somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হোলির প্রহসন

১১ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েকদিন দিন দেখছিলাম কিছু ছবি। রঙ মাখা, রঙ ছোরাছুরি আর জনতার ভীড়। শাখারী বাজারের হোলি খেলা। এমন কিছু ছবি দেখলাম বিডিনিউজ২৪ ডট কমে যে দেখামাত্র আঁতকে উঠতে মন চায়। কারণ আমি জানি ওই ছবি গুলো শাখারী বাজারের কোন সনাতন ধর্ম অনুসারী পরিবারের মেয়েদের নয়। যুগ যুগ ধরে শাঁখারী বাজারে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের বসবাস। তারা পূজা আর্চা করেন, ধর্ম কর্ম করেন এবং হোলিও খেলেন । পুরোটাই তাদের মতো করে। সনাতন ধর্মের আচারগুলো এরকম যে পুরোটাতেই থাকে উৎসবের আমেজ। সবচেয়ে সুন্দর যে বিষয় সেটা হলো নারীরাও অংশ নিতে পারে সমানভাবে যেকোন উৎসবে। তাদের জন্য শুধু রান্না বান্না করো আর অন্তরালে থাকো টাইপ বিধিনিষেধ নেই। তারপরও নারী পুরুষ একসাথে মিলে যে উৎসব করে সার্বিক দর্শনে তা অনেক পরিশীলিত।
শৈশব থেকে আমার বেশির ভাগ বন্ধু, প্রতিবেশি সনাতন ধর্মাবলম্বী। এখনও প্রিয় বন্ধুদের তালিকার একটা বড় অংশই এই ভারতবর্ষর বায়ু, পানি, মাটি থেকে উৎসারিত ধর্মটির অনুসারী। তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার এক প্লেটে খাওয়া, এক ঘরে বেড়ে ওঠার সম্পর্ক। মাগরিবের নামাজ আর সান্ধ্য আহ্নিক পাশাপাশি চলতে দেখেছি অনেকগুলো বছর। ঈদ বা শবেবরাত, দূর্গা পূজা, লক্ষী পূজা, স্বরস্বতি পূজা কোন টা আসলে কোন বাড়ির উৎসব কখনোই মাথায় থাকেনি। আমরা একসঙ্গে উৎযাপন করেই বেড়ে উঠেছি। “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যমের দুয়ারে পড়ুক কাঁটা” বলে জীবনে যতবার ভাই ফোঁটার আনুষ্ঠানিকতায় হাজির থেকেছি, সেই সব ভাইয়েরাই কিন্তু কেউই ধর্মসূত্রে আমার আত্মীয় নয়, বরং আত্মার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পক।
দূর্গা পূজা কেন এদেশে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন নয়, সে আক্ষেপ আমার বহুদিনের। সেই আমিই কিনা ভীষণ বিরক্ত হুজুগে বাঙ্গালী এবং রবাহুত প্রজন্মের হোলি উৎসব পালনের আদিখ্যেতা দেখে। সব ধর্মেরএকটা সৌন্দর্য আছে, প্রত্যেকটা পরবের আছে কিছু মৌলিক রীতি নীতি। আপাতদৃষ্টিতে রঙিন এবং আকর্ষণীয় হোলি খেলার রয়েছে কিছু নির্দিষ্‌ট আচার আনুষ্ঠানিকতা। আমি যেমন চাই না অন্য কেউ এসে আমার ধর্মের মৌলিকতা নষ্ট করুক, তেমনি চাইবোনা অনাকাঙ্খিতভাবে কেউ এসে আমার বন্ধুর ধর্মের শ্রীহীনতা ঘটাক। আমি জানি আমার ধর্ম রক্ষা করার জন্য লোকের অভাব হবেনা। কারণ ডেমোগ্রাফিক হিসেবে আমি
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করি। কিন্তু যারা সংখ্যা লঘু, চাইলেও যৌক্তিক কারণ থাকা সত্ত্বেও যে বলতে পারেনা, আমার ধর্মে হাত দিও না, তার জন্যও আমি বলতে চাই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা হোলি উৎসব করে, নিজের আত্মীয় বন্ধুকে আবীরে রাঙায় । যার কিনা সূচনা হয়েছিল বহু বছর আগে সেই দাপর যুগে। হোলিকা আর প্রহ্লাদের ইতিহাসে না যাই। শুধু এটা বলতে পারি কিশোর কৃষ্ণ এ প্রথা জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছিলেন । প্রথমে গোকুলের রাখাল বন্ধুদের নিয়ে এবং পরে বৃন্দাবনের গোপীনিদের সঙ্গে রঙ খেলে হোলিখেলার শুরু। সেখান থেকেই হোলি মূলত: কম্যুনিটি ভিত্তিক আচার। অর্থাৎ এক সমাজে থাকা নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশীরা একে অন্যের শুভ কামনায় আবীর ছুঁইয়ে দিবে। চেনা জানা, আত্মীয় পরিজনের মধ্যেই হবেই আবীর বিনিময়। একেবারে নিজস্ব পরিমন্ডলে। বলা দরকার, দূর্গা পূজা যেমন সার্বজনীন। সবাই সব মন্ডপে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখবে, হোলি কিন্তু সেরকম সার্বজনীন উৎসব নয়।
আর এখানেই আমার বিরক্তি। শাঁখারী বাজারের মানুষেরা একেবারে নিজেদের মতো করে পালন করে অভ্যস্থ হোলি উৎসব। এর মাঝে হঠাৎ হাজার হাজার মানুষের গিয়ে ভীড় জমানো। হইচই, উদ্দাম আনন্দ। একবারো কি ভেবে দেখলাম, এটা ওই এলাকার মূল অধিবাসীরা কিভাবে নিল! একটা ছবিতে দেখলাম একটা সনাতনী পরিবার গেটের ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছেন। সেটাই থাকার কথা । কারণ নতুন ধারার যে হোলির সূচনা হয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের চেনা লোকালয়ে তাদের কাছে কিন্তু তা বড়ই অপরিচিত।
বন্ধুত্বের সূত্রে শাঁখারী বাজারের প্রত্যেকটা অলি গলি আমার ঘোরা আছে। ৯৭/৯৮ সালে দূর্গাপূজা মানেই ছিল শাঁখারীবাজারে ঘোরা। মন্ডপ থেকে বের হয়ে বন্ধুর আত্মীয় বাড়ি যাওয়া। পেট পুড়ে খাওয়া দাওয়া। সে অভিজ্ঞতায় যতটুকু মনে পড়ে, বলা যায় শাঁখারীবাজারের অধিবাসীরা কিন্তু যথেষ্ট রক্ষণশীলও। সেখানকার কিশোরী তরুনীরা কিন্তু রাস্তায় নেমে অচেনা লোকজনের সামনে হোলি খেলার নামে নাচবে না। একটু খটকা লাগে এমন পোষাকে বা ভঙ্গিতে ক্যামেরা বন্দী হবে না।
এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, আমি হয়তো তরুন প্রজন্ম যে নতুন ধরণের হোলি উৎসবের প্রবর্তন করতে যাচ্ছে, তার বিরোধীতা করছি। বিষয়টা কিন্তু মোটেই সেরকম না। উৎসব বা রঙ খেলার অধিকার সবার আছে, কিন্তু ভালো হয় সেটা কোন বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের নিজ সংস্কৃতিকে নষ্ট না করে করা হলে। রঙ খেলতে চান, অন্য যেকোন জায়গায় যান। প্লিজ শাঁখারী বাজারে না। শাঁখারী বাজারের মানুষদের তাদের উৎসব তাদের মতোই পালন করতে দিন। হোলির দিন এবং হোলির পরে আমার কোন সনাতনী বন্ধুকে শুনিনি যে সে শাঁখারীবাজারে গেছে। কিন্তু সবাই আবীর মেখেছে, পালন করেছে ধর্মীয় আচার নিজের পরিবারে, পরিমন্ডলে। এমনকি ভারতে যেসব বন্ধু আছে, তারাও কিন্তু হোলি উৎসব করেছে। একই রকমভাবে নিজস্ব পরিমনডলে। কেউ পরিবারে, কেউ অফিসে। কোথাও কিন্তু কোন উদ্দমতা নেই। ধর্মীয়ভাবে হোলি শুধুই আপন মানুষদের নিয়ে উৎযাপনের কথা। দশ বিশ জেলা থেকে লোকজন দল বেঁধে চলে আসলো বুঝে না বুঝে, এসে রঙ মাখামাখি করলো। এটা কিন্তু হোলি না। যারা এইভাবে একটা উৎসব করতে চান, ভালো, করেন কেউ বাঁধা দিবে না। কিন্তু ওইযে প্লিজ অন্যদের প্রাইভেসি নষ্ট না করে যা খুশী করুন । ইকো ট্যুরিজমে যেমন কেউ বনে ঘুরতে গেলে বনের কোন ক্ষতি করা যাবেনা এটা মাথায় রাখতে হয়। সেভাবে ধর্মীয় উৎসবের সার্বজনীনতার নামে তাদের স্বকীয়তা নষ্ট না করাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ।
আপনার পাঁচ সদস্যের পরিবারের নিকোন উঠোনে যদি অপিরিচিত পঞ্চাশজন এসে অচেনা ছন্দে লাফালাফি শুরু করে আপনি কিন্তু তখন পুরোপুরিই সংখ্যালঘু। সবচেয়ে বড় কথা আপনার উঠোনে আপনি এধরণের আচরন মেনে নিবেন কিনা। নিশ্চিত আপনি নিজেও মানবেন না। তাহলে কেন শাঁখারী বাজারে গিয়ে উৎসবে শামিল হওয়ার নামে সংখ্যালঘুদের মানসিকভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমরা সংখ্যালঘু?
শেষকালে শুধু এটুকু বলি, প্রতি পূজোয় নাড়–, মোয়া বানাতে গিয়ে আমার জন্য একটা অংশ তুলে রাখে যে বৌদি। সেই দাদা বৌদিরা যদি হোলির দিনে তাদের ভালোবাসার আবীরে আমাকে রাঙায়, আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু পথ চলতে অচেনা কোন মানুষ যদি রঙ ছুঁড়ে দেয় সেটা হবে আমার জন্য চরম বিড়ম্বনার এবং বিরক্তির। একটা কাজের ভালো এবং মন্দের এই সুক্ষ তারতম্যটুকু বোঝার অনুভূতি কি কোনদিন আমাদের ছিলনা, নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে তা ভাবার সময় কিন্তু বয়ে যায়।
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×