেষমেষ সে ফোন ধরল এই ভেবে যে বলে দিবে লিটন ভুল করে ফোন রেখে গেছে বাসায়। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে রাগত স্বরে ফোন না ধরার কৈফিয়ৎ তলব।
শ্রাবনী বুঝতে পারছেনা কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে , এসব কি শুনছে, ঐ মেয়ে এসব কি বলে যাচ্ছে, ভেঙ্গে চূড়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে শ্রাবনী, সেদিন সে কেঁদেছিল, আজকের মতন করেই।
ক্ষমা করে দিয়েছিল সে। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন আবারও বোনা শুরু করেছিল সে। সব স্ভাবাবিক হয়েই আসছিল , লিটন শুধরে গেছে , পা ধরে যে ছেলে মাপ চাইতে গিয়েছিল, তার উপর সব বিশ্বাস আর আস্হা ফিরে আসছিল ধীরে ধীরে। অফিসের কাজে এক দুবার শহরের বাইরে গেলেও প্রতিবার নানা রকম উপহার নিয়ে এসে শ্রাবনীর মন তুষ্টির কোন কমতি ছিলনা।
দম বন্ধ হয়ে আসছে শ্রাবনীর, সমান তালে চলছে নোনা জলের ধারা আর শ্রাবন ধারাও। একটি বারও তার মাথায় আসেনি অফিসের কাজে বাইরে যাবার কোন প্রয়োজন নেই লিটনের। আর ভাবতে পারছেনা সে, প্রতিদিন যার জন্য শয্যায় অপেক্ষা করত হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা নিয়ে, সে ঘুরে বেড়াই নানা শয্যায়।
গতকাল সন্ধ্যায় লিটনের এক কলিগের সাথে যখন মার্কেটে দেখা হয় তার পর থেকেই মন মাঝে বয়ে চলা ঝড় সে আর সইতে পারছেনা। অনেক কিছুই তার আকাশে পরিষ্কার হয়ে যায়, সব দুই আর দুই এর যোগফল ই চার হয়ে যাচ্ছে। লিটনের লুকোচুরি গুলো সে যেন আজ সব ধরতে পারছে, প্রথম ঘটনার পরও কয়েকটি মেয়ের সাথে লিটনের কথা বলা সে যখন আবিষ্কার করে, লিটনের তাদেরকে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে সব সন্দেহ কে উড়িয়ে দেয়া, সে যেমন মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে কথা বলে তার সাথে তুলনা...............................শ্রাবনী আর ভাবতে পারছেনা, সে আর ভাবতে চাচ্ছেওনা। এই সম্পর্কের পরিণতি সে ঠিক করে ফেলেছে। শুধু লিটনের মুখে সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চপেটাঘাতের জন্য সে অপেক্ষা করছে আগামীকাল সকাল পর্যন্ত।
কেটে যাওয়া বিগত দিন গুলো তার আকাশটাকে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। আকাশ আর শ্রাবনী- দুয়ের চোখেই আজ শ্রাবন ধারা।
বউমা ডাকে হঠাৎ করে শ্রাবনী সম্বিৎ ফিরে পেল। বউমা শব্দটি কেমন অতীত মনে হলে ও সে স্বাভাবিক থাকল অনেক কষ্ট করে। তোমাকে আমি পুরা ঘরে খুজে শেষে ছাদে আসলাম। কি হইছে তোমার বৃষ্টিতে ভিজতেছ, জ্বর আসবেত। কেমন করে বলবে একটা জ্বরই তার কাম্য। ঘাম দিয়ে যেমন জ্বর ছাড়ে তেমন করে সেও সব কিছু ছেড়ে যাবে কালই, হ্যাঁ কালই।
কি মনে করে শ্রাবনী শ্বাশুরীকেও বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রন জানিয়ে বসল। আর শ্রাবনীকে অবাক করে তিনিও সে আমন্ত্রনে সায় দিয়ে বসলেন। বউ শ্বাশুরী হাতে হাত ধরে শ্রাবন ধারায় ভিজতে লাগল, স্কুল পড়ুয়া দুকিশোরী যেন বাড়ী ফেরার পথে হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ভিজছে, যে কারো দেখলে এমনটিই মনে হবে। শ্বাশুরী কিছু সময়ের জন্য শ্রাবনীকে ঘুড়িয়ে আনলেন তার নিজের শৈশবের বৃষ্টি ভেজা দিন গুলোতে, বিয়ের পর তার ও এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করলেও , কাউকে বলতে না পারার সে বেদনা বের হয়ে আসল।
শ্রাবনী অজান্তেই শ্বাশুড়ীকে আলোড়িত কিছু সময় দিয়ে গেল যার স্মৃতি আমৃত্যু বয়ে বেড়াবেন ঐ মহিলা। শ্বশুরের অবাক করা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বউ শ্বাশুরী যার যার রুমে ঢুকে গেল।
ছোট বেলায় বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় এলে মা সাথে সাথে ঠেলে গোসল খানায় ঢুকিয়ে দিতেন । বৃষ্টির পানি শরীরের জন্য ভাল না, তাই তাড়াতাড়ি গোসল করে নেয়াই ভাল। দুই প্রজন্মের আনন্দমাখা কিছু সময় বেশী ক্ষন তার মনে ঠাঁই পেলনা, মায়ের কথা মনে করে শ্রাবনীর চোখে আবারও শ্রাবন ধারা ভর করল।
মা যেন সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন এমনটি ভাবতে ভাবতে শ্রাবনী নিজেকে আবার সপে দিল ঝর্না ধারার নীচে।
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়
অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?
অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুষের ধর্ম নাই
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।
হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।
পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update
মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-
গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??
সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন