আমাদের ফ্যাকাল্টি এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা, সেই সুবাদে খুব নিয়মিত দেখা হয় না, কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক কথাই হলো। ও কনভার্টেড মুসলিম। সতের বছর বয়সে মুসলিম হয়েছে নিজে পড়াশোনা করে। ও অন্য ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে আন্ডারগ্র্যাডের গত তিন বছর। আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী থাকার প্রেস্টিজ বেশি, তাই এখানে অনার্স করতে চেয়েছে। জানলাম, দুই বছর আগে বিয়ে করেছে। আমার খুব মজা লাগল। আমি বেশ কয়েকজন হিজাবীকে দেখলাম বিয়ের পর রেজাল্ট বাড়াবাড়ি রকমের ভালো করা শুরু করেছে। অথচ, ঢাকায় ফেলে আসা স্কুলের বান্ধবীরা যারা এখন ঢাবি, বুয়েট আর মেডিকেলে পড়ছে, ওরা পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করবে না। পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হবে সেই ভয়ে! হিজাবী মেয়েদের জামাইরা কি বেশি ভালো হয়? (প্লীজ কেউ আহত হবেন না, আমি জানি এটা অ্যাবসুলুউট সত্যি না!)
অনার্সের প্রথম প্রেজেন্টেশনের দিন ফেইথ যখন বিশাল বড় লেকচার থিয়েটারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তখন হঠাৎ করেই সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। হল ভর্তি বিজ্ঞানীরা নড়ে চড়ে বসলেন। উচ্চারন বুঝা যাবে তো? ফেইথ কথা শুরু করতেই সবাই হতভম্ব। দারুন প্রেজেন্ট করলো, প্রশ্নোত্তর পর্বের উত্তরগুলোও দারুণ আত্মবিশ্বাসী ছিল। আমার কেমন অদ্ভূত একটা ভালো লাগা হচ্ছিল।
অনার্সের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনটাও যথারীতি ফাটাফাটি। এক অডিটরিয়াম ভর্তি ডাক্তার, ইউনিভার্সিটি প্রফেসার, অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন প্রথম সারির বিজ্ঞানীর সামনে শুধু চোখগুলো ছাড়া আর সব ঢাকা এই মেয়েটার আত্মবিশ্বাস আর সাবলীলতা রীতিমত ঈর্ষনীয়।
প্রেজেন্টেশনের পরে কথা হচ্ছিল ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। জানলাম ও সিডনী ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্র্যাড মেডিসিনে চান্স পেয়েছে!!!! এতগুলো আশ্চর্যবোধক চিহ্নের কারণ হচ্ছে, সিডনী ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম এবং মহা ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা। সিডনী ইউনির মেডিসিন ভীষণ রকমের প্রেস্টিজাস, চান্স পাওয়াটাও তাই খুবই কঠিন। সাবকন্টিনেন্টের মানুষজন গাল ফুলিয়ে বলে মুসলিম, হিন্দু আর বাদামী চামড়ার কেউই নাকি চান্স পায় না, হিজাবী মুসলিম তো দূরের কথা (নিকাবী তো অকল্পনীয়)! শুনেছি, বিবাহিতদেরও নাকি নিতে চায় না, ক্যারিয়ার ফোকাস কমে যাবে তাই।
আর এই মেয়ে, সবগুলো প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে তিন ধাপের সিলেকশন স্টেইজ পার হয়ে, সামনা সামনি মৌখিক পরীক্ষাতেও উতরে গেল! আমার অদ্ভূত ভালো লাগা হলো।
মেইকআপ আর আমি তেল আর জল, এক সাথে মিশ খাই না। এ যুগের মেয়ে হয়েও কাজল ছাড়া আর কিছু দিতে জানি না, সেটাও খুব মাঝে মাঝে। কিন্তু পোশাক আশাক ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য খুব দরকার, সেটা সব সময় বিশ্বাস করতাম। বোরখা পড়ব, কিন্তু ফুল তোলা নাকি মেটে আর ফর্মাল রঙের, এসব সিদ্ধান্ত নেই পরিস্থিতি বুঝে। এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, হয়তো ব্যক্তিত্বে ঘাটতি আছে বলেই পোশাক আশাক দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করাটা এত দরকারি মনে হয়! বুঝি, নিকাব পরতে অনেকটুকু সাহসের দরকার হয়। অতটুকু সাহস আমার নেই। আমার ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের পরে একজন বুড়ো প্রফেসর মন্তব্য করেছিলেন, 'তোমার প্রেজেন্টেশন দারুণ হয়েছে। স্লাইড, স্টাইল সুন্দর। আর তোমার হাসিটা চমৎকার, সবাইকে মাতিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট।' সেদিনই ফেইথের প্রেজেন্টেশন দেখে মনে হলো, মেয়েটাকে কেউ কখনও শেষের লাইনটা বলবে না। ওর সুন্দর প্রেজেন্টেশনের সেকেন্ডারী কৃতিত্ব কখনও সুন্দর হাসির হবে না। সব সময় ওর আসল মেধা, ব্যক্তিত্ব আর একেবারে ভিতরের সত্ত্বাটাই মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াবে!
*নামটা বদলে দিয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:০৬