১৪২০ বঙ্গাব্দের কার্তিকের সতেরতম দিবসের অন্তিম লগ্নে ব্যাস্ত নগরীর ফুটপাতে চিতই পিঠার উদগিরিত ধোঁয়ায় আসন্ন শীতের আমেজ। আড্ডা পিপাসু মানুষের ছোট ছোট জটলা এবং কোলাহলে মুখরিত শাহবাগের চিরচেনা রূপ। বাস থেকে নেমেই দাঁড়ালাম পাবলিক লাইব্রেরীর গেইটে। ইতি উতি চোখ ফেলে খুঁজতে লাগলাম সাহিত্য আড্ডার তৃতীয় আসরে আগতদের কাউকে না কাউকে। ভিতরে অংসখ্য পুলিশের আনাগোনা। ইদানিং পুলিশ দেখলে আমার ভয় লাগে। হয়ত আমাদের রাজার রাজত্বে পুলিশগুলো নির্বিচারে মানুষ মারার লাইসেন্স পেয়েছে বলেই এত ভয়।
না কাউকে দেখছিনা। মুঠোফোনে সাহায্য চাইলাম আমার সবসময়ের ভরসা কাল্পনিক ভালবাসার কাছে।
- হ্যালো কাল্পনিক ভাই আপনি কি আড্ডায় এসেছেন।
- না ভাই আমি এখনো আসিনি। কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে যাব।
- আপনি কি আমাকে কারো সেল নাম্বার দিতে পারবেন।
- ওকে দেখছি।
পা রাখলাম পাবলিক লাইব্রেরী গেইটের ভেতরে। সহসা মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার আগমনি সংগীত। কাল্পনিক ভাই একজনের নাম্বার পাঠালেন।
- হ্যালো ভাই আপনারা এসেছেন।?
- হ্যাঁ এসেছি। আপনি সোজা পাবলিক লাইব্রেরীর ক্যান্টিনের সামনে চলে আসেন।
ফোনে কথা বলতে বলতেই আগত ব্লগারদের অবস্থান দৃষ্টি গোচর হল। যার সাথে কথা বলছিলাম তিনি ব্লগার মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব। পাশে দাঁড়ানো ব্লগার মাহবুবুল আজাদ। করমর্দন হল। আদুরে মুঠোফোনে ব্যাস্ত একজন। উনার ফোনালাপ শেষ হলে সজীব ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন উনি ব্লগার এটিএম মোস্তফা কামাল। আসরের নামাজ পড়ে যোগদিলেন আড্ডার অন্যতম কর্নধার ব্লগার অলওয়েজড্রিম মানে রানা ভাই।
নানা অগোছালো বিষয়ে আমাদের কথা চলছে আর মাথার উপরে কাকেদের কা কা। যেন ওরাও আমাদের মত আড্ডা জমিয়েছে।আকাশের কোথাও ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের মত কাকদের পাবলিক লাইব্রেরী আছে কিনা কে জানে?
এর মধ্যে এসে হাজির হলেন শশ্রুমন্ডিত ব্লগার সেলিম আনোয়ার ভাই। তার পিছু পিছু ব্লগার স্বপ্নবাজ অভি আর নবাগত ব্লগার শুভম হাসনাত। বাহ ! জমে গেল আড্ডা। শুরুতেই বাংলার ক্রিকেট। কেনইবা ক্রিকেট হবেনা? বাংলার দামাল ছেলেরা যে কামাল করে দিচ্ছে ক্রিকেটের মাঠে। সবাই পঞ্চমুখ মুসি, ম্যাশ দের গুনকীর্তনে।
বিকেল গত হয়ে সন্ধ্যার ছায়া নেমে এল। এবার বাঁধ ভাঙা স্রোত। একেক করে এসে জমা হলেন ব্লগার কাল্পনিক ভালবাসা, মাহতাব সমুদ্র, ৎঁৎঁৎঁ, নাম না জানা নতুন অনেকে। কাল্পনিক ভাই এসেই নিকোটিন শলাকায় ধোঁয়া উঠালেন সানন্দে। ৎঁৎঁৎঁ-এর কাঁধে ইয়া বড় ঝোলা। ভবাবলাম ঠাকুর মার ঝুলিতে থাকে সব গল্পের সমাহার আর আমাদের ৎঁৎঁৎঁ-এর ঝোলাতে হয়ত সব নান্দনিক কবিতার সমাহার।
সেগুন পাতায় আসন পেতে আমার বসলাম গোল হয়ে। শুরু হল আড্ডার মূল পর্ব। এ.টি.এম. মোস্তফা কামাল ভাই পড়ে শুনান তার লেখা প্রবন্ধ কবিতার ছন্দ : কেন জানা দরকার? আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। যেন বাংলা সাহিত্যের এক চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। তিনি শুধালেন কবিতায় ছন্দের অপরিহার্যতার কথা, শুধালেন কবিতার ইতিহাস।
ছন্দ ছাড়া কবিতা কেন নয়? মাঝখানে বিতর্কের ঝড় তুল্লেন স্বপ্নবাজ অভি আর কবি ত্রিপল খন্ডত। ব্লগার নেক্সাস, মাহবুবুল আজাদ আর সাইফুল ইসলাম সজীব দাঁড়ালেন ছন্দের পক্ষে। আলোচনা, বিতর্ক আর কামাল ভাইয়ের জ্ঞানের ফুলঝুরিতে জমে উঠলো আড্ডা। হঠাৎ বেঢপ পোশাকের সেই চির চেনা হাসিমুখ ব্লগার কুহক এসে হাজির হলেন। গলায় ঝুলন্ত ক্যামেরা। এসেই জড়ালেন ছন্দ বিতর্কে। মাঝে রাগ ঝাড়লেন রবি বাবুর উপর। ব্যাটা সব লিখে গেছে আমরা কি লিখব ! তারও যুথসই জবাব দিলেন কমাল ভাই। বল্ললেন রবি ঠাকুর যা লিখেছেন তাও আমরা লিখতে পারি তবে একান্ত নিজের ঢংয়ে। প্রাংসগিক আলোচনায় উঠেএল সেক্সপিয়ার, নজরুল, প্লেটো লালন ফকির সহ আরো অনেক মহারথীর সৃষ্টিকর্ম।
হঠাৎ আড্ডার মাঝে ঢুকে পড়ল একটা ম্যাও। ভাবলাম ব্লগার বটবৃক্ষ না এসে টার টিংকু কে পাঠিয়েছে। হায় দুনিয়া বিড়ালও কি ছন্দ খুঁজে !!
এর মাঝে আলোচনায় কিছুটা বিরতি। এই অবসরে বের হয়ে এল তিন খন্ডত-এর ঝোলা রহস্য। আরে একি! এযে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ! যার ঝোলাভর্তী নানান রকম বাঁশি। পার্থক্য একটাই। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তার বাঁশির যাদুতে ইঁদুর বশ করতেন আর আমাদের কবি বাঁশিওয়ালা বশ করেন পরীদের। যশোহরের গ্রামীন জনপদে উনি নাকি রাত বিরাতে বাঁশির সুরে পরী নামান। লাল পরী, নীল পরী, সাদা পরী। কাল্পনিকের ভাইয়ের অনুরোধে তিনি আমাদের বাঁশি বাজিয়ে শুনালেন। আহা! সে কি মুর্ছনা। সুরের যেন উথাল পাথাল ঢেউ। দেখলাম একটা পরীও ছুটে এসেছে। যদিও অন্ধকারে তার মুখ চেনা যায়নি।
ও হ্যাঁ বাঁশির সুরে ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দুলিয়ে আরো একজন ছুটে এসেছেন। তিনি আমাদের ব্লগার শিপু ভাই। একেবারে লেইট লতিফ।
আবার শুরু হল আড্ডা। শিপু ভাই সজোরে প্রশ্ন করলেন " কবিতা কি?" আহ! কি সুন্দর উত্তর দিলেন কামাল ভাই। আসলে অদ্যঅবধি কবিতার কোন প্রামান্য সংগা কেউ দিতে পারেনি।
আড্ডা চলছেতো চলছে। একেবারেে ননষ্টপ এক্সপ্রেস। এরি মাঝে ঘড়ির কাটায় রাত ৮ টা।রাত প্রহরীদের একজন এসে মিন মিন করে বাজিয়ে গেল বিদায়ের বিউগল। আগামী আড্ডার আলোচ্য বিষয় ঠিক করে আমরা তৃপ্তি আর অতৃপ্তি মেশানো ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এসে দাঁড়ালাম ক্যান্টিনের সামনে। সেলিম আনোয়ার ভাইয়ের সৌজন্যে হয়ে গেল চা চক্র। লেবু মেশানো লাল চা, সাথে পটেটো ক্রেকারস। আহ! তৃপ্তির চুড়ান্ত প্রকাশ। আড্ডার চরম গরম লোভনীয় মুহুর্ত।
শেষ হল চা। শেষ হেল আড্ডা। কিন্তু রেশ রয়ে গেল চায়ের কাপে তুমুল আডডায়। "এই দেখা শেষ দেখা নয়, আগামী আড্ডায় আবার দেখা হবে বন্ধু"এমন প্রত্যয় বুকে নিয়ে একে অন্য কে বিদায় জানালাম।
আমাদের যাপিত জীবনের নানা ক্লেষ আর অনিয়ম কে ভুলিয়ে দিয়ে বার বার ফিরে আসুক এমন আড্ডার মাহেন্দ্রক্ষণ গুলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:১৫