বাদশাহ হুমায়ুন বাদে প্রায় সব মুঘল সম্রাটই ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। ঘুমিয়ে বা অবসর কাটিয়ে সময় ক্ষেপণের নজির তাদের কম। কিন্তু তাদের ব্যস্ততার সবটাই কি রাষ্ট্রীয় কাজে না কিছুটা ব্যক্তিগত কাজে এ প্রশ্নটা সহজেই উঠতে পারে। যেমন : সম্রাট আকবর বহু বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন পন্ডিতদের সঙ্গে দর্শন বিষয়ে আলোচনা করে। আবার শিকার করতেও বহু দিন ব্যস্ত থাকতেন সম্রাটরা কিংবা শিল্পকলা নিয়েও তাদের আগ্রহ ছিল এসব কাজ তাদের ব্যক্তিগত কাজ না রাষ্ট্রীয় কাজ এ পার্থক্য নির্ণয় নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি।
সম্রাট আকবরের অনুরোধে তার দরবারে এসেছিলেন জেসুইট ফাদার আন্তনিও মনসেরাট। মনসেরাট জানিয়েছেন, দরবারে সময় দেখতে একটি জলঘড়ি ব্যবহার করা হতো। প্রাসাদের সব কাজই চলত এ ঘড়িকে অনুসরণ করে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও মুঘল সম্রাটদের দৈনন্দিন জীবন-যাপন ছিল যথেষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় মুঘল দরবারে এসেছিলেন ইংরেজ কূটনীতিক চার্লস রো। রো জানিয়েছেন, সম্রাটদের জীবনযাত্রা ছিল ঘড়ির সময় অনুসারে নিয়ন্ত্রিত। তবে সব কিছুর পরও সম্রাটরা তাদের দৈনন্দিন রুটিন নিজেরাই ঠিক করতেন এবং নিজেদের খেয়ালখুশি মতো বদলে নিতেন। সম্রাট আকবর সাধারণত সকাল ৯টায় তার গণদরবারে বসতেন। কিন্তু আবুল ফজল জানিয়েছেন মাঝে মাঝে আকবর শেষ বিকালে এমনকি রাতের বেলায়ও দরবারে বসতেন। মাঝে মাঝে সম্রাটরা দৈনন্দিন কাজ ফেলে ছুটতেন শিকার করতে বা বিকালে যমুনা নদীতে বেরোতেন নৌবিহারে। তবে এগুলো ব্যতিক্রম। সাধারণত তারা কঠোরভাবে তাদের দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলতেন, তা সে তারা প্রাসাদেই থাকুন বা অস্থায়ী তাঁবুতেই থাকুন। শুধু যুদ্ধাবস্থাতেই ঘটত এ নিয়মকানুনের ব্যত্যয়। সম্রাটদের এ কঠোর নিয়মানুবর্তিতাকে দেখা হয় তাদের প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে অক্ষুণ রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে। কারণ সম্রাটরা তাদের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে তা সম্রাটের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলার আশঙ্কা তৈরি করত। নিজেদের প্রতিদিনের রুটিন অক্ষুণ রেখে তারা জনগণকে আশ্বস্ত করতেন যে সম্রাট এবং সাম্রাজ্য সবই ঠিক আছে। আর তাই অসুস্থ থাকলেও তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের রুটিন কাজগুলো করে ফেলতেন।
সম্রাট আকবরের দৈনন্দিন কাজের হিসাব পাওয়া যায় আবুল ফজলের বর্ণনায়। আকবর দিনের দুই ঘণ্টা সময় কাটাতেন প্রার্থনায়। এক ঘণ্টা বিশ মিনিট কাটাতেন ব্যক্তিগত কাজে, সাড়ে চার ঘণ্টা দরবারের কাজে, এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট কাটাতেন নিজের পোষা হাতি, ঘোড়া, চিতা ও অন্যান্য পশুর সঙ্গে। দিনে নিজের খাওয়া দাওয়া এক ঘণ্টারও কম সময় ব্যয় করতেন আকবর। হেরেমে কাটাতেন ছয় ঘণ্টা আর ঘুমাতেন সাড়ে সাত ঘণ্টা।
সম্রাটদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে প্রধান ছিল দর্শন (সাধারণত ভোরবেলায় সম্রাট সাধারণ মানুষদের দেখা দিতেন যাকে দর্শন বলা হয়), গণদরবার, খাশদরবার, মন্ত্রীদের নিয়ে সভা এবং হেরেমে বসে শেষ করতেন গোপনীয় ও প্রাসাদ সম্পর্কিত কাজ। এছাড়া ছিল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন। তবে এসব কাজে সব মুঘল সম্রাট একই রকম সময় দিতেন না। এটা মূলত নির্ভর করেছে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ, রুচি ও আদর্শের ওপর। যেমন : নামাজ ও কোরআন পড়ায় সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু আওরঙ্গজেব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন তুলনামূলকভাবে দেরিতে। তার পূর্বসূরিরা সবাই ঘুম থেকে জাগতেন ৪টায় আর আওরঙ্গজেব জাগতেন ৫টায়। তবে একটা নিয়ম সব মুঘল সম্রাটের সময়েই বজায় ছিল, সেটা হলো শুক্রবার কোনো দরবার বসত না। আর আওরঙ্গজেব এর সঙ্গে বৃহস্পতিবারকে অর্ধ কর্মদিবসে পরিণত করেন।
আবুল ফজল জানিয়েছেন, সম্রাট আকবর ঘুম থেকে উঠতেন ভোর ৪টায়। তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর বাদকরা মিষ্টি সুর বাজাত। সম্রাট হুমায়ুন তার কাছে রাখতেন একটা সাদা মোরগ। এ মোরগই সকালে তাকে জাগিয়ে দিত। হুমায়ুন মোরগটিকে নিয়মিত কিশমিশ খাওয়াতেন। সম্রাটরা সূর্য ওঠার আগে পোশাক পরা, নামাজ ইত্যাদি সেরে নিতেন। তারপর দিনের প্রথম সূর্যকিরণ পৃথিবীতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটরা তাদের প্রাসাদের ব্যালকনিতে (ঝারোখা) দাঁড়াতেন প্রাসাদের বাইরে জমায়েত হওয়া সাধারণ মানুষকে দেখা দিতে। এ দর্শন প্রথা মূলত একটি মুসলিম শাসনপূর্ব রীতি, যা হুমায়ুন গ্রহণ করেছিলেন। আর ভোরবেলা দর্শন দেয়ার সময় নির্ধারণ করেছিলেন আকবর। কিন্তু অনৈসলামিক বলে আওরঙ্গজেব এ প্রথা বাতিল করেন। যদিও মুঘল সম্রাটদের জন্য এ প্রথা সেই সময়ের বিবেচনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এ দর্শনের মাধ্যমে জনগণ নিশ্চিত হতেন যে সম্রাট জীবিত আছেন। সম্রাট যদি একদিনের জন্যও এ দর্শন থেকে বিরত থাকতেন, তাহলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের গুজব রটে যেত যা অনেক সময় দাঙ্গা পর্যন্ত গড়াত। আর তাই এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কথায়, এমনকি অসুস্থ অবস্থাতেও যথেষ্ট কষ্ট হলেও নিয়ম মেনে আমি প্রতিদিন ঝারোখাতে যেতাম। সম্রাটরা ঝারোখাতে থাকতেন ৪৫ মিনিট। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা হাতির লড়াই, অশ্বারোহী সৈনিকদের কুচকাওয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের কসরত দেখতেন। এ সময় সাধারণ মানুষ তাদের অভাব অভিযোগ লেখা বার্তা প্রাসাদ থেকে ঝুলিয়ে দেয়া দড়িতে বেঁধে দিতেন। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতেও মানুষ ঝারোখার বাইরে জমায়েত হতেন। যেমন, ১৬৪১ সালে লাহোরের দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত মানুষ ত্রাণ চেয়ে সম্রাট শাহজাহানের প্রাসাদের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন। আর আওরঙ্গজেব পুনরায় জিজিয়া কর আরোপ করায় ১৬৭৯ সালে হিন্দুরা এর প্রতিবাদ জানাতে জমায়েত হয়েছিলেন তার প্রাসাদের বাইরে। আকবর ভোরে ঝারোখায় অল্প সময় থেকে খাসকামরায় চলে যেতেন। জাহাঙ্গীরও ভোরে অল্প সময় থেকে তন্দ্রা নিতে যেতেন এবং দুপুরে আবার ঝারোখায় দাঁড়াতেন।
দর্শনের পর সম্রাটদের পরবর্তী কর্মসূচি থাকত দিওয়ান-ই-আমের দরবার। এ দরবারে সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকতেন। দরবারের সময়সূচিতে বিভিন্ন সম্রাটের সময় ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণভাবে আকবরের দরবার বসত সকাল ৯টায়, জাহাঙ্গীর দরবার বসাতেন বিকালে, শাহজাহানের দরবার বসত সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে আর আওরঙ্গজেবের ৯টা ৪০ মিনিটে। আকবর এবং জাহাঙ্গীর তাদের গণদরবার বসাতেন আগ্রার প্রাসাদের দরবার প্রাঙ্গণে। কিন্তু শাহজাহান সে স্থানে দর্শনীয় এক দিওয়ান-ই-আম নির্মাণ করান। ৪০টি স্তম্ভবিশিষ্ট এ স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল লাল বেলে পাথর।
দরবারে সম্রাটের সিংহাসনের নিচে রাজকীয় চিহ্ন হাতে দাঁড়িয়ে থাকত দরবারের নির্দিষ্ট বাহকরা। সম্রাটের প্রহরায় থাকত একটি নির্দিষ্ট প্রহরীদল। সম্রাটের ব্যক্তিগত এসব ভৃত্যের আগমনের মাধ্যমে সম্রাটের আসার সময় হয়ে গেছে বলে বুঝে নিতেন দরবারের উপস্থিতরা। পিনপতন নীরবতা আর মনোযোগে সবাই সম্রাটের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। দরবারের উপস্থিতদের আসনবিন্যাস নিয়ন্ত্রিত হতো কঠোরভাবে। আমির, রাজা এবং বিভিন্ন দেশের দূতরা সম্রাটের সবচেয়ে কাছে বসার সুযোগ পেতেন। তাভেরনিয়ার জানিয়েছেন দরবার চলাকালে ব্যাকগ্রাউন্ডে মিষ্টি, হালকা বাজনা বাজত। সম্রাট দরবারে প্রবেশ করতেন সিংহাসনের পেছনে থাকা দরজা দিয়ে। আবুল ফজল জানিয়েছেন, সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসার পর সবাই কুর্নিশ করতেন এবং দুহাত সামনে ক্রস আকারে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর দরবারের নীরবতা প্রসঙ্গে মানুচ্চি জানিয়েছেন, মুঘল দরবারে যে নীরবতা বজায় রাখা হতো সেটা এক কথায় বিস্ময়কর। তাভেরনিয়ারের বর্ণনা মতে, দরবারে যাতে এমন কোনো ঘটনা না ঘটে যা সম্রাটকে বিরক্ত করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য সোনা ও রুপার লাঠি হাতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করত। বিশেষ অনুমতি ছাড়া সম্রাট উপস্থিত থাকা অবস্থায় কেউ দরবারে প্রবেশ বা প্রস্থান, নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নড়তে পারতেন না। দরবারের উপস্থিত হওয়ার জন্য কিছু ড্রেস কোডও ছিল। যেমন, নীল রঙের পোশাক পরে সম্রাটের সামনে আসা নিষেধ ছিল, কারণ নীল দুঃখের রং। দরবারে মৃত্যু শব্দটিও কেউ উচ্চারণ করতে পারতেন না। দরবারের ড্রেস কোড ভঙ্গ করলে সেজন্য শাস্তিও দেয়া হতো। আওরঙ্গজেবের চিঠিতে এমন একটি ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব লিখেছেন, আজ মারহামাত খান আমার উপস্থিতিতে খুব দামি পোশাক পরে এসেছিল। তার পোশাক এত লম্বা ছিল যে তার পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছিল না। আমি তাকে নির্দেশ দিলাম তার পোশাকের নিচের দিকের দুই ইঞ্চি কেটে ফেলতে।... দরবারের পোশাককে অবশ্যই দরবারের জন্য নির্ধারিত দৈর্ঘ্যরে হতে হবে। গণদরবারে সম্রাট ছাড়া শুধু সম্রাটের যে পুত্র ভাবি সম্রাট তারই একমাত্র বসার অনুমতি থাকত। আকবর তার সময়ে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়মের দুবার ব্যত্যয় করেছিলেন। যে দুজন আকবরের দরবারে তার পাশে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের একজন হলেন আকবরের বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয় সুলায়মান মির্জা এবং অন্যজন হলেন বাদাকশানের পলাতক রাজা।
গণদরবারের পর সম্রাটরা যেতেন দিওয়ান-ই-খাস-এ। দিওয়ান-ই-খাসে সম্রাট বৈঠক করতেন সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ও বিদেশি দূতদের সঙ্গে। খুব কম সংখ্যক মানুষের এ দরবারে প্রবেশের অনুমতি থাকত। এ দরবারে মদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষেধ ছিল, এমনকি সম্রাটদের মধ্যে অত্যধিক মদ পানকারী জাহাঙ্গীরের সময়েও এ নিয়ম পালন করা হতো। কারণ এ দরবারে রাষ্ট্রের জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হতো, তাই এখানে মদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রীয় আদেশ নির্দেশ এ দরবার থেকেই চূড়ান্ত করতেন সম্রাট। আসরের নামাজ পড়ে শাহজাহান আবার দিওয়ান-ই-খাসে যেতেন অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে শাহজাহান হেরেমে প্রবেশ করতেন। তবে এখানেও কাজ শেষ হতো না তার। হেরেমে বসে তার গুপ্তচরদের পাঠানো বার্তা পড়তেন শাহজাহান। ঘুমানোর আগে শাহজাহানকে বই পড়ে শোনানো হতো। শাহজাহানের প্রিয় বইগুলোর মধ্যে ছিল তার পূর্বপুরুষ বাদশাহ বাবরের আত্মজীবনী, তৈমুরের জীবনী, ভ্রমণ, ইতিহাস সংক্রান্ত বই।
তথ্যসূত্র
এরালি, আব্রাহাম, দ্য মুঘল ওয়ার্ল্ড; লাইফ ইন ইন্ডিয়াস লাস্ট গোল্ডেন এজ, পেঙ্গুইন বুকস, নয়াদিল্লি, ২০০৭
এরালি, আব্রাহাম, এম্পেররস অব দ্য পিকক থ্রন, পেঙ্গুইন বুকস, নয়াদিল্লি, ২০০৭