একটা সময় ছিল যখন আড্ডায় নতুন কেউ আসলে জিপিতে কর্মরত আমার বন্ধুর সাথে পরিচয় পর্বের শুরুতেই বেশ গর্বের সাথে বলতাম, আমার বন্ধু সুমন(কাল্পনিক নাম)- জিপিতে আছে। আড্ডায় আগত নতুন সভ্য একটু চমকিত হতেন। বেশ সমীহের সাথে হয়তো জিজ্ঞেস করতেন, ভাই কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?
-মার্কটিং এ।
ভদ্রতার খাতিরে কিছুক্ষন চুপ। তারপরে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকেই তাকে এলোমেলো প্রশ্ন। ভাই জিপিতে কত বছর আছেন? আছেন ভাই আপনারা মজায়!আপনাদের ফোন কি ফ্রি?লিমিট কত? গ্রামীনের নেটওয়ার্কের এই অবস্থা কেন?আপনাদের বিলিং এ কিন্তু সমস্যা আছে। কবে যে একটাকা মিনিট হবে!সারা রাইত ফ্রি দেয়ার কোন মানে হয়? পুলাপান রাইতভর কথা কয় আর সারাদিন ঝিমায়!এইটাতো আরেক ড্রাগ।
আহারে সেই দিন আর নাই!
কখনো হতাশ হয়ে নিজেরই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কেউ আবার কখনো জিপিকে হতাশ করে অনেক বেশী টাকার প্রলোভনে অন্য কোথায় চলে গেছে।কেউ কেউ জিপিকে ভালবেসে -নিজের পুরো সত্বাকে বিলিয়ে দিয়েছে জিপির চরনে। এদেরকে আপনি জিপির সন্মন্ধে আজে বাজে যাই কিছু বলেন না কেন-এরা জোড় গলায় তার প্রতিবাদ করবে। আপনাকে বুঝতে বাধ্য করবে যে জিপি যা করছে তাই-ই ঠিক।একসময় গ্রামীনে চাকরি ছিল সোনার হরিণ। একবার এই লটারী পেয়ে নীচে আর তাকাননি কেউ কেউ সরাসরি আসমানে উঠে গেছেন। চেহারায় এসেছে আরেকটু জেল্লা, পোষাকে কথায় দৃষ্টিকটু পরিবর্তন- অনেকের কষ্টের কারন হয়েছে। অফিসের লোনে গাড়ি কিনে স্ট্যাটাস বেড়ে গেছে আর বেড়েছে বিয়ের বাজারে তাদের চাহিদা।কিন্তু আলোর পিছনে সবসময়ই অন্ধকার ছিল। আজকে গাদা গাদা কর্মী ছাটাই এর মর্মস্পর্শী ব্যাপারটা আমাদের বিবেকে নাড়া দিলেও এই খেলা জিপি সব সময়ই গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে খেলেছ। কিন্তু বরাবরই মিডিয়া ছিল নিঃশ্চুপ।আমার বন্ধুদের সদাহাস্য চেহারার পেছনে সবসময়ই একটা শংকার ছায়া ঝুলে থাকত। কেউ জানেনা কখন কোন কারনে তার হাতে বরখাস্তের পত্রটা ধরিয়ে দেব।গতকাল অফিস করে অদ্য সকলেই অফিসে ঢুকে বসের রুমে ডাক পড়ল-বস একখান চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন স্যরি! সারাদিন মহাউদ্যমে কাজ করেও বাড়ি ফেরার সময় এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। দু-একজন বাদে বেশীরভাগই জানতনা কেন তার চাকরি গেল? কেননা কোম্পানী কারন জানাতে বাধ্য নয়।
ব্রাক থেকে সেলিব্রেশন পয়েন্ট, এর পরে এক্সটেনশন ডেলভিসটায় আর সর্বশেষে হাজার কোটি টাকায় গড়ে তোলা জিপি হাউস এর চাকচিক্য ওদেরকে আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী করেছে জিপির প্রতি বিশ্বস্ত হতে সাহায্য করেছে।এইটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জিপির দ্বীতিয় প্রজন্মের কর্মীরা প্রথম দিককার কর্মীদের মত তেমন আধা- প্রফেশনাল ছিলনা। তারা ছিল অনেক বেশী স্মার্ট আর চতুর। এদের একটা অংশ জিপিকে ব্যাবহার করেছে অন্য কোম্পানীর লোভনীয় চাকরি বাগানোর ধান্দায়। আরেকটা অংশ জিপিকে শুধু দিতে আসেনি নিতেও এসেছিল। আর জিপি-ও সুযোহ বুঝে এদের সামনে টোপ ঝুলিয়েছিল-ঠিক ব্রিটিশরা যেভাবে আমাদের মধ্যে দুর্নীতির বীজ বপন করেছিল।তারা সেই টোপ গিলেছিল- কখনো সইচ্ছায় কখনো অনিচ্ছায়।
জিপি তার বড় বড় অপকর্মগুলো জায়েজ করার জন্য সাধারন কর্মীদেরকে ব্যাবহার করেছে। এরা লোভী হয়েছে- দ্রুত অতি দ্রুত আরো টাকা চাই এই বিশ্বাসে জাতির পরবর্তী প্রজন্মের পাজরের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে কয়েকটা। এরা নিজেরা অর্থবান হয়েছেন কেউ কেউ কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে বেশ বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেছে।
কিছু ভাল মানুষ আর যারা আগেই ছিবড়া হয়ে গেছে তাদের প্রমোশন আটকে রেখেছে কিংবা এমন এক ডিপার্টমেন্টে বদলী করেছে কিংবা সেই ডিপার্টমেন্টা-ই সৃষ্টি করেছে চিরতরে পঙ্গু করে দেবার জন্য। যেখানে কাজ করার কোন সুযোগই নেই, সেইখানে বদলী করে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, যাও বাবা তুমি ওই ডিপার্টমেন্টের হেড- নতুন কিছু ব্যাবসার বুদ্ধি বাইর কর?
সব বুদ্ধি যে ভাই আগেই খরচ করে এসেছে- এখন কি করবে? কয়েকদিন চরম দাপাদাপি করে দেখে নতুন আর কিস্যুই বাইর করার নাই-ঝোলায় থাকা সব ম্যাজিক দেখিয়ে ফেলেছে সে। তখন শুরু হয় হতাশা। তখন জিপি তাদেরকে লাইফ টাইম এচিভমেন্টের মত সব’চে পুরনো এমপ্লোয়ী হিসেবে এওয়ার্ড দিয়ে বুঝিয়ে দেয়- তোমার সময় হয়েছে যাবার।যাদের মান সন্মান বোধ তখনো কিছুটা অবশিষ্ট থাকে তারা অন্য প্রতিষ্ঠানের পুরনো কলিগ বসদের ধরে ধীরে ধীরে কেটে পড়ে আর যাদের সেই বোধটুকুও নেই তাদের অবস্থা বড়ই করুন!
আবার একসময় হয়েছে পদোন্নতির বদলে পদাবনতি!এ জি এম হয়েছে ম্যানেজার, ম্যানেজার হয়েছে অফিসার। এই অপমান সইতে না পেরে জিপির জন্য কত জান দিয়ে দেয়া কর্মী চাকরি ছেড়েছে তার খবর কেউ রাখেনা। তবে এর মাঝে ব্যাতিক্রম একজন, ধরে নিই তার নাম ‘রাহাত সুমন’। তিনি তার পদাবনতির অপমান সইতে না পেরে আদালতের সরনাপন্ন হয়েছিলেন। তখন তার সাথে জিপি অনেক দেন দরবার করে কেস তুলে নেবার জন্য। কিন্তু তিনি গোয়ার্তুমি করেছিলেন কেস তুলে নেননি। পরবর্তীতে আদালতের রায় যায় তার পক্ষে। জিপি বাধ্য হয় তাকে ক্ষতিপুরন সহ পদোন্নতি দিতে। এখন সিইও’র এডভাইসর(কর্মহীন পদ)। অফিসে যাননা তিনি- বাসায় বসে বেতন নেন। মাঝে একবার জিপির সিইও বিশেষ কারনে দেখা করতে এসেছিলেন তার সাথে। তিনি সিইওর সাথে একটা ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিয়ে ট্যাগ দিয়েছিলেন’গ্রামীনের সিইও বিশেষ পরামর্শের জন্য তার সাথে এসে দেখা করেছেন।‘
এর মধ্যে জিপিতে দুর্দান্ত প্রতিভাবান কিছু কর্মী ছিল যারা সময় বুঝে জিপিকে কাচকলা দেখিয়ে ওদের ঘাড়ে বসেই মাথায় কাঠাল ভাঙছে! এরা স্বাবলম্বি- ওরা ওদের সৃষ্টিশীল বুদ্ধিমত্বার জন্য বাধ্য করেছে জিপিকে ওদের বলয়ে আটকে রাখতে। জিপিও ওদের আহ্বালাদ করে।সারাক্ষন বড় বড় কাজ আর মোটা অংকের পারিশ্রমিক দিয়ে বশে রাখবার চেষ্টা করে- কারন অন্য কেউ ওদের হাতিয়ে নিয়ে গেলে বিরাট ক্ষতি!তারপরেও এরা ইতি উতি নজর দেয়। বুদ্ধিমান আর চরম কর্মঠ এই গুটিকতক যুবককে আমি শ্রদ্ধা করি।
বাংলা লিংক আর রবির আদিপুরুষ সেবা আর একটেল মাঠে এসে গ্রামীনকে বেশ বিপাকে ফেলে দিয়েছিল কিন্তু গ্রামীনের কোন এমপ্লোয়ী সেটা আজো স্বীকার করতে রাজী নয়। সেবা’র সেবার মান চরম ছিল সেজন্যই দুই পা এগিয়েই হোঁচট খেয়ে লোটা কম্বল হাতে নিয়ে ভেগেছে আর একটেলের মালিকেরা জাত ব্যাবসায়ী-ব্যাবসার পড়তি সময়ে সুযোগ বুঝে বেঁচে দিয়েছে আরেকজনের কাছে।
গ্রামীনের হাতে ছিল বড় ট্রাম্প কার্ডটা। তাই তাদের প্রতিদ্বন্দীতায় সেইভাবে কেউ পেরে ওঠেনি- সেই সুযোগে মুল আখের রসটাই তারা খেয়ে নিয়েছে এখন চলছে ছিবড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি।সেই কার্ডটা কি?-রেলওয়ের কাছ থেকে অনেকটা বিনে পয়সায় নেয়া প্রায় সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার কেবল।শুধু এই কেবল লাইনে শেয়ার পাওয়ার জন্য অন্যসব অপারেটররা মুক্ত কচ্ছ হয়ে দৌড়েছে জিপির পিছনে। তখন জিপি হয়েছে ওদের মোড়ল!(’AMARA’তখনো এই বাজারে প্রবেশ করেনি)কেউ একটু টু-ফ্যা করলেই জিপি তাদের গলা চেপে ধরার হুমকি দিয়েছে।
প্রথম কয়েক বছর লেগেছে জিপির হামাগুড়ি থেকে দাড়াতে। জিপির উত্থান শুরু হয়ে সেলিব্রেশন পয়েন্টে এসে। ধীরে ধীরে আশে পাশের প্রায় সব বাড়িঘর ভাড়া নিয়ে নিজেদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়ে একটা গুলশানের একটা আবাসিক এলাকাকে পুরোপুরি বানিজ্যিক এলাকা বানিয়ে ফেলে। সেইসাথে বিভিন্ন সেবামুলক কর্মকান্ডের নামে তারা হাত বাড়ায় নগর সৌন্দর্যবর্ধন,পরিবেশ সচেতনতা,সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে। সব কিছুতেই ছিল বিজ্ঞাপনের নতুন চমক দেখানো আর নিজেদেরকে মহান আর উদার হিসেবে প্রচার করা। এর আগেই ইলেকট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়া এদের কেনা হয়ে গেছে। প্রয়োজন হোক না হোক পত্রিকার পাতা জুড়ে জুড়ে বিশাল অ্যাড,টিভিতে সারাকক্ষন-ই চলে ‘কতদুর আর কতদুর বল মা’ জাতীয় চরম আবেগ নির্ভর বিজ্ঞাপন। আর তাই দেখে নিভৃত গ্রামের সুদুর কোনে চোখের জল ফেলে মা আর ছেলেকে বলে ‘আমারে একটা মোবাইল কিনি দে বাজান।‘এই সবই ছিল অতি সুচতুর ভাবে ‘ইমোশনাল টর্চার বা আবগের অত্যাচার।
মিডিয়ার দুর্দান্ত সব রিপোর্টার বিশেষ প্রতিবেদন বা সংবাদে স্বৈর-শাসকের চোখ রাঙ্গানি, অসৎ ব্যাবসায়ী আর অপরাধ জগতের ডনদের শাসানি উপেক্ষা করে কত স্পর্শকাতর সংবাদই না প্রচার করে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে চলে ঘন্টার পর ঘন্টা টক শো। দেশের প্রতি তাদের কত ভালবাসা- সেটা বিশেষ দিনগুলোতে বোঝা যায়। দেশের জন্য অন্তর পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় কিন্তু এই বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তারা কখনোই কিছু বলতে চায়নি বলেনি আর হয়তো বলবেও না কোনদিন।(শুধু ব্যাতিক্রম অনলাই ব্লগ মিডিয়া) কিন্তু কিসের এত ভয়? শুধুকি বিজ্ঞাপন হারানোর? হ্যা এইটে একটা বড় ব্যাপার ছিল। কেউ কেউ চাইলেও প্রকাশ করত না এই ভয়ে। প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খোরাক জোগায়তো গুনে গুনে কয়েকটা বহুজাতিক কোম্পানি।তন্মধ্যে জিপি অন্যতম। এখন অবশ্য বাংলালিংক এর প্রতাপ বেশী। কিন্তু ভাল করে খোজ নিয়ে দেখুন সেইসব দেশ মাতৃকার জন্য জান দিয়ে দেয়া সাংবাদিকরা মুখে কুলুপ এটেছিল? এদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য কত কিছুই না করেছে জিপি।
-এখনো শেষ হয় নাই আরেকটু আছে-
(তাড়াহুড়োর জন্য একটু আগোছালো রয়ে গেল। পরের কথা আগে এসেছে আগের কথা পরে। সময় মত সাজিয়ে দেব। ক্ষুদ্র এই অপরাধ মার্জনীয়।
আগের পর্বের জন্য: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১২:০২