শ্বরণী বাবুকে নিয়ে দেশে খুব হই হুল্লোর চলছে। রাস্তায় মোল্লাদের মিসিলের ছড়াছড়ি, মিশিলে তাদের স্লোগান হলো
“মুসলমানের দেশেতে,নাস্তিকেরা থাকবে না।
পাক আল্লার মাটিতে, বিধর্মীদের রাখবোনা।
নাড়ায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার”।
প্রেসক্লাবের সামনেও তাদের মানব বন্ধন। সরকারের কাছে তাদের দাবি যে শ্বরণী বাবুর বই গুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হোক। মোল্লাদের এমন কর্মকান্ডে শ্বরণী বাবুর ক্ষতি তো তেমন কিছু হয়ই নি, বরং লাভটাই হয়েছে অনেক বেশি। হুজুগে বাঙালিরা তার বিতর্কিত বইগুলোর উপর পাঠক অতি মাত্রায় কৌতুহলী হয়ে পরেছে, এই উপচে পড়া কৌতুহলী পাঠকের ভিড়ের কারণে শ্বরণী বাবুর বইয়ের বিক্রিও বেড়েছে আগের থেকে প্রায় শত গুন। সেই বিখ্যাত কঠিন যুক্তিবাদী নাস্তিক শ্বরণী বাবু বক্তব্য আমি আজ প্রেসক্লাবে হাজির। তার লেখা বই গুলো নিয়ে সৃষ্টি হওয়া বিতর্ককে কেন্দ্র করেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন। মোল্লাদের হিংস্র আক্রমনের ভয়েই পুলিশদের কড়া নিরাপত্তায় শ্বরনিবাবুকে আনা হয়েছে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। এর আগে শ্বরণী বাবুর শুধু নামই শুনেছি। কখনো সামনা সামনি দেখিনি, আজ সরাসরি দেখেতো পুরোপুরি অবাক। লেখার ভেতরে জীবন সম্পর্কে এত গভীর বাস্তবতা এবং বেতিক্রম দর্শনে পরিপূর্ণ দেখে ভেবে ছিলাম পঞ্চাশ ছাড়ানো বয়সের রিটাইয়ার্ড করা বাংলার অধ্যাপক হবেন। কিন্তু না ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়েসী তরতাজা একজন যুবক শ্বরণী বাবু। গায়ের রং ফর্সা, মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল ঝুটি করে কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। মুখ ভর্তি এলোমেলো লম্বা দাড়ি গোফ। দাড়ি গোফের মাঝে জ্বলছে রাশিয়ান হাবানা চুরুট। পরনে খাকি রঙের খদ্দরের সর্ট পাঞ্জাবির নিচে জিন্স। পায়ে চামড়ার তৈরী ক্ষয়রী রঙের বাটার সেন্ডেল। কাধে ঝোলানো একটি চটের তৈরী ঝোলা। দূর থেকে দেখেও যে কেউ আন্দাজ করতে পারবে যে ইনি একজন বুদ্ধিজিবি।
চুরুট ফুকতে ফুকতে কয়েকজন সাথী সঙ্গী সহ পুলিশী নিরাপত্তায় ভক্ত এবং সংবাদিকদের ভির ঠেলে অদিতরিয়ামে ঢুকলেন শ্বরণী বাবু। ঢোকা মাত্রই ক্যামেরার সাটারের খটখট শব্দ এবং ফ্ল্যাশ লাইট গুলো একের পর এক জ্বলতে নিভতে শুরু করলো, সাংবাদিকদের কাতারের পেছনে অডিয়েন্স সিটে বসে থাকা ভক্তদের গিজগিজে ভিড় দাড়িয়ে করোতালি এবং উল্লাস ভরা জোড়ালো চিত্কারের মাধ্যমে স্বাগত জানালো শ্বরণী বাবুকে। অভিনন্দকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে কাধে ঝোলানো ব্যাগটা সহকারীর হাতে দিয়ে স্টেইজের টেবিলের উপর রাখা মাইক হাতে নিলেন। শ্বরণী বাবু মাইক হাতে নিতেই অদিতরিয়ামের সবাই চুপ, চারদিকে এখন পিন পতন নিস্তব্দতা। কিছু বলবার আগে থেকেই তার বক্তব্য শুনতে মনোযোগী হয়ে বসে পড়লেন সবাই। আমিও তাদের দলেরই একজন, চুপচাপ নিজের সিটে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শ্বরণী বাবুর দিকে, কিছু গুরুত্ব পূর্ণ বক্তব্য শোনার অপেক্ষায়।
শ্বরণী বাবু তার চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে একগাল ঘন সাদা ধোয়া ছাড়লেন। মাইকটা মুখের কাছে নিয়ে চোখটা বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন, চোখ বন্ধ অবস্থাতেই একগাল মুচকি হেসে শুধু বললেন
“যাহাই অজানা তাহাই ঈশ্বর,
অজানাকে জানা হল, মরে গেল ঈশ্বর।
তোমরা ঈশ্বরকে চিননা, তাই সে ঈশ্বর,
আমি নিজেকে চিনি না, আমিও কি ঈশ্বর।
নিজের বই থেকে এই চার লাইন পড়ে শোনাতেই আবার কড়তালির এক ঝড় বয়ে গেল পুরো অডিটরিয়ামে। এবার চোখ খুলে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
- আজকে আমাকে এখানে আনা হয়েছে আপনাদের মনের ভেতর আমাকে নিয়ে জেগে ওঠা প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে। কিন্তু আমার কাছে তেমন সময় নেই, পুলিশের পক্ষ থেকে আমাকে মাত্র আধা ঘন্টা সময় দেয়া হয়েছে। তাদের ভয় মোল্লারা যদি আমাকে ব্লগার রাজীব হায়দার,অভিজিৎ রায়,ার মত জবাই করে হত্যা করে, অথবা লেখক হুমাউন আজাদ , ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, কিংবা অনলাইন একটিভিস্ট সানিউর রহমানের মত চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। তাই আমি পুলিশদেরকে আপনাদের সবার সামনেই বলছি “ঈদুরের উত্পাতে ইদুরকে মারতে হয়, ঈদুরের ভয়ে মানুষ নিজে আত্মহত্যা করেনা, বাঘের হিংস্রতার কারণে বাঘকে খাচায় বন্ধি করা হয়, বাঘের ভয়ে মানুষ খাচায় ঢুকে বসে থাকে না। মোল্লাদের হিংস্রতাকে যেহেতু এতই ভয় পান তবে আমাকে খাচায় পুরে নিরাপত্তা দেয়া বাদ দিয়ে তাদেরকে গেরাফতার করুন গিয়ে, তাতে শুধু আমি একা না, হাজারো মুক্তচিন্তাবিধ প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারবে।
সবার সাথে আমিও তার এ বক্তব্যে তালি না দিয়ে পারলাম না, তালির শব্দ থামতেই তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বললো
- মোল্লাদের কথা বাদ থাক, বোকা মুসলিমরা সৌদি আরবের ব্যবসার উন্নতি ঘটাতে যখন হজ্জে যায়, মানে ওই কালো বাক্সের চার পাশে সাত পাক চক্কর কাটতে যায়, সেখানে হজ্জের নিয়ম অনুযায়ী এখায়্গায় তিনটি গম্বুজে পাথর মারতে হয়, ওই গম্বুজ গুলো নাকি শয়তান? সত্য কি মিথ্যা সে কথা পরে একদিন বলবো, এখন যা বলছিলাম তা হলো ওই বোকা লোক গুলো যেভাবে ওই গম্বুজে পাথর ছোড়ে, আপনারাও আমাকে একে একে পাথরের বদলে প্রশ্ন ছুড়তে থাকুন, আর আমাকে প্রশ্ন করলে কোনো পাপ নেই, কারণ আমি তো কোন ধর্ম নই, ধর্মকে প্রশ্ন করা মহাপাপ। কেউ কোন বিষয়ের জবাব না জানলে তাকে সেই বিষয় সম্পর্কিত প্রশ্ন করার মানে হচ্ছে তাকে এক প্রকারের অপমান করা, ধর্মকে প্রশ্ন করা মহাপাপ নয়, আসলে ধর্মের না জানা উত্তরগুলোর প্রশ্ন করে তাদের অপমান করাটা মহাপাপ। ধর্ম কখনই কোন যুক্তি যুক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু প্রশ্ন না করার শিক্ষা দিতে ধর্ম সব সময়ই পটু। একজন স্ত্রী যেমন সতীন কখনো সয্য করতে পারেনা, প্রশ্ন, প্রমান এবং সন্ধেহ ধর্মের কাছে অনুরূপ সতীন। এদিকে বিজ্ঞান এবং ধর্মের সম্পর্কটার উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হবে সাপ আর বেজি অথবা দা আর কুমড়া। যদিও আজকাল কিছু ধর্ম ব্যাবসায়ী ধর্মের নড়বড়ে খুটিকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে বিজ্ঞানেরই আশ্রয় নেয়। যাই হোক আমাকে বেধে দেয়া আধা ঘন্টায় যে কয়টার উত্তর দেয়া সম্ভব সে কয়টার উত্তর দেব। তাহলে শুরু করা যাক। কে প্রথম প্রশ্ন করতে চান?
সামনের সাংবাদিকদের কাতার থেকে একজন সাংবাদিক উঠে দাড়ালো। অনুষ্ঠান আয়োজক দের মধ্যে একজন দৌড়ে এসে সাংবাদিকের হাতে একটি মাইক দিয়ে গেল। মাইক হাতে নিয়ে সাংবাদিক বললো
- শুভ সন্ধ্যা শ্বরণী বাবু
শ্বরণী বাবু স্টেইজের উপর টেবিলের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে উপরের দিকে মুখ করে ধোয়া দিয়ে পর পর পাচটা রিং ছেড়ে হাসি মুখে বললেন
- আপনাকেও শুভো সন্ধ্যা, উত্তরটা একটু দেরি করে দেবার জন্য দুঃখিত, আসলে আমি আমার কোনো ক্ষুদ্র ইচ্ছাকেও হত্যা করতে পারিনা। আমার ইচ্ছা হয়েছিল ধোয়া দিয়ে রিং বানাতে তাই আগে আমার ইচ্ছা পূরণ করলাম, তার পর আপনার দেয়া শুভো সন্ধ্যা গ্রহণ করলাম। করুন কি প্রশ্ন করতে চান?
- আপনার লেখা এবং শিকার উক্তিতে সরাসরি বলেছেন যে আপনি কোন ধর্মে বিশ্বাসী নন। এই প্রসঙ্গের জের ধরেই আমার প্রশ্ন হলো যে আপনার নাস্তিকতার কারণ কি?
খুব সভাবিক এবং সহজ ভাবেই শ্বরণী বাবু বললেন
- বেশি কিছু না। মনের ভেতর জাগ্রত হওয়া সামান্য কিছু যৌক্তিক প্রশ্নের যৌক্তিক কোন উত্তর না পাওয়ায় ধর্মের প্রতি আমার এই অবিশ্বাস।
- অর্থাৎ প্রশ্ন গুলোর যথাযোগ্য উত্তর পেলে আপনি আপনার নাস্তিকতা ত্যাগ করবেন এবং আপনার বইয়ে লেখা সকল বক্তব্যকে আপনি ফিরিয়ে নিবেন?
- অবশ্যই! কিন্তু উত্তর গুলো দেবেটা কে?
- মনে করেন যদি আমি দেই?
সাংবাদিকটার বক্তব্য শুনে অডিটরিয়ামে উপস্থিত সকলে কিছুক্ষণের জন্য শ্বরণী বাবুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে অনেকটা অবাক দৃষ্টিতে সাংবাদিকটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। শ্বরণী বাবু হাসি মুখে সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করলেন
- উত্তর গুলো কি আপনি দেবেন?
- কেন? দিতে পারবনা বলে মনে হচ্ছে?
- না, ঠিক তা নয়। উত্তর আপনি নিস্বন্দেহে দিতে পারবেন, কিন্তু সে উত্তর যথাযোগ্য হবে কিনা তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে।
- আপনি আগে প্রশ্নতো করুন।
- ঠিক আছে, আমি প্রশ্ন করছি, কিন্তু উত্তর না দিতে পারলে লজ্জায় পড়তে পারবেন না।
- আশা করি তেমন পরিস্থিতি ঘটবে না।
- তবে ঠিক আছে, আমি প্রশ্নটা করছি। আর সবার জন্যই বলছি, আমার প্রশ্নের উত্তর অন্য কারো জানা থাকলে তারাও এর উত্তর অবশ্যই দিতে পারেন। প্রশ্ন হল আজ যদি আমি বলি আমিই বিধাতা, তবে কি আমার এই পাগলামি মাখা বক্তব্য আপনাদের মেনে নেয়া উচিত হবে? নিশ্চই না, আমাকেও ঠিক সেই ভাবে পাথর মেরে বিতারিত করা উচিত যেভাবে কুরাইশরা মোহাম্মদকে পাথর মেরে মক্কা থেকে বিতারিত করেছিল। কিন্তু কেউ যদি আমার এই বক্তব্যে বিশ্বাস করেই ফেলে তবে বুঝতে হবে যে সে উন্মাদ ছাড়া আর কিছুই না, এবং তাকে সভ্য সমাজে মুক্ত ভাবে ছাড়া কোন ভাবেই নিরাপদ নয়, শিগ্রই তাকে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমি যদি লক্ষ্য জনতার সামনে জাদু দিয়ে একটি মানুষ তৈরী করি, এবং আপনারা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে আমি আমার জাদুর মাধমে একটি জলজ্যান্ত রক্ত মাংশে গোড়া মানুষ তৈরী করেছি। তখন নিশ্চই সেই লক্ষ জনতার আমাকে সৃষ্টিকর্তা বলে মেনে নিতে তেমন কষ্ট হবেনা, এমনকি অনেকে আমাকে বিধাতার আসনে বসিয়ে পূজা, প্রার্থনা, অর্চনা করা শুরু করবে। অর্থাৎ বিধাতার আসনে কাউকে বসাতেও আমাদের এমনই কিছু প্রমান প্রয়োজন, তবে পৃথিবীর কোন ধর্ম গ্রন্থে বিধাতাকে বিশ্বাস করার মত এমন যুক্তিযুক্ত প্রমান আছে?
শ্বরণী বাবুর প্রশ্ন শেষ হতেই অডিটরিয়ামের সকলে উঠে দাড়িয়ে উল্লাস ভরা কলরব এবং হাত তালির জোড়ালো শব্দের মাধমে তার সমর্থন জানালেন, সব থেকে আশ্চর্য বিষয় হল যে সাংবাদিক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কথা বলেছিলেন তিনিও হাসিমুখে হাততালি দিতে দিতে নিজের হার মেনে নিলেন। এবার দর্শকের কাতার থেকে একজন উঠে দাড়ালেন, বেশভূষা দেখে তাকে মুসলিম বলেই মনে হলো, মুখ ভরা দাড়ি, পানি মাকরু হবার ভয়ে গোফ নিখুত ভাবে কমানো, মাথায় সাদা গোল তুপি, যদিও পরনে সাধারণ মানুষদের মতই শার্ট প্যান্ট। আগের নিয়মে মাইক হাতে পাওয়ার পর তিনি শ্বরণী বাবুকে সালাম দিলেন
- আসালামুয়ালায়কুম শ্বরণী বাবু। আমার নাম খুরশেদ আলম।
- আপনার উপরেও শান্তি বর্ষিত হোক, খুরশেদ সাহেব দয়া করে একটু বলবেন আমি আপনাকে যে বাংলাটা বললাম এটার আরবি কি?
- “আপনার উপরেও শান্তি বর্ষিত হোক” এর আরবি হচ্ছে “অলায়কুমুস্সালাম”।
- যাক আপনি অর্থ জানেন, অনেকেই জানে না। তারা ভাবে আরবি শব্দ তো, উচ্চারণেই পুণ্য হয়। এবার বলুন নবী মোহাম্মদ কোন ভাষায় কথা বলতেন?
- আরবি ভাষায়!
- তিনি কারো উপর শান্তি বর্ষণের কামনা করলে তার মাতৃভাষা আরবিতে কামনা করতেন। এখন বাস্তবতা যা দাড়াচ্ছে তা হলো আপনাদের নবী মোহাম্মদ মাতৃ ভাষায় মঙ্গল কামনা করতেন, অর্থাৎ মাতৃ ভাষায় কারো মঙ্গল কামনা করাটা সুন্নত। তাই এখন থেকে কারো মঙ্গল কামনা করলে মাতৃ ভাষাতেই করবেন, তাতে সামনের ব্যক্তিও বুঝতে পারবে যে আপনি কি কামনা করলেন। নাহলে আমার দৃষ্টিতে সাপের মন্ত্র, এবং অর্থ না জানা কুরআনের শব্দ অথবা বাক্য দুটিই এক। এবার আপনি আপনার প্রশ্ন করতে পারেন।
- আপনার একটি বইয়ে আপনি লিখেছেন “আমিও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, শুধু তার উচ্চারণটা প্রকৃতি করি”। তার মানে কি আপনি বিশ্বাস করেন যে এই পৃথিবী, আমাদের জীবন, সৌরজগৎ এবং প্রতিটি প্রাকৃতিক জিনিসের পেছনে কোননা কোন অদৃশ্য শক্তি আছে?
- আসলে আমার কাছে মনে হয় আমি ঈশ্বরবিরোধী নই, আমি ধর্মবিরোধী। কারণ ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমি এটা নিশ্চিত যদি ঈশ্বর থেকেও থাকে, নিশ্চয়ই তিনি তার সৃষ্টির কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা করেন না। তিনি তার সৃষ্টি জীবকে কখনোই শাস্তি দিতে পারেন না। ইশ্বরের সম্পর্কে আমরা যে ধারনাগুলো রাখি যে তাঁর ক্ষুধা, নিদ্রা, জন্ম, মৃত্যু কিছুই নেই, তিনি অমর। আচ্ছা, যার কিছুই প্রয়োজন নেই তার আবার মানুষের কাছ থেকে প্রশংসার প্রয়োজন কেন? আমি আজ পর্যন্ত কনো ধর্মেই ঈশ্বরকে নিস্বার্থ ভাবে কনো মানুষকে স্বর্গ দেওয়ার কথা শুনিনি, স্বর্গ দেয়ার পেছনে থাকবে ঈশ্বরের জন্য বিশাল এক প্রশংসার পাহাড়। আমার কনো এক বইতে লিখেছিলাম যে ”সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে সব চেয়ে বড় মিল হল এরা দুজনেই প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসে।” দুজনের মধ্যে মিল থাকলেও আমি বলব ঈশ্বরের তুলনায় সৃষ্টিশীল মানুষ অধিক উত্তম , কারণ সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির প্রশংসা কেউ না করলে সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই তাকে শাস্তি দেন না, কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্টির প্রশংসা কেউ না করলে তাকে ঈশ্বরের বানানো নরকের নির্মম অত্যাচারের ভয় দেখানো হয়। অস্ত্র দেখিয়ে টাকা আদায় আর নরকের ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস আদায় দুটোই ছিনতাইয়ের অন্তর ভুক্ত। পৃথিবীর কনো ধর্মই বলতে পারবে না যে তার ঈশ্বর প্রশংসা পিপাসী নয়, যে দিন কেউ আমাকে কনো নিঃস্বার্থে ঈশ্বরের খোঁজ দিতে পারবে সেদিনই আমি আমার নাস্তিকতা ত্যাগ করব।
আবার অডিটরিয়ামে শ্বরণী বাবুর সমর্থনে দর্শকদের তালির সুনামি। দর্শকদের সমর্থন পাওয়া শ্বরণী বাবু তার চুরুট টেনে হাসি মুখে প্রশ্ন কারীকে জিজ্ঞাসা করলেন
- আপনার বোধ হয় আরো কিছু প্রশ্ন করার আছে, তাই না?
- জি, আসলে জানতে ইচ্ছা করছিল যে আপনি যেহেতু ধর্মে বিশ্বাসী নন, তাহলে ধর্মে মৃত্যুর পর পরকাল সম্পর্কে যে সব উল্লেখ আছে, এবিষয়ে আপনার কি মন্তব্য?
- আমি যেহেতু বাস্তববাদি তাই ধর্মের কাল্পনিক এবং অযৌক্তিকতা কখনোই আমার মনে বাসা বাঁধতে পারেনি, এবং পরবেও না। প্রতিটি ধর্মেই পরকালের উল্লেখ আছে, পরকাল বিষয়টার সূত্রপাত হয় মানুষের অমর হয়ে থাকার অসীম আকাঙ্খা থেকে। প্রতিটি প্রাণীরই মৃত্যু অনিবার্য, এই বাস্তবতাকে তো আর বদলানো সম্ভব নয়, তাই মৃত্যুর পরের শূন্য অনুভূতিকে অমরত্বের কাল্পনিক গল্প দিয়ে নিজেদের মনকে শান্তনা দেয় ধার্মিকরা। বাস্তবে পরকাল বলতে কিছুই নেই, তবে ভাবার বিষয় হল মৃত্যুর পরের অনুভূতিটা কেমন হবে? সহজ ভাবে বুঝতে চাইলে বলবো জন্মের আগের অনুভুতিটিই হল মৃত্যুর পরের অনুভূতি। অর্থাৎ জন্মের আগেও যেমন পূর্বকাল ছিলোনা, মৃত্যুর পরেও তেমনই কোন পরকাল নেই।
কথাটা শেষ হতে না হতেই অডিটরিয়ামের বাইরে হঠাত উত্তেজিত ভিড়ের হই হুল্লোর শোনা যেতে লাগলো। সবার কর্কশ কন্ঠে একই প্রতিধনী
“মুসলমানের দেশেতে,নাস্তিকেরা থাকবে না।
পাক আল্লার মাটিতে, বিধর্মীদের রাখবোনা।
নাড়ায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার”।
বুঝতে আর বাকি নেই যে উত্তেজিত উন্মাদ মোল্লাদের আগমন ঘটেছে। প্রায় ডজন খানেক বোমা বিস্ফোরনের শব্দ পাওয়া গেল। অডিটরিয়ামের প্রিতিটি মানুষ তখন ওই হিংস্র জানোয়ার গুলোর ভয়ে কাপছে। শ্বরণী বাবুর নিরাপত্তা কর্মীরা দ্রুত তাকে পেছনের রাস্তা দিয়ে বের করে নিয়ে গেলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক পর মোল্লাদের উন্মাদনাটা একটু থামলো। প্রেসক্লাবের মূল দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পুরো অবাক। ঢোকার সময় যে রাস্তাটা দেখেছিলাম, এখন সেই একই রাস্তাকে অচেনা বলে মনে হচ্ছে। চারিদিকে এখন আগুন, রাস্তার অনেক জায়গায় মানুষের রক্তও পড়ে আছে, জানয়ারদেরকে তাড়াতে পুলিশের কাদানি গ্যাসের হালকা গন্ধ এখনো অনুভব করা যাচ্ছে। কিছু দুরেই রক্তাক্ত মোল্লা কিসিমের একজন যুবককে পড়ে থাকতে দেখলাম, বোধহয় পুলিশের লাঠি চার্জে আহত হয়েছে এই মোল্লা। ধর্মান্ধ এই মোল্লাদের প্রতি আমার মনে ঘৃনা থাকলেও রক্তাক্ত যুবকটিকে দেখে মনে একটু মায়া হলো, সাহায্যের হাত বাড়াতে, এগিয়ে গেলাম তার কাছে। যুবকটি বিড়বিড় করে কি যেন বলছে? স্পষ্ট শুনতে তার রক্ত মাখা মুখের কাছে কান নিয়ে গেলাম। বিড়বিড় করে সে বলছে
- নাস্তিক শ্বরণী, তোর মৃত্যু নিশ্চিত। আল্লায় তর মৃত্যু আমগো হাতেই লিখা রাকসে। আল্লায় তোর এমন ভয়ানক মৃত্যু দিব যা দেইখ্যা পৃথিবীর সবার আত্মা কাইপপা উঠবো। আর কয়দিন পুলিশ তরে বাচাইবো?
বিড়বিড় কন্ঠে রক্তাক্ত ধর্মান্ধ যুবকটির কথা গুলো শুনে, হঠাত কেন জানি রাগ চেপে গেল তার উপর। ভেবেছিলাম সাহায্য করবো। কিন্তু সেই সৌভাগ্য জানয়ারটির নেই। পড়ে থাকা তার আধমরা শরীরটির পাশে উঠে দাড়ালাম। এখনো সে ঐরকম কথা বলে যাচ্ছে যে নাস্তিক শ্বরণী, আল্লায় তোরে ছাড়বো না! হিংস্র পশুর সঙ্গে মনুষত্ব দেখানোটা বোকামি। রক্তাক্ত ধর্মান্ধ জানোয়ারটার পেটের উপর স্বজোরে কয়েকটা লাঠি মেরে, তার মুখের উপর থুতু ছিটিয়ে বললাম
- এখনো বুঝতে পারছিস না যে আল্লাহ বলে কেউ নেই, আর থাকলেও তুই যে মানুষ হত্যার মাধ্যমে আল্লহকে খুশি করতে চাইছিস, তাতে যদি সত্যি তিনি খুশি হতেন তবে তোর আজকে মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে হত না, আমার লাঠি খেয়ে এমন করুন ভাবে কাতরাতে হত না। দেখা দেখি তোর আল্লার কত ক্ষমতা, তোকে আজ এমন আধমরা অবস্থা থেকে বাচায় কিনা?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ২:৫৬