somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিকাব = প্রতিবন্ধক?

২২ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনার্সের অরিয়েন্টেশনের দিন দূর থেকে নিকোলের সাথে মেয়েটাকে দেখে আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম। আমার চেয়ে বেশ লম্বা। ৫'৯ এর মত হবে উচ্চতা। আরও লম্বা লাগছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো কুচকুচে বোরখা পরে আছে তাই। দুই চোখ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের যতটুকু শুধু দেখার জন্য দরকার, ঠিক ততটুকুই খোলা। ভুরু দুইটাও ঢাকা। শুধু বুঝা যাচ্ছে, বেশ ফর্সা মেয়েটা। একটু চমকে গিয়েছিলাম, কারণ আমাদের পুরা ফ্যাকাল্টিতে অনার্সের মুসলিম স্টুডেন্ট এতদিন দুই জন ছিল, কিন্তু আমি একাই হিজাবী/ব্যক্তিগত পর্যায়ে সিরিয়াস প্র্যাকটিসিং ছিলাম। প্রেজেন্টেশন করার সময় পুরা হলের সামনে একা হিজাবী দাঁড়াতে একটু সাহস সঞ্চয় করতে হতো! ফর্মাল পোশাক কি পরব, সেই চিন্তায় তটস্থ থাকতাম। এখন আরেকজন দলে জুটলো, তাও একেবারে কালো বোরখা আর চোখ ছাড়া সব ঢাকা! ধারণা করলাম, আরব টারব হবে হয়তো। মুখ খুলতেই আরব উচ্চারণে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনই দ্বিতীয় চমক পেলাম। 'হাই, আই অ্যাম ফেইথ, ফেইথ মরিস*, হাউ ডু য়ু ডু', হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা। ফেইথ মরিস নামটা আরব দূরে থাক, মুসলিমই শোনাচ্ছে না, আর উচ্চারণ আরবদের ধারে কাছে নেই, পুরাপুরি সফিস্টিকেটেড, প্রফেশনাল ইংরেজি!

আমাদের ফ্যাকাল্টি এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা, সেই সুবাদে খুব নিয়মিত দেখা হয় না, কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক কথাই হলো। ও কনভার্টেড মুসলিম। সতের বছর বয়সে মুসলিম হয়েছে নিজে পড়াশোনা করে। ও অন্য ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে আন্ডারগ্র্যাডের গত তিন বছর। আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী থাকার প্রেস্টিজ বেশি, তাই এখানে অনার্স করতে চেয়েছে। জানলাম, দুই বছর আগে বিয়ে করেছে। আমার খুব মজা লাগল। আমি বেশ কয়েকজন হিজাবীকে দেখলাম বিয়ের পর রেজাল্ট বাড়াবাড়ি রকমের ভালো করা শুরু করেছে। অথচ, ঢাকায় ফেলে আসা স্কুলের বান্ধবীরা যারা এখন ঢাবি, বুয়েট আর মেডিকেলে পড়ছে, ওরা পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করবে না। পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হবে সেই ভয়ে! হিজাবী মেয়েদের জামাইরা কি বেশি ভালো হয়? :) (প্লীজ কেউ আহত হবেন না, আমি জানি এটা অ্যাবসুলুউট সত্যি না!)

অনার্সের প্রথম প্রেজেন্টেশনের দিন ফেইথ যখন বিশাল বড় লেকচার থিয়েটারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তখন হঠাৎ করেই সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। হল ভর্তি বিজ্ঞানীরা নড়ে চড়ে বসলেন। উচ্চারন বুঝা যাবে তো? ফেইথ কথা শুরু করতেই সবাই হতভম্ব। দারুন প্রেজেন্ট করলো, প্রশ্নোত্তর পর্বের উত্তরগুলোও দারুণ আত্মবিশ্বাসী ছিল। আমার কেমন অদ্ভূত একটা ভালো লাগা হচ্ছিল।

অনার্সের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনটাও যথারীতি ফাটাফাটি। এক অডিটরিয়াম ভর্তি ডাক্তার, ইউনিভার্সিটি প্রফেসার, অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন প্রথম সারির বিজ্ঞানীর সামনে শুধু চোখগুলো ছাড়া আর সব ঢাকা এই মেয়েটার আত্মবিশ্বাস আর সাবলীলতা রীতিমত ঈর্ষনীয়।

প্রেজেন্টেশনের পরে কথা হচ্ছিল ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। জানলাম ও সিডনী ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্র্যাড মেডিসিনে চান্স পেয়েছে!!!! এতগুলো আশ্চর্যবোধক চিহ্নের কারণ হচ্ছে, সিডনী ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম এবং মহা ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা। সিডনী ইউনির মেডিসিন ভীষণ রকমের প্রেস্টিজাস, চান্স পাওয়াটাও তাই খুবই কঠিন। সাবকন্টিনেন্টের মানুষজন গাল ফুলিয়ে বলে মুসলিম, হিন্দু আর বাদামী চামড়ার কেউই নাকি চান্স পায় না, হিজাবী মুসলিম তো দূরের কথা (নিকাবী তো অকল্পনীয়)! শুনেছি, বিবাহিতদেরও নাকি নিতে চায় না, ক্যারিয়ার ফোকাস কমে যাবে তাই।

আর এই মেয়ে, সবগুলো প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে তিন ধাপের সিলেকশন স্টেইজ পার হয়ে, সামনা সামনি মৌখিক পরীক্ষাতেও উতরে গেল! আমার অদ্ভূত ভালো লাগা হলো।

মেইকআপ আর আমি তেল আর জল, এক সাথে মিশ খাই না। এ যুগের মেয়ে হয়েও কাজল ছাড়া আর কিছু দিতে জানি না, সেটাও খুব মাঝে মাঝে। কিন্তু পোশাক আশাক ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার জন্য খুব দরকার, সেটা সব সময় বিশ্বাস করতাম। বোরখা পড়ব, কিন্তু ফুল তোলা নাকি মেটে আর ফর্মাল রঙের, এসব সিদ্ধান্ত নেই পরিস্থিতি বুঝে। এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, হয়তো ব্যক্তিত্বে ঘাটতি আছে বলেই পোশাক আশাক দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করাটা এত দরকারি মনে হয়! বুঝি, নিকাব পরতে অনেকটুকু সাহসের দরকার হয়। অতটুকু সাহস আমার নেই। আমার ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের পরে একজন বুড়ো প্রফেসর মন্তব্য করেছিলেন, 'তোমার প্রেজেন্টেশন দারুণ হয়েছে। স্লাইড, স্টাইল সুন্দর। আর তোমার হাসিটা চমৎকার, সবাইকে মাতিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট।' সেদিনই ফেইথের প্রেজেন্টেশন দেখে মনে হলো, মেয়েটাকে কেউ কখনও শেষের লাইনটা বলবে না। ওর সুন্দর প্রেজেন্টেশনের সেকেন্ডারী কৃতিত্ব কখনও সুন্দর হাসির হবে না। সব সময় ওর আসল মেধা, ব্যক্তিত্ব আর একেবারে ভিতরের সত্ত্বাটাই মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াবে!


*নামটা বদলে দিয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:০৬
৬৬টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×