somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টানেলের শেষেও শুধু অন্ধকারের গান

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেন্ট্রাল স্টেশনের টানেল দিয়ে হাঁটার সময় বিশ্ব দেখা যায়। টানেলের পাঁচ মিনিটের রাস্তা আমি দশ মিনিটে হাঁটি, বিশ্ব দেখতে দেখতে। দুই দিকের দেয়ালে নানা আঁকি বুঁকি। রাজ্যের ব্যস্ত মানুষ ত্রস্ত হয়ে ছুটছে। কেউ ট্রেইন ধরতে, কেউ ট্রেইন ছেড়ে বাস ধরতে, কেউ ক্লাস ধরতে, কেউ কাজ করতে। আমি আস্তে হাঁটতে থাকি, আর তাই সবাই আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়। ওদের কথার ছেঁড়া অংশ আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি শব্দ দিয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা করি। শুনে শুনে সিডনী আর ইউটিএসের স্টুডেন্টদের আলাদা করি। 'আর বলিস না...' শুনে উৎকর্ন হই... বাঙালি। আর একটা বিশেষ ধ্বনির জন্য কান পেতে রই। টানেলে নানা কিসিমের মানুষ পয়সার ধান্ধায় বসে থাকে। কেউ পুরানো গিটার নিয়ে ক্যাট স্টিভেন্সের গান ধরে, সামনে গিটারের বাক্স বিছিয়ে। সেখানে ভাংতি পয়সার স্তুপ। কেউ আবার আরেকটু অরিজিনাল। কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই মুখ দিয়ে নানা কিসিমের শব্দ করে। ওগুলা শুনা বেশ মজার। কেউ আবার ক্যাসেট ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে গলা মিলায়, চরম ফাঁকিবাজি। আমি শুনি। দেখি। কখনও সখনও কোন সুর আমাকে খুব ছুঁয়ে যায়। হাঁটার গতি স্লথ হয়। মানিব্যাগে হাত চলে যায়।

সেদিন মেয়েটাকে দেখলাম। প্রথমে শুনেছিলাম। টানেলের এক প্রান্ত থেকে। মেয়েটা খালি গলায় গাইছিল। বিষাদ মাখা বিষন্নতার গান। খালি গলার গানের শক্তি যেন প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম। এ গলার সাথে পৃথিবীর সব বাদ্যযন্ত্র পাল্লা দিয়েও একই ঝংকার তুলতে পারবে না বাতাসে। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে গলার অপমান হবে। ওর তীক্ষ্ম, মিষ্টি গান সরু টানেলের পিচ্ছিল টাইলসের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল। যাদুকরী কণ্ঠ যদি কখনও শুনে থাকে, তাহলে এ-ই যে সেই! এক অমোঘ টানে কাছাকাছি পৌঁছতেই আমি থমকে গেলাম। ভূমধ্যসাগরীয় জলপাই রঙের মেয়েটা, মাথায় ঢেউ খেলানো সোনালী চুল। পা পর্যন্ত লম্বা এক গাউন পড়ে আছে। দুই হাত দু পাশে ছড়িয়ে গান গাচ্ছে। পুরা ব্যাপারটায় একটা দেবী দেবী ভাব আছে। কিন্তু এক এক জন যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছে, আর ঝনঝন শব্দে পয়সা ফেলে যাচ্ছে, তখন মেয়েটা থেমে যাচ্ছে। উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শুনে নরম কণ্ঠে বলছে, 'থ্যাংক য়ু'। শুনছে, নিজের গান আর পয়সার শব্দ। মেয়েটা দৃষ্টি শক্তি নেই।

আমি কয়েকবার টানেলের এ পাশ থেকে ওপাশে গেলাম। শুধু অন্ধ মেয়েটার ভিতরটা ছোঁয়া, ছিন্ন ভিন্ন, ওলোট পালোট করা গানটা আরেকটু শোনার জন্য। গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে ছিল, ঢোক গিলেও সরাতে পারলাম না। কি অদ্ভূত যাদুকরী গলা! এক দিকে বাড়াবাড়ি দিয়ে ফেলেছেন বলেই কি স্রষ্টা চোখের আলো দেন নি?

আবার সেদিন, টানেলের মুখে পৌঁছতেই শুনি ভায়োলিনের সুর। বড় নাটুকে সুর। খুব দু:খ দু:খ হয়ে ধীরে শুরু হয়। তারপর হঠাৎই উদ্দাম হয়ে উঠে সে সুর, সব কিছু ভেঙে ফেলতে চায় যেন। তারপর, ধীরে লয়ে আবার হঠাৎ স্বপ্নীল হয়ে উঠে সুরের বন্যা। আমাকে ভায়োলিনের সুর খুব টানে। উৎস খুঁজতে গিয়ে সুরের অর্থ বুঝে ফেললাম যেন। সোনালী চুলের একটা মেয়ে এক মনে ভায়োলিন বাজাচ্ছে। কালো ছোট টপ আর লম্বা কালো স্কার্ট পড়ে আছে। প্রথমেই চোখ চলে যায় ছোট্ট টপের পরে ফুলে থাকা ফর্সা পেটে। মা হবে মেয়েটা। অনাগত সন্তানের জন্য সেন্ট্রাল স্টেশনের টানেলে ভায়োলিন বাজিয়ে ভাংতি পয়সার স্তুপ বানাচ্ছে। আমি নিথর হয়ে যাই। ওর উদ্দাম জীবনের গান, সংগ্রামের গল্প আর অনাগত প্রান ঘিরে স্বপ্ন-কথা শুনি কান পেতে। ছোট্ট প্রানটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর উষ্ণ তরলে ভায়োলিনের নরম সুরে ভাসছে। বুঝে কি সে, এ যে রক্তমাখা কান্নার সুর!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ৩:৫৩
৩৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×