'১'
পাজামার ফিতেয় জটিল গিট্টু লেগে গেছে। হাতের পাচ আঙুল, মুখের বত্রিশ খানা দাত দিয়ে চেষ্টা করেও খুলতে পারছি না। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে গেছে পাঞ্জাবীটা। যত সময় গড়াচ্ছে তত তেতে উঠছে মুখ। নীরা বেনারসি পড়ে বিছানায় বসে খিলখিল করে হাসছে। হাসির শব্দের সাথে আমার তেতে ওঠার পরিমাণ সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। এত তেতে গেলাম যে মনে হলো গালের ওপর ডিম ভেঙে দিলে ডিমাভাজা হয়ে যাবে।
এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কাল রাতে প্রচন্ড জ্বর এসেছিল, তা দেখছি আজ বিকেল পর্যন্ত ও ভোগাচ্ছে।
পাশে লাল মগটায় পানি তোয়ালে রাখা। মাথা ভেজা। দরজাটা হাট করে খুলে রাখা। এই মেসে কে কি করল তা নিয়ে মাথা ব্যাথার কারন না থাকলেও আমার মাথা অযথাই ব্যাথা করতে লাগল। যতদূর সম্ভব খালার কাজ। আশেপাশে অবশ্য খাবার বাটি দেখতে পেলাম না। খাবার বাটি হাতে ছাড়া তার এ ঘরে ঢোকা নিষেধ। এ সমন্ধে বিস্তারিত একটা নোটিশ বড় বড় করে দরজায় ঝোলানো আছে। শেষবার নীরা এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তার মতে খালার নজর খারাপ। এ নিয়ে অবশ্য প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছে তার সাথে । নীরাকে নজর বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবী করার এক পর্যায়ে সে হাত ব্যাগ তুলে হাই হিলের খটাখট শব্দে বেড়িয়ে গেছে।
সেদিন যেভাবে খটাখট শব্দ তুলে চলে গেছিল আজ সেভাবেই ঘরে ঢুকল।
'ও ঘুম ভাঙল তাহলে'
ওর কথা শুনে মনে হল যেন আমার ঘুম ভাঙাটা খুব বড় ধরনের অপরাধ। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
'থাকো কিভাবে এখানে? সামান্য পানিটুকু পাওয়া যায় না! শেষমেশ তোমার খালাকে পাঠালাম পানি আনতে। সেই যে এক মগ পানি এনে দিয়ে গেল তো গেলই। আর তুমি কি বলত! এত জ্বর! একটা খবর পর্যন্ত দিলে না?'
' আমার বোধহয় তোমার সাথে আর কোনদিনও যোগাযোগ না করার কথা ছিল'
ডায়েরীটা হাতে তুলে বেশ প্রতিবাদী ভঙিমায় বলে উঠল নীরা,
'এই যে এত কিছু লেখ, এত কিছু পড় আর এটুকু জানো না ''কথা দেয়া হয় সেটা ভাঙার জন্যে"।
আমি কেটে কেটে বললাম, 'আমাদের বোধহয় বিয়ে করার কথা ছিল'
নীরা হেসে ফেলল, পরক্ষনেই গম্ভীর হয়ে গেল, "কিছু কথা দিয়ে রাখতে হয়, নয়ত পরে পস্তাতে হয়"।
এবার আমি হেসে ফেললাম, "বেশ বলেছ তো। এক কাজ কর ডায়েরীতে লাইনটা লিখে ফেল"।
"লিখে কাজ নেই। তোমার জ্বর কেমন?"
"বোধহয় নেই, তুমি এসেছ আর্ধেক কমে গেছে"।
আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরা হঠাৎই কেদে ফেলল।
আমাদের প্রেমের প্রথম রাতের অনেকগুলো দেয়া কথার মাঝে আমার দেয়া একটা কথা ছিল যে, আমি কখনোই নীরার চোখে জল গড়াতে দেবো না।
আমি পাশ ফিরলাম। কিছু কথা দেয়াই হয় ভাঙার জন্যে। এটাও নাহয় ভাঙুক।
'২'
"ভাইজান?"
"খালা আপনাকে না কতবার বলছি আমাকে ভাইজান বলে ডাকবেন না, আরেকবার বললাম। মনে থাকে যেন।"
"জ্বে ভাইজান মনে থাকব" বলে জিভ কাটল খালা।
আমি হতাশ চোখে তাকালাম। এই মহিলার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।
"সোহাগ ভাই বইল্ল, এখন থাইকা নাহি আপনার রুমে যহন তহন ঢুইকা পড়বার আনুমতি পাইছি, হাছা নাহি?"
"না হাছা না। নোটিশ সরানো হয়েছে মানে এই না যে আপনি যখন তখন রুমে ঢোকার অনুমতি পাবেন। এখন থেকে এই রুমের দশহাতের ভেতর যেন আপনার ছায়া যেন না পড়ে। বউ আনতেছি, বউ আপনারে হাতের কাছে দেখতে পারলে ঝাড়ু পেটা করতে পারে। তাই সাবধান। "
"জ্বে ভাইজান সাবধান থাকুম, মামির সামনে পড়ুম না।"
মাথায় যেন লাখ লাখ ফ্লাশ লাইট জ্বলে উঠল
"খালা দয়া করে আমার সামনে থেকে যান। যাবার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে যাবেন। আলো চোখে লাগতেছে। "
খালা চলে গেল। অন্ধকার ঘরে কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। নীরা আসলে আবার কি না কি ভাববে।
সেদিন নীরাকে দরজাটা ভেজিয়ে রাখতে বলতেই মুখ শক্ত করে বলল,
"শোন বিয়ের আগে আমি এই সবে নাই, সুতরাং এইসবের কথা মনে আনবা না। মুখে তো নাইই।"
"শোন নীরা এসব আমার মনে কেন, মাথায় অথবা পায়ের কোনা আঙুলের ডগায় পর্যন্ত আসে নি। তবে যেহেতু তুমি মনে করেছ সুতরাং আমি ভাবব এবং শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হব না, তোমাকে একটা চুমুও খাব। তুমি এখনই দরজা লাগিয়ে আমার পাশে বোসো।"
কিছুই যেন হয় নি এমন ভাব করে নীরা আমার পাশে বসল। আমি আমার নিজেকে অবাক করে দিয়ে নীরাকে চুমু খেলাম। দু সেকেন্ড থ মেরে নীরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
"জানো এই মুহুর্তটার জন্যে আমি কতদিন অপেক্ষা করেছি। পার্কে যখন আর সবাই অসভ্যতামি করত তখন তুমি বাদাম ছিলতে, সেদিনতো কলেজ পার্টিতে তো সবাই কি না কি করল আর তুমি!"
নীরা ছলছল চোখে বেড়িয়ে গেল।
আমি তব্দা মেরে বসে রইলাম।
'৩'
নীরাকে স্বপ্নের কথাটা বলতেই খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি মুখ ব্যাজার করে বসে রইলাম। কেন যেন মনে হল এই স্বপ্ন আমাকে সারাজীবন ভোগাবে। বাসর রাত থেকে শুরু করে নীরা প্রতিক্ষণ আমাকে এই স্বপ্নের কথা বলে খোটা দেবে।
"শোন তোমাকে টেনশন নিতে হবে না। গিট্টু খোলায় আমি এক্সপার্ট আর বিয়ের সময় বাড়িতে বলে দেবো আমার বর পাজামার ফিতে খুলতে পারে না সুতরাং তোমরা অবশ্যই বরের সুটকেসে একটা কাচি দিয়ে রাখবে। তার থেকে ভালো হয় তুমি পাজামাই পড়লে না"
আমার আতংকিত চোখের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ফেলল নীরা
"তার মানে এই না যে তুমি কিছু না পরেই বিয়েতে আসবে, তোমার জন্যে জিন্সের ব্যাবস্থা করা হবে। কি বল?"
আশংকা সত্যি প্রমাণিত হইল, বিয়ের পর পর্যন্ত অপেক্ষা সইল না নীরার, এখন থেকেই শুরু করে দিল।
"নীরা দয়া করে ক্ষ্যাম দেও"
আমি হাতজোড় করলাম।
রাখীর ভুরু কুঁচকে গেল, "ক্ষ্যাম কি"
"ক্ষমা"
"এই গ্যাইয়া ওয়ার্ড গুলো আর যেন না শুনি। ক্ষ্যাম কি ধরনের ওয়ার্ড বলতো ? বাংলা ডিকশনারির কোন জায়গাটায় এই ওয়ার্ড আছে দেখাও দেখি ?"
আমি চুপ করে রইলাম। ইচ্ছে করলেই ডিকশনারি খুলে নীরাকে শব্দটা দেখিয়ে দেয়া যায়। গতকালই খুজে রেখেছি, নীরাকে দেখিয়ে চমকে দেব বলে। কেন যেন দেখাতে ইচ্ছে করল না। বরং বসে বসে আরো কিছুক্ষণ নীরার বকাবকি শুনতে ইচ্ছে করতে লাগল।
কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত জানতাম আমি বোধহয় নীরাকে বুঝতে পারি না, এখন দেখছি নিজেকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
কি আশ্চর্য
'৪'
বাসররাতে বোধহয় সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। নিচে রহমান মামার দোকানে সিগারেট চাইতেই মামা এমনভাবে দেখতে লাগল যেন পৃথিবীর সবথেকে আশ্চর্যজনক ঘটনাটা তার সামনে ঘটে চলছে। দুনিয়াতে এত বই বেড় হচ্ছে আর 'বাসর রাতে কি করা যাবে অথবা যাবে না' বিষয়ক বই বের হচ্ছে না কেন এই টাইপ আলোচনা মামার সাথে করা যায় কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে আর
একটার পর একটা সিগারেট টানতে টানতে ঘন্টাখানেক পার করে দিলাম।
বাড়িওয়ালা তার ওপরতালাটা বিনাভাড়য় ভাড়া দিয়ে ফেলেছে। কোন কারন ছাড়াই বাড়িওয়ালী আন্টির অত্যান্ত পছন্দের পাত্র হওয়ার কারনেই হয়ত।
নীরা ওদের বাড়িতে উঠতে বলেছিল। ঘরজামাই হওয়ার কোন লক্ষণ আমার মাঝে দেখতে না পেয়ে শেষমেষ এখানেই উঠতে হল। আর চাইলেও বোধহয় ওঠা যেত না। ফোনে খবর পেয়ে শশুরবাড়ির যা হম্বিতম্বি।
আমার তিনকূলে কেউ না থাকায় হম্বিতম্বিটা একটু কমই পোহাতে হচ্ছে। এদিক দিয়ে একটু ভালই হল বোধহয়।
প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা টেনে উপরে উঠলাম। নীরা থেকে থেকে চোখ মুচছে।
কাছে যেতেই ফস করে উঠল।
"একদম কাছে আসবা না। আমি ঠিক করেছি তোমাকে শাস্তি দেব। আজ থেকে তিন মাস তুমি আমার দশহাতের ভেতর আসবা না। আসলে কি করব সেইটা আমি নিজেও না। তবে প্রচন্ড খারাপ কিছু যে একটা করব তা ধরে নিতে পারো। শাস্তির মেয়াদ আজ এখন থেকে শুরু।"
আমি চুপচাপ বারান্দায় যেয়ে বসলাম। কাল খালাকে ডাকতে হবে। রান্নাবাড়া কিছু করে দিয়ে যাবে। নীরার এসব ধাতে নেই। তার থেকেও বড় কথা হল খালাকে দেখে নীরা কি করে তার সুপ্ত একটা ইচ্ছে কাজ করছে ভেতরে।
কিছুক্ষন পরেই নীরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আমি একটু সরার চেষ্টা করলাম। দশ হাতের শাস্তির কথা মনে আছে আমার। নীরা আমার দিকে সরে আসার চেষ্টা করল বোধহয়। নাকি আমার চোখের ভুল।
আমি মেয়েটাকে দুহাতে জড়ালাম। নীরা ঝরঝর করে কেদে দিল।
টেনে এনে বিছানায় বসালাম, শান্ত হল মেয়েটা।
দু সেকেন্ড ফুঁপিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
"শোন তোমাকে যেহেতু শাস্তি দেয়া হয়েছে তাই ভেবেছি শাস্তি কাটাতে তোমাকে একটা উপহার দেব। শাস্তি, উপহারে কাটাকাটি"
বলেই পাশ থেকে একটা কাচি বের করে হাতে রাখল।
আমার কালো হয়ে যাওয়া মুখ দেখেই বোধহয় খিলখিল করে হেসে উঠল।
মুখটাকে কালো করতে পেরে নিজেকে দুনিয়ার সবথেকে সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি বলে মনে হতে লাগল আমার। আর লাগবেই না বা কেন জল চোখে প্রেয়সীকে হাসতে দেখার সৌভাগ্যই বা কতজনের হয়।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬