(খারাপ লাগছে বলতে তবুও বলছি;বিশ্বাস করুন সেইদিন এই মানুষগুলোর ব্যাবহার দেখে সেদিন আমার মনে হয়েছিল সেন্টমার্টিনের গুটিকতক অসভ্য মানুষগুলোকে একটু সভ্যতা না শেখালে কখনোই বিদেশী পর্যটক মায় আমাদের জন্যও নিরাপদ হবে না।)
মাত্র কয়েক ঘন্টার সেন্টমার্টিন ভ্রমন তারপরেই আবার ফেরার তাড়া।সী-গাল থেকে আনা স্যান্ডউইচ আর ফল দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম।
ইগোর দম্পতির ইচ্ছে ছিল আরো কিছুক্ষন সূর্যস্নান করার-কিন্তু জাহাজ ছেড়ে দিবে বলে বাধ্য হয়ে উঠতে হল।ফেরার পথে আমি লিয়েনার পাশাপাশি হাটছিলাম-মনে হচ্ছিল সুযোগ পেলে আবার সে সাগরে ঝাপ দিবে!
উপরের ডেকের কেবিনের ঠিক পিছনের দরজার পাশে বাইরে রেলিং এর ধার ঘেষে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে ওদেরকে বসালাম।এদিক দিয়ে যাতায়াতের পথ নেই, তাই ইচ্ছে থাকলেও এ পথ দিয়ে হাটা চলা সম্ভব নয়। আমি ওদের সামনে দরজার বের হওয়ার পথের কিছুটা এমন ভাবে আড়াল করে দাড়ালাম যাতে উটকো কেউ বিরক্ত করতে না পারে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দ্বীপটা ঘুরে দেখার সখ ছিল বহুদিনের-ভেবেছিলাম একটু ছেড়া দ্বীপেও যাব। কিন্তু ওদের অতিমাত্রায় সূর্যস্নানের আসক্তি আমাদের বাধ্য করেছে ইচ্ছা দমনের।লিয়েনা গভীর মনযোগে সাগর আর দ্বীপটাকে দেখছে।আর সল্পবাক সদাহাস্য ইগোর কি ভাবছে আর কি দেখছে ঠাহর করা মুশকিল। ওদের দুজনেরই গায়ের রঙ এই দুইদিনে গাঢ় লালচে হয়ে গেছে-শ্বেতাঙ্গদের এই রঙটা আমার ভীষন অপছন্দের!
বেশ খানিক্ষন চুপচাপ সবাই। বন্ধু আমার ছবি তোলায় ব্যাস্ত-আমিও তুলছি দু-চাখানা। কখনো মাছ ধরার নৌকার, কখনো সাগরের-দুরের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের। সূর্য বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে ততক্ষনে পশ্চিম আকাশে, জাহাজের কোলাহল কমে গেছে অনেকখানি।রেলিং এর উপর শক্ত করে হাত রেখে খানিকটা দুরে সাগরের ঢেউয়ে ভাসতে থাকা একটা জেলে নৌকা টেলি লেন্স দিয়ে জুম করে বেশ খানিক্ষন ধরে ফোকাস করে শাটারে একটা চাপ দিয়ে ওদের দিকে ফিরলাম।
-সেন্ট মার্টিন কেমন লাগল আপনাদের?
ইগোর যথারীতি হাসল। লিয়েনাও একটু হেসে মুখ খুলল, ‘আতলিচনা’- দারুন সত্যিই দারুন!
-কোনটা বেশী ভাল লাগল, সাগর, সূর্যের প্রখর আলো, সাগরসৈকত নাকি দ্বীপটাকে?
লিয়েনা কিছু বলার আগেই এবার ইগোর বলে উঠল,-সবকিছুই সুন্দর। আমরা বিমোহিত। তাইনা প্রিয় লিয়েনা?
লিয়েনা সত্যিই মুগ্ধ।এবার অন্তত সে আর ইগোরের সাথে দ্বীমত পোষন করলনা। তার শরিরের অভিব্যক্তি বলে দিল সে কতখানি মুগ্ধ!
আমি আচমকা অন্য প্রসঙ্গ পাল্টালাম,তোমাদের বাচ্চা-কাচ্চা আছে?
লিয়েনা স্মিত হেসে ইগোরের দিকে তাকাল,-হ্যা আছে। আমাদের একমাত্র মেয়ে আলিয়েনকা(আলিনা)।
-ওকে নিয়ে আসলেননা কেন?(রুশ ভাষায় আপনি সন্বোধন করা যায়-ওদের সাথে আমি প্রথম থেকেই আপনি বলে সন্বোধন করে আসছিলাম।)
- ও এখন আমাদের সাথে থাকে না। প্যরিসে স্টাডি করছে।ফের হেসে বলল সে, আমার আলিয়েনকা কিন্তু ছোট্ট নয়- ওর বয়স এখন প্রায় বাইশ!
-ওফ!(তখন ওই বয়সী কোন ললনার প্রসঙ্গ আসলেই একটু আবেগ ভর করত)।ওর সাথে দেখা হয় না?
-হ্যা…আমরা যাই মাঝে মধ্যে ওকে দেখতে। সে-ও আসে ছুটি ছাটায়।আর একটা কথা বলি শোন-ইগোর কিন্তু আমার আলিয়েনকার আপন বাবা না। ইগোরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বছর দশেক আগে।তবে ও কিন্তু আলিয়েনকাকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসে।
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, -প্রস্তাবটা কে আগে দিয়েছিল?
লিয়েনা তাকাল ইগোরের দিকে। ইগোর একটু শব্দ করে হেসে বলল, আমিই দিয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে কখন যে লিয়েনার কপট গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়ল টের-ই পেলাম না। আমরা এখন ওকান্ত ব্যাক্তিগত আলোচনা নিয়ে তিনজনই উচ্ছল!
কেয়ারী সিনবাদ ধীরে ধীরে সাগর ছাড়িয়ে নাফ নদীর মোহনায় প্রবেশ করছে।টোকনাফের পাহাড়গুলো এখন বেশ কাছে চলে এসেছে। সূর্য তার গায়ে কিছুটা লাল আবির মাখিয়ে পাহাড়ের ওপাশে ডুব দেয়ার পায়তারা করছে। আমি ওদেরকে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম, দেখ দারুন সূর্যাস্ত হচ্ছে।
লিয়েনা আমার কথা শুনে বেশ জোরেই হেসে উঠল। আমার নাম ধরে একটু উচ্চস্বরেই বেশ খানিক গর্ব আর অহংকার মেশানো কন্ঠে বলল, তুমি কি জানো আমার নিজস্ব প্রমোদতরী আছে?কত দ্বীপ আর সাগরে ঘুরে ঘুরে আমি সূর্যাস্ত দেখেছি। সেসব দূর্দান্ত সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখলে তুমি সাটারটিপে টিপে আঙ্গুল ক্ষয় করে ফেলবে।কিছু মনে কোরনা প্লিজ-এটা অতি সাধারন মানের সূর্যাস্তের দৃশ্য তেমন করে উপভোগ করার কিছু নেই।
এভাবে অপমানিত হয়ে প্রচন্ড রাগে আমি মুক হয়ে গেলাম।রাগ সংবরন করার উপায় হিসেবে। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ভিউ ফাইন্ডারেআমার আত্মার সাথে জড়িয়ে থাকা একান্ত আমার নিজস্ব যেটা একজন ভিনদেশী লিয়েনার কাছে অতি সাধারন-অথচ আমার কাছে অমুল্য অসাধারন অতি আপন সেই পাহাড় সূর্য আর সাগরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।
পানিতে সূর্য রশ্মির লালচে হলুদ আভার প্রতিবিম্ব-ঢেউয়ের তালে দুলছে জেলে জোলে নৌকা । মাথার উপরে আকাশে পাতলা মেঘ সে আলো গায়ে মেখে নিজের ফ্যাকাসে অববয়কে সেই রঙ্গে রাঙ্গিয়ে ভাবাবেগে উদাস হয়ে ধীরে ধীরে উড়ে চলছে। দুরের সবুজ ভোঁতা মাথার যেন উপুর করে বাটি রাখা পাহাড় আর টিলার মাথায় সোনালী মুকুট-আর এপাশটা সবুজ অতি সবুজ হয়ে কালচে রং ধারন করেছে- সে রুপও মনোরম! সূর্য তোড়জোর করছে আপাত বিশ্রামের –সারাদিন প্রখর কিরণে সবাইকে তেলেভাজা করে এখন মায়াবী আলোর পরশে সবার থেকে স্তুতি কুড়ানোর ধান্দা করছে। প্রকৃতি আকাশ আর সাগরের রঙ ক্ষনে ক্ষনে পাল্টে যাচ্ছে-সেই পাল্টে যাওয়া অপরুপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি আড় চোখে তাকালাম লিয়েনার দিকে।
আমি কি ভুল দেখছি?অবাক হয়ে সোজাসুজি চোখে তাকালাম।লিয়েনা পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখছে তার কথায় অতি সাদামাটা টেকনাফের সূর্যাস্তের দিকে। ইগোরও যেন হারিয়ে গেছে সেই অপার্থিব পরিবেশে।
আমার দিকে চোখ পড়তেই লিয়েনা একটু লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসল। একটু অভিমান আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রকৃতিতে ডুবে যেতে চাইলাম। লিয়েনার ডাকে বাধ্য হয়ে চোখ ফেরালাম;
লিয়েনা চরম আবেগ নিয়ে সপ্নোত্থিত কোন ব্যক্তির মত বলল, আমি ভুল বলেছিলাম। সত্যি বলছি-আমি আমার জীবনে মনে হয় এত সুন্দর সূর্যস্ত দেখিনি!চট করে ফিরে তাকালাম ইগোরের দিকে-ঠোটের কোন সারাক্ষন লেগে থাকা হাসিটা এ মুহূর্তে উধাও-স্বচ্ছ কাচের পিছনে মুগ্ধতায় ভরা তার একজোড়া চোখ।
(লেখাটা এখানে শেষ করে দিলেই ভাল হয়। ফিরে আসার সময় বিশেষ একটা ঘটনার উল্লেখ না করলে লেখাটা নিশ্চিতরুপে অসম্পূর্ন থেকে যাবে।তবুও ব্যাপারটা সেই রুশীয় দম্পত্তির জন্য বিব্রতকর আর কিছুটা রুচি বিরুদ্ধ বলে আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে লেখাটা এখানেই শেষ করে দিলাম।)
ছবি: লেখার মাঝে ছবি দিতে চেষ্টা করলাম অনেক। কিন্তু ছবি যোগ করার সব শর্ত পূরন করে অপেক্ষা করলাম অনেক্ষন-আপলোড হচ্ছে না।
প্রথম ছবিটা টেকনাফের সূর্যাস্তের। আলোর সল্পতার জন্য শেষ দৃশ্যের ছবিগুলো টেলি লেন্স দিয়ে তুলতে পারিনি। দ্বীতিয় ছবিটা মায়ানমারের দিকের। পরেরটা সদাহাস্য নিপাট ভদ্রলোক ইগোরের।তাঁর ছবি তোলা নিয়ে কোন সমস্যাই ছিলনা-তিনি বরংচ সেজেগুজে পোজ দিতেন। সমস্যা ছিল লিয়েনাকে নিয়ে , তিনি প্রথম দিনই নিষেধ করেছিলেন তার কোন ছবি তুলতে। আমারা দুই বন্ধু কখনোই ক্যামেরার লেন্স তার দিকে তাক করিনি। অনেক খুজে আমার বন্ধুর তোলা একটা ছবিতে তাদের দুজনকে এক ফ্রেমে পাওয়া গেল- কিন্তু চেহারা বোঝার উপায় নেই )
আগের পর্বের জন্য ;http://www.somewhereinblog.net/blog/sherzatapon/29715596
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:২১