somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পার্টাকাস (১৯৬০) - সিনেমা

২১ শে মে, ২০১৮ রাত ১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ সালের কাহিনী। রোমান সাম্রাজ্যের সূর্য তখন মধ্য গগণে। ন্যাপলসের এক গ্ল্যাডিয়েটর প্রশিক্ষণ স্কুলে যোগ হলো এক ক্রীতদাস। শরীরের গঠন মজবুদ দেখে গ্ল্যাডিয়েটর বানানোর জন্য এনেছে তাকে এক দালাল। প্রশিক্ষণ শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই এই ক্রীতদাস যোদ্ধা হয়ে উঠল। এই ক্রীতদাস অন্য সবার মত ছিল না, বুকে রীতিমত আগুন নিয়ে ঘুরছিল সে। ক্রীতদাস হিসেবে বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছাই সে রাখত না। পাসের জন কে মেরে ফেলতে হবে, যাকে আজকে বন্ধু মনে করছে কালকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে তাকেই মেরে ফেলতে হবে, এই জিনিস মেনে নেওয়ার মত ছিলেন না তিনি। ইতিহাস বলে ৭৮ জন ক্রীতদাস যারা গ্ল্যাডিয়েটর হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, তাঁদের কে নিয়ে বিদ্রোহ করে বসলেন একদিন। সৃষ্টি হলো এক ইতিহাসের,জন্ম হলো বহু মিথের, ক্রীতদাসদের দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন, আজ এই আধুনিক বিশ্বেও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মাঝে যখন কেউ আলোর ঝলকানি হয়ে জেগে উঠে তখন এই কিংবদন্তির উদাহরণ দেওয়া হয়, তিনি হলেন স্পার্টাকাস!!

রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া এক ক্রীতদাস ছিলেন স্পার্টাকাস। ৭৮ জন কে নিয়ে যে বিদ্রোহের সূচনা তা ক্রমেই বেড়ে বেড়ে লাখের উপরে গিয়ে পৌছায়। প্রথমে রোমান সাম্রাজ্য কিছুতেই স্বীকার করতে রাজি ছিল না যে এই ক্রীতদাসরা একটা বড় শক্তি। তাই মামুলি সৈন্য পাঠিয়ে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে তারা। কিন্তু একের পর এক জয় আসতে থাকে ক্রীতদাসদের পক্ষে। রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শহর জয় করে চলতে থাকে স্পার্টাকাস তার ক্রীতদাস বাহিনী নিয়ে। মানুষের মুখে মুখে তখন স্পার্টাকাসের নাম। দলে দলে ক্রীতদাসরা এসে যোগ দিচ্ছে স্পার্টাকাসের বাহিনীতে। স্পার্টাকাসের ইচ্ছা ছিল ইতালি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে, মানে রোমান সাম্রাজ্যের বাহিরে কোথাও। জাহাজ ভাড়া করে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু বিধি বাম, জাহাজ ছিল জলদস্যুদের। শেষ মুহূর্তে জলদস্যুরা বেঈমানি করে বসে স্পার্টাকাসের সাথে। অন্যদিকে এবার রোমানরা অন্যবারের মত দুর্বল সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে তাঁদের সেরা সৈন্যদল কে পাঠিয়েছে। নেতৃতে আছে মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রেসাস। ক্রেসাস নিষ্ঠুর সেনা অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অন্য কোন উপায় সামনে না থাকায় স্পার্টাকাস সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি রোম আক্রমণ করবেন। অনেক ইতিহাসবিদ এই মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করেন স্পার্টাকাস ইচ্ছা করলেই আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে গাউল প্রদেশে চলে যেতে পারত। যা রোমান সাম্রাজ্যের বাহিরে ছিল, যেখানে স্বাধীনভাবে ক্রীতদাসরা থাকতে পারত। কিন্তু কেন স্পার্টাকাস ওই পথে গেলেন না তা এক রহস্যই।
রোম আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ক্রেসাসের সাথে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে গেলো। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে সংঘটিত ক্রেসাসের সঙ্গে স্পার্টাকাসের এই যুদ্ধটা পরিচিত তৃতীয় সার্ভিলের যুদ্ধ নামে। স্পার্টাকাসে বিশাল দাশ বাহিনী মুখোমুখি হয় ক্রেসাসের। ক্রেসাসের বাহিনী এবার পুরোপুরি তৈরি, সু প্রশিক্ষিত ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে হাজির তিনি। স্পার্টাকাস কে ধ্বংস করার জন্য পিছন দিক দিয়ে সৈন্য নিয়ে ম্যাগনাস এবং লুকালাসের বাহিনীও হাজির। এই যুদ্ধেই পরাজিত হয় স্পার্টাকাস। ৬০০০ বিদ্রোহী ধরা পড়ে। কথিত আছে যে ভিয়া আপিয়া শহর থেকে রোম পর্যন্ত ২০০ কিলো মিটার রাস্তার দুই পাস দিয়ে স্পার্টাকাসের সেনাদের ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান স্পার্টাকাস নামের কিংবদন্তী। যিনি দাস হয়ে মারা যেতে চাননি, যারা স্বপ্ন ছিল তার সন্তান বড় হবে মুক্ত মানুষ হিসেবে।

স্পার্টাকাসের এই জীবন্ত কাহিনী নিয়ে প্রথম উপন্যাস রচনা করেন মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড ফাস্ট। প্রকাশকাল ১৯৫১ সাল। অভিনেতা কার্ক ডাগলাস এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। প্রথমে চিত্রনাট্য হাওয়ার্ড ফাস্ট লেখার কথা থাকলেও পড়ে তা লিখেন ডাল্টন ট্রাম্বো। আর ছবি পরিচালনা করেন স্ট্যানলি কুবরিক। এখানে ডাল্টন ট্রাম্বো সম্পর্কে একটু বলা দরকার। কারন তিনি নিজেও আরেক স্পার্টাকাস। মার্কিন মুল্লুকে কমিউনিজম চর্চার জন্য নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি। ব্ল্যাক লিস্টেড অবস্থায় ছদ্ম নামে লিখেন রোমান হলিডের মত সিনেমার চিত্রনাট্য। ছদ্ম নামে লিখে গেছেন সমানে কারন কেউ সাহস পেত না উনার নাম স্ক্রিনে দিতে। কার্ক ডাগলাস প্রথম সাহস দেখিয়ে এই লেখকের নাম দেন স্ক্রিনে। অন্যান্য পরিচালকরা একই কাজ করা শুরু করলে আস্তে আস্তে কেটে যায় ডাল্টন ট্রাম্বোর উপর থেকে নিষিদ্ধের কালো ছায়া। এর আগ পর্যন্ত একা ফাইট করে গেছেন তিনি।

১৯৬০ সালে স্পার্টাকাস মুক্তি পায় আর স্ট্যানলি কুবরিকের সেরা কাজ গুলার একটা হয়ে যায় স্পার্টাকাস। একই সাথে কার্ক ডাগলাসেরও তাই। ট্রাম্বো গল্পের প্রয়োজনে ইতিহাস কে এদিক সেদিক করেছেন( কিংবা হাওয়ার্ড ফাস্টও এই কাজ করে থাকত পারেন!) কিন্তু তৈরি করেছেন এক মাস্টারপিস। ছবির শেষের দিকে। যখন ক্রেসাস স্পার্টাকাস কে খুঁজছেন আটক সৈন্যদের মাঝে। তখন তিনি বন্দিদের মাঝে স্পার্টাকাস কে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য বলতে থাকেন। স্পার্টাকাস দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলার পরেই তার পাস থেকে তার অন্যতম সাথি আন্টীনিয়াস দাঁড়িয়ে বলে উঠে, “ I'm Spartacus!” , আস্তে আস্তে সকলেই দাঁড়িয়ে বলতে থাকে I'm Spartacus!, এই দৃশ্য সম্ভবত সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা দৃশ্য। I'm Spartacus! এই ডায়লগ এরপর মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছে। বহু জায়গায় ব্যবহার হয়েছে এই ডায়লগ। স্পার্টাকাস নামের যে বিদ্যুৎ তা পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে I'm Spartacus! এই ডায়লগের মধ্য দিয়ে।
ট্রাম্বো তার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন দারুণ ভাবেই। বেশ কিছু ডায়লগ একদম চাকু চালানোর মত ছিল ছবিতে। যেমন ভারনিয়া, যে স্পার্টাকাসের প্রেমিকা, তার সাথে প্রথম দেখার সময় স্পার্টাকাস বলছে - I am not an animal!, জবাবে ভারনিয়া বলছে, Neither am I.!!!
কিংবা ড্রাবার সাথে স্পার্টাকাসের প্রথম কথোতপতন -
Spartacus : What's your name?
Draba: You don't want to know my name. I don't want to know your name.
Spartacus: Just a friendly question.
Draba: Gladiators don't make friends. If we're ever matched in the arena together, I have to kill you.

পুরো ছবি জুড়েই এমন দুর্দান্ত ডায়লগ ছবি কে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। আর ডাল্টন ট্রাম্বো প্রমাণ করেছেন তিনি কি জিনিস।

আলাদা ভাবে বলতে হয় কার্ক ডাগলাসের কথা। স্পার্টাকাস চরিত্রে তিনি এতই মানানসই ছিলে যে তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না আসলে তিনি কার্ক ডাগলাস নাকি স্বয়ং স্পার্টাকাস নিজেই। পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক তার অন্যতম সেরা এই ছবিতে পারফেকশনের নতুন এক মাত্রা তৈরি করেছেন। ১৯৬০ সালে ১২ মিলিয়ন ডলারে এই ছবি বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়। প্রাচীন রোম কে তুলে এনে বসিয়েছিলেন যেন ছবির সেটে।

চারটা অস্কার বা ৭.৯/১০ আইএমডিবি রেটিং দিয়ে ছবির মহত্ত্ব বোঝানো সম্ভব না। সোয়া তিন ঘণ্টার এই ছবি একটা জীবন্ত ইতিহাস। মানুষের ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের শৃঙ্খলা মুক্তির ইতিহাস কি চমৎকার ভাবেই না উপস্থাপন হয়েছে এই ছবিতে।আজকে ক্রেসাস কে চিনে না কেউ, চেনার কারণও নাই কোন। কিন্তু মুক্তিকামী সকলে চিনে স্পার্টাকাস কে। স্পার্টাকাস অমর হয়ে আছেন পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে। যতদিন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে তত দিন সবার প্রেরণা হয়ে থাকবে স্পার্টাকাস।
সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্লাসিক দেখার আমন্ত্রণ থাকল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৮ রাত ১:১৯
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×