somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাহলে এইবারের বস্তি পোড়ার জন্য আমরা চাঁদকে দোষারোপ করতে পারি

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইশ হোল না, আরেকবার ট্রাই করতে হবে। যেই স্ন্যাপটা খুজছিলাম সেটা পেলে এইবার ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর জন্য একটা সেইরকম জিনিস হইত। দেখি কালকে সকালে আবার ট্রাই করতে হবে। কিন্তু আজকে রাতে হলেই বেশি ভালো হত, কন্ট্রাসটা পাওয়া যেত। একদম নিচ থেকে একটা শট। নিচে পানিতো আছেই, উপরে আগুন আর সেই আগুন থেকে একটা বাচ্চা জীবন বাচানোর জন্য পানির দিকে তাকিয়ে আছে, আগুনের কারণে লাফও দিতে পারছে না। পানিতে বাচ্চাটার শরীরের আগুনের রিফ্লেকশন আর চারপাশে বস্তি পুড়ে যাবার দাউদাউ আগুন। একটা কালজয়ী শট; ইউনিসেফ, ইউএন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ওয়ার্ল্ডপ্রেস ফটো এক ছবিতেই কুপোকাত। কিন্তু কোন বাচ্চা কিংবা নিদেন পক্ষে কোন নারীকে জ্বলন্ত পুড়তে দেখা গেলনা। নিশ্চয়ই মারা গেছে কয়েকজন, কিন্তু কতজন কি সেটা বের করাই তো মুশকিল, পুরো জায়গাটা ভষ্ম হয়ে গেছে। দেখি কাল সকালে আবার.......... হয়ত ঝিলের ভেতর থেকে কোন পোড়া লাশ ভেসে উঠবে। লোকে বলে, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া........”।



৩রা নভেম্বর ঢাকার পত্রিকা বা নিউজ চ্যানেলের বক্তব্য হবে এরকম। ঢাকা শহরের বা এর বাইরের বড় বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বস্তির পুড়ে যাওয়া খবর প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে । অনেকেই অনুমান করেন যে এই রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের পিছনে নানান অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। যেমন গতকাল ২রা নভেম্বর রূপনগর সংলগ্ন ঝিল পাড় বস্তিতে আগুন লেগে প্রায় পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। রাত ৯টা নাগাদ এলাকার মানুষ জন পুব-আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে এগিয়ে যায়। মূলত ঝিলটিকে কেন্দ্র করেই এই বস্তি গড়ে উঠেছিল। ঝিলের পানি দখল করে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের মদদে এই বস্তিটি গড়ে ওঠে সেই ৯০ এর দশক থেকে। এখানে বাঁশের মাচা করে খুবই ঘনভাবে অনেকগুলো ঘরও তৈরী করা হয়েছিল, যেখানে বস্তিবাসী মানুষজন বসবাস করতেন। এখানেই দরিদ্র মানুষের আশ্রয় গড়ে উঠেছিল। স্থানীয়রা প্রাথমিকভাবে অনুমান করছেন যে অবৈধ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ফলেই এমনটা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে হতাহতের খবর কেউই বলতে পারছেন না। নারী শিশু বৃদ্ধ সহ অনেকেই এখন পর্যন্ত নিখোঁজ। খুব আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় বস্তিবাসী অনেকেই তাদের মালামাল নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে পারেন নি। এদিকে রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামের কারণে ও আগুনের খবর জানাতে দেরী হওয়ায় দমকল বাহিনীও ঠিক সময়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারেনি। বাস্তুচ্যুতি ও স্বজন হারানোর আহাজারীতে সেখানকার পুরো পরিবেশ থমথমে হয়ে রয়েছে।


আগুনের বস্তি।


আমি জানি না প্রতিটা সকাল তার রাত্রির ইঙ্গিত দেয় কিনা। আজকে সকালে উঠে প্রথম যে ছবিটা তুলেছিলাম সেটা এইটা, এত রক্তিম এত দাউ দাউ আকাশ।

কিন্তু সারাদিন অফিস করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি, তখনি দেখি পুব আকাশ দাউদাউ করে জ্বলছে। আর মানুষের ঢল ছুটে চলেছে আগুনের উৎসের দিকে, তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে এই লেলিহান আগুন নেভাতে।



অসহায় মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে যতটুকু সম্ভব সম্বল বাঁচানো যায়। কি কষ্ট আর শ্রমের বিনিময়ে যে এই অর্জন তা আমরা অনেকে কল্পনাও করতে পারবো না।



নৃশংস শহরে শেষ আশ্রয় হারানো যে কি সেটা অনুমান করাও অন্য শ্রেনীর জন্য দু:সাধ্য।


অপরাপর বিত্ত থেকে সাধারনত অভিযোগ করা হয় যে বস্তি নিজেই সকল অপরাধের উৎস। কিন্তু পরিষ্কার কথা হল, প্রতিটা সামন্ত এলাকার বিত্তবানদের বিলাসের জন্য যে স্বস্তা শ্রমের প্রয়োজন, দেহের প্রয়োজন সেগুলো সরবরাহের জন্যই বস্তির সৃষ্টি। খেয়াল করে দেখবেন ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকার চারপাশে বস্তি রয়েছে। আর এসব বস্তি সেই মানুষগুলোর জন্য যারা তাদের শ্রম অনেক কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাদের আশ্রয়ের জন্যই এই বস্তি। বস্তি হল মহানগরের উপদংশ লুকাবার স্থান।


আজ যে বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে গেল তাতে আশপাশের কত যে গার্মেন্টস কর্মীর কত যে রিকশা চালকের সারাজীবনের সঞ্চয় আর স্বপ্ন পুড়ে গেল সেই বাস্তবতা বুঝবেন না অনেকেই। নিম্ন আয়ের কত মানুষের সারা জীবনের কষ্ট করে গড়ে তোলা সম্ভাবনা যে পুড়ে গেল সেটাও অনেকেই আন্দাজ করতে পারবেন না।



রইল অবৈধ পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের কথা। এটাতো সরকারই নিশ্চিত করেছে, যাতে বস্তিবাসী মানুষজন সবসময় অবৈধ থাকেন। কারণ কোন হোল্ডিং নাম্বার ছাড়া সরকারের তরফ থেকে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের কোন বৈধ বিতরণ ব্যবস্থাই নেই। আর বস্তিতে হোল্ডিং নম্বর দেবে কে? ফলে সরকারের ব্যবস্থার মধ্যেই বৈধতার কোন স্থান নেই।



(দমকল এল, কিন্তু যখন এল ততক্ষণে যা পুড়ে যাবার তা পুড়ে গেছে।)

আরেকটা কথা। আমার পরিচিত এক বস্তিতে বৈধভাবে পানির বিল দেবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল, বিশেষ ব্যবস্থায়। দেখা গেছে যে দশ বছরে তাদের বিল দেবার সময় ও তারিখ ম্যানটেইন মধ্যবিত্তের চাইতে কয়েকগুনে ভালো। তারা নিয়মিত বিল দিয়ে গেছেন একবারও খেলাপী হয়নি। কিন্তু এরপরও তারা সব ধরণরে ভালনারিবিলিটির কেন্দ্রে বসবাস করেন। তারা হলেন মহানগরের রেফিউজি।



কি নিয়ে তর্ক হবে আর, রাষ্ট্রের সিস্টেমেটিক কিলিং আর নাগরিক ভাগাড় তৈরীর বৈধতা নিয়ে? আমার আর আগ্রহ জাগে না।



কারণ সেটা অনেক আগেই ব্যবস্থার মধ্যে এমবেডেড। আমরা ভোগ করবো আমাদের ভোগের জন্য একদল দাস থাকবে, তারা বস্তিতে থাকবে এবং আমাদের কাছে পরিষ্কার হাইজিন হয়ে আসবে। আমরা আবার তাদের নিয়ে এনজিও করবো, আর্ট কালচার করবো। তারা আমাদের সামনে আগুনে পোড়া ছাই হয়ে আসবে, লাল আর ছাই রংএর কড়া কন্ট্রাস্ট হয়ে আসবে।



আমরা দরিদ্রের ছবি বেচবো, আর নিজের ট্যাক ভর্তি করবো...বস্তি থাকবে...এনজিও আর দরিদ্র-বেচা আর্টকালচার থাকবো। প্রদর্শনী শেষে আমাদের গ্যালারী বস্তিবাসী পরিষ্কার করে দিয়ে যাবেন।



বস্তির মানুষদের এরকম করেই অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।



এনজিও হবে আর্টকালচার হবে, কোর-পেরিফেরি হবে আর মহানগরের উপদংশ নিয়ে বস্তি বেঁচে থাকবে। ধর্ষিত হবে, ধর্ষিত নারীর শিশুকে জন্ম দেবে আর সভ্য পরিষ্কার মানুষেরা তোরা বস্তির মেয়ে বস্তির ছেলে বলে গাল দেবে আবার যুবতী বুয়ার তাজা বুকে হাত বুলিয়ে অধরা সঙ্গম স্বাদ আর অপরাধ বোধে ভুগবে।



ছবি তুলে যখন ফিরছিলাম তখন আর্টকালচারের এক বন্ধুর সাথে দেখা। দেখা হওয়া মাত্রই তার আবদার; ছবি তুলে দিতে হবে। সবার প্রথমে আমি বললাম আমি বললাম জানো আধঘন্টার আগুনে ৫০০ ঘর পুড়ে শেষ। ঔযে দেখা যাচ্ছে এখনো আগুনের রেশ। ও বলল আমি জানবো কিভাবে আমি তো বাইরে ছিলাম, আমি তো নাটকের রিহার্সেলে ছিলাম, এইমাত্র এলাকায় নামলাম। কিন্তু ও একবারও বলল না চল গিয়ে দেখি কি হয়েছে অন্তত দেখে আসি। শ্রেণীর গল্পে আমরা সবসময় এরকম বাইরেই থাকি। আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তি আমাদের অনেক অনেক দূরে, শুক্রবারের সাপ্লিমেন্টের পাতায়।

তো তার আবদার ছিল এই কোরবানীতে অনেক গুলো বিভৎস জবাইয়ের ছবি তুলতে হবে যেটা দিয়া নাটকের বলি দৃশ্যের জন্য একটা ১মিনিটের স্লাইড শো হবে। আমি মনে মনে বলি মহানগরের বলি নিয়ে বস্তির আগুন নিয়ে নাটক হইলে সেইটা তো আরো বিভৎস হয়, রগরগে হয়। তখন না হয় একটা পোয়েটিক কনক্লুশনও দেয়া যায়। আজকের মতই।

যেমন, আজকে এই বস্তি পুড়ল কেন? কারন অন্য বিত্তের মানুষ জনের আকাশে আজ অনেক সুন্দর একটা চাঁদ উঠছে এই জন্যে।



বি:দ্র: প্রথমে ভাবলাম একটা খবর হিসেবে ছবি সহ দিলে পোষ্ট অনেক ব্লগ ব্লগ হইব। ইনফো ইনফো লাইভ লাইভ হইবো। কিন্তু এই সব বালের কি দরকার, আমি যেটা যেমনে প্রকাশ করতে চাই সেটা সেভাবে দিলেই তো আসল কথা কওন হয়।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ৭:৫২
২৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×