বনানী ফ্লাইওভার থেকে নীচে নামছি। অফিসের দিকে আজ একটু সকাল সকালই ছুটছি। ফ্লাইওভারের ঢাল শেষ হলেই আর্মি স্টেডিয়াম, এরপর মাছরাঙ্গা টেলিভিশন, এরপর বনানী গোরস্তানে ঢোকার রাস্তাটা...। পুরোটাই ছক কাটা।
সামনের একটা সবুজ সিএনজিকে পাশ কাটিয়ে, ঠিক সামনেই দেখি একটা নিশান এসইউভি দাঁড়িয়ে আছে। ওটাকে বামে রেখে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে না যেতেই দেখি রাস্তার ডানদিকে ছোপ ছোপ রক্ত। আর্মি স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখে একটা ছোট জটলা। একজন বয়স্ক বৃদ্ধা মহিলাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে ফুটপাতে। তাঁর ডানদিক থেকে থকথকে রক্তের ধারা ফুটপাতের আইল্যান্ড থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে এবং এসইউভির ড্রাইভার তাকে পানি খাওয়াচ্ছেন।
এক্সিডেন্টটা ঘটেছে পাঁচ থেকে সাত মিনিট আগে। একটি মিনি ভ্যান প্রচন্ড গতিতে এসে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে। মরণঘাতি আঘাতে বৃদ্ধা মহিলার ডান পা ফেটে ভেঙ্গে মাংস বেরিয়ে একটা ভয়াবহ অবস্থা। তিনি যে তখনো বেঁচে আছেন সেটাই একটা বিষ্ময়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হল একটু দূরে পাশেই আর্মির অনেকে ঘুরে বেড়ালেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না।
নিকটবর্তী হাসপাতালে নেয়াটা খুব জরুরী। তাই প্রথমেই ফোন দিলাম, একজন সাংবাদিক ছোট ভাইকে, এরপর আরেকজনক ব্লগারকে। যদিও সকাল সকাল বলে কাউকেই পাওয়া গেল না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ডিএমপির...। ওকে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালাম। আমার বন্ধুটি স্থানীয় পুলিশদের জানিয়ে দিল। এদিকে সময়ও ফুরিয়ে আসছে। এসউইভির ড্রাইভার রশিদ তখনো বৃদ্ধাকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ঠিক সে সময় রাস্তার ওপাশ দিয়ে একটা পুশিল ভ্যান যাচ্ছিল; সেটাকে থামিয়ে একজন সাব ইন্সপেক্টরকে আসতে বললাম। তিনি এলেন, আমার বন্ধুর সাথে তার কথাও হল। এদিকে মহাসড়কে শ্রেফ বিবেকের কারনে থেমে থাকা গুটি কয়েক মানুষজন না পারছিলেন থামতে না পারছিলেন ছেড়ে যেতে। রশিদ এবং আমি পুলিশের কাছে সেই অর্ধমৃত, গরীব, টোকাই, হয়তো ভিক্ষুক বৃদ্ধাকে বুঝিয়ে দিতে গিয়েই একজন জানালেন, সেই বৃদ্ধা সেই মুহুর্তে মারা গেছেন, (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজেউন ...)। এইভাবে তিনি আমাদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। গুটি কয়েক মানুষের জটলাটা ফিকে হয়ে এল। ডিএমসিতে নেয়া ঠিক হবে কিনা, পোষ্ট মর্টেমে কতটাকা খরচ হবে পরিবারে, সেটা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে এক একজন করে সরে যেতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত টিকে রইলাম আমি আর রশিদ। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন আবার বাইক স্টার্ট দিয়েছি তখন জানিওনা কখন খালি পেটেই সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছি। আর ঠিক পেছনেই নতুন নতুন টায়ারের ঘষায় রক্তের দাগ ততক্ষণে প্রায় শুকিয়ে গেছে।
এই শহরটা নিষ্ঠুর অনেক; এই শহরে মানুষ মরলেও অন্য মানুষ আর এগিয়ে আসেনা। তাদের থাকে পুলিশের ভয়, বিব্রত হবার ভয়। এই শহরের মানুষগুলো যান্ত্রিক-নির্বিকার, পাশে একটা আস্ত স্টেডিয়াম অথচ সেখানে মৃত্যু-পথযাত্রীকে সাহায্য করার কেউ থাকেনা। এই শহরে কবর হয়না, এই শহর একজন আস্ত মানুষের মৃত্যুতেও সময় দেয় না। গরীব মানুষটার লাশ আরো গরীব হয়ে যায় থেঁতলে যাবার পর। গরীব লাশের রক্তের বিনিময়ে শহরে গড়ে ওঠে নতুন নতুন ফ্লাইওভার আর সেখানে চলে নতুন নতুন টায়ারের গাড়ী।