গত রোজার ঈদে আমরা স্কুল ফ্রেন্ডরা মিলে গিয়েছিলাম কুমিল্লা। ছয় বছর আগে আলাদা হয়ে যাওয়া স্কুল ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেওয়া, আবার এক হওয়া এই ট্যুর এর মাধ্যমেই। সময় কম থাকায় আমাদের কাছাকাছি কোন জায়গা বেছে নিতে হয়েছিল। মহা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে বিমোহিত হওয়ার উদ্দেশ্য ছিলনা। চেয়েছিলাম সুন্দর এই দেশটা দেখতে, সেইসাথে সব বন্ধু মিলে জম্পেশ মজা মরতে। হবিগঞ্জ থেকে কুমিল্লা বেশি দূর না, তাছাড়া বেশকিছু দর্শনীয় স্থানও আছে। সেটা ভেবেই ঈদ এর একদিন পর পাহাড়িকায় চড়ে শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা। আমাদের অনেকেরই ছিল এটা প্রথম ট্রেন জার্নি। ট্রেন জার্নি বরাবরই এঞ্জয়েবল, তাও আবার বাচ্চাকালের এতগুলা বন্ধুর সাথে! এই জার্নি ভুলার নয়।
ধর্মসাগর
মোটামুটি ৩ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম কুমিল্লা স্টেশনে। সেখান থেকে শাসনগাছা হয়ে কান্দিরপাড়। শহরের ভেতরের রাস্তা ভালনা, সিএনজি করে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে একবার দুবার করে মাথায় বাড়ি খাইছি। কান্দিরপাড় কুমিল্লা শহরের ব্যাস্ততম এলাকা। ওখানে ঘুরাঘুরি করে ভাল একটা থাকার হোটেল পেলাম না। যে কয়টা পেয়েছি ওগুলোতে মানের তুলনায় খরচ অনেক বেশি। সারা শহরে হাতে গুনা কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে। ঈদ সিজন থাকায় বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট বন্ধ। একটা ছোট চায়ের স্টলে সবাই টুকটাক নাস্তা করলাম আর দুজন বেরুলাম হোটেলের খুঁজে। বেশ খুঁজাখুজি করে শেষমেশ একটা হোটেল পেলাম সাধ্যের মধ্যে। হোটেল ময়নামতি, পরিবেশ ভাল এবং ছিমছাম মধ্যম মানের হোটেল। ভোগান্তি পোহাতে হল রাতে খাওয়ার সময়। হোটেলের আশেপাশে তন্ন তন্ন করেও ভাল রেস্টুরেন্ট পাচ্ছিলাম না। চাইনিজ ফাইনিজ বহু খেয়েছি জীবনে কিন্তু ভাতের তৃষ্ণা যে কি জিনিস বুঝেছিলাম সেদিন। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে ঢুকলাম 'মেলোডি রেস্তরাঁ'য়। তারা বলেছিল এটাই ভাত খাওয়ার জন্য ভাল হোটেল। ভেতরে যেয়ে যে পরিবেশ দেখলাম তাতে সবার অস্বস্তি বেড়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে এসে বসেছি, উঠে যেয়ে যে আবার রেস্টুরেন্ট খুঁজব এমন শক্তিটাও ছিলনা। বাধ্য হয়েই খাবার অর্ডার করলাম, মনে মনে ভাবনা পরিবেশ যাই হোক, খাবার ভাল হলেই হয়। ভাতের প্লেট আসার পর গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। প্লেট না ধুয়ে খাবার নিয়ে এসেছে, এর আগে কেউ এই প্লেটগুলোতে খেয়েছে সেই উচ্ছিষ্ট রয়ে গেছে প্লেটে লাগানো! বুঝতে পারছেন ব্যাপারখানা? ক্ষিপ্ত হয়ে ম্যানেজার এর কাছে নালিশ করলাম। সে বুঝতে পারলো আমরা বেড়াতে এসেছি, আমাদের সাথে উল্টো খারাপ আচরন করা শুরু করলো। আমরা খেতে চাইনি, কিন্তু সে আমাদেরকে বাধ্য করলো খেতে। শেষে প্লেটগুলো ধুয়ে দিছে, পেটে খিদা ছিল তাই আমরাও বাধ্য হয়েই খেয়েছি। খাবারের মানের কথা বলবো? রেস্টুরেন্টে খাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে খাবার। আর কিছু জানতে চান?
রাতের ধর্মসাগর
রাত ৯টা। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই ঘুরতে গেলাম কুমিল্লা ধর্মসাগর দীঘি। সেখানে যেতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। দীঘির কিনার ধরে সারি বাঁধা সোডিয়াম বাতি, পরিবেশটা স্বপ্নের মত। এতো বিশাল দীঘি আমি একবারই দেখেছি, বানিয়াচং সাগরদীঘি। ধর্মসাগরে ঘুরুঘুরি শেষে ফিরলাম হোটেলে। প্ল্যান হল, পরদিন নাস্তা করেই শালবন বিহার, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, ওয়ার সিমেট্রি, বার্ড এগুলো ঘুরতে যাব। রাতে প্রচুর আড্ডা শেষে যার যার রুমে গেলাম ঘুমাতে। বিপত্তি বাধলো আমার রুমে। আমি আর বন্ধু কিবরিয়া এক বেডে শুয়ে, হঠাৎ খেয়াল করলাম রুমের সিলিং থেকে চুনের আস্তরণ খসে আমাদের ওপর পড়ছে! পরিষ্কার করি, আবার এসে পড়ে। রাগে ইচ্ছা হইছিল তখনই ওঠে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই।
শালবন বিহার
চরম ভুগান্তি এবং চরম আড্ডাময় এক রাত শেষে সকাল সকাল সবাই উঠে যাই। উদ্দেশ্য মাতৃভাণ্ডার এর রসমলাই কেনা। রাতে একবার গিয়েছিলাম, বিশাল লাইন। ওখানে কেউ একজন বলেছিল ভোরে আসলে সহজে পাবেন। ৭টার দিকে রওনা হয়ে যাই। টোটাল ২০ কেজি কিনলাম, আমরা ১২ জন। রসমলাই হাতে পেয়ে সবাই খুশি। এখন নাস্তা করার পালা, কান্দিরপাড় মোড়ে 'কুমিল্লা সিটি রেস্তোরাঁ' ওখানে আমাদেরকে স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে দুইতলায় ঝুলন্ত পিচ্চি এক রুমে নিয়ে বসাল। আজব এক জিনিস! বাংলাদেশের কোথাও এই স্টাইল দেখিনি। বলল ওই রুমে এসি আছে, তেলাপোকার গন্ধে কেউ বসতে পারলাম না, এসি একটা আছে, বাতাসও দেয় কিন্তু গরম বাতাস! পরে বলল এসি নষ্ট! গরমে সবাই সিদ্ধ, নিচেও বসার জায়গা নেই, ব্যাস্ত রেস্টুরেন্ট। ওখানে বসেই রসমলাই এর প্যাকেট খুলে সবাই রসমলাই খেলাম। মুখে দিতেই মন ভরে গেল! এমন মজার রসমলাই আগে খাইনি। হবিগঞ্জের আদি গোপাল এর রসমলাই প্রায় একই হলেও আসল মাতৃভাণ্ডার এর রসমলাই এর স্বাদটা একটু অন্য লেভেলের। খেয়ে সবাই ঠাণ্ডা । ব্যাপারখানা এমন, কুমিল্লায় ভুগান্তি করতে হবে তোমাকে, কিন্তু শেষে ভুগান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার মত জিনিসও রেডি থাকে! রাতে যেমন ধর্মসাগর সবার মন ভাল করে দিয়েছিল।
মাতৃভাণ্ডার এর রসমলাই
লোকাল সিএনজি করে গেলাম শালবন বিহার। জায়গাটা বেশ সুন্দর। তবে আহামরি কিছু না। একে একে ঘুরা হল শালবন প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট, বার্ড (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী) এবং সবশেষে ওয়ার সিমেট্রি। জায়গাগুলো কাছাকাছি। অল্প ভাড়ায় একটা থেকে আরেকটায় যাওয়া যায়। সবচেয়ে যে জায়গাটা মায়া কাড়লো সেটি হল বার্ড। এমন সুন্দর নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ আর কবে দেখেছি আমি মনে করতে পারছি না। বিশাল বড় বড় সারি বাঁধা গাছ, খেলার মাঠ, ছোট ছোট টিলা, নিঝুম নিরবতা। এ যেন আলাদা এক প্রাকৃতিক নগর।
ওয়ার সিমেট্রির কথাও উল্লেখ করার মত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ক্যান্টনমেন্ট এর সামনে থেকে পাঁচ টাকা ভাড়া। আমরা ওখানে গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে। খুব সুন্দর জায়গা, সবুজের সমারোহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৩৬ জন শহীদ শায়িত আছেন এখানে। কেউ ইংরেজ, কেউ জাপানিজ,কেউ ইন্ডিয়ান বা অন্য কোন দেশের। ওখানে গেলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাওয়ার কথা। বরং বাঙ্গালির বেহায়াপনা দেখে আমার বড় হাসি পেল, কষ্ট পেল। কেউ কবরের সাথে সেলফি তুলছে, কেউবা কবরের উপরে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে! তরুন-তরুনি ডেটিং মারছে, ভাসমান পতিতারা খদ্দেরের খুঁজে ঘুরছে। যারা দেখাশুনার দায়িত্বে আছে তারা কর্তব্যে অবহেলা করে বুঝাই যায়।
ওয়ার সিমেট্রি
ঘুরাঘুরি শেষে ক্যান্টনমেন্ট এর কাছে এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে কুমিল্লা শহরে ফিরলাম (ওই রেস্টুরেন্টে খাবার খারাপ ছিলনা)। তারপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ভ্রমণ করলাম, দেখালাম ঐ কলেজে কাজি নজরুল যে জায়গায় বসে কবিতা লিখেছিলেন সে জায়গা। এবার কুমিল্লাকে বিদায় জানানোর পালা। রাতের বিআরটিসি বাসে করে সিলেট এর উদ্দেশে রওনা। একটু ভুগান্তির এবং অনেক মজার কুমিল্লা ভ্রমণ । আমাদের এলাকায় কিন্তু কুমিল্লার অনেক মানুষ থাকে, তারা জানে আমরা কেমন সমাদর করি সারা দেশের মানুষদের। কুমিল্লার কিছু মানুষের কাছ থেকে ব্যবহার পাইনি তো কি হয়েছে, কুমিল্লার রসমলাই, ধর্মসাগর এরা কিন্তু আমাদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিল
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৫৬