মানুষের একটা স্বাভাবিক
প্রবৃত্তি হল কোন কিছুকে যুক্তির
মাধ্যমে গ্রহণ করা। এটা মানুষের
একটা সাধারণ মনস্তত্ত্ব।
একটা উদাহরণ
দিয়ে আলোচনা করা যাক। একজন
অক্ষর জ্ঞানহীন তথাকথিত নিরেট
মূর্খকেও যদি পরিচিত কেউ,
এমনকি অতি আপনজনও যদি বলে,
"তোমাকে অমুক সাহেব
দেখা করতে বলেছেন",
তবে তথাকথিত ওই গণ্ডমূর্খ
লোকটি 'এই দেখা করার'
হেতুটি আগে থেকে অবগত
না থাকলে অবশ্যই
সংবাদদাতাকে জিজ্ঞেস করেন,
"কেন?"। এই প্রশ্নের
উত্তরে সন্তোষ্ট না হলে আর কিছু
জিজ্ঞেস করতে পারেন আবার নাও
পারেন। কিন্তু সন্তোষ্ট
হলে অবশ্যই আরো জিজ্ঞেস করেন,
"কোথায়? ", "কখন?" ইত্যাদি। এই
"কেন" "কোথায়" "কবে বা কখন"
"কিভাবে"
ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নের
মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান
করে কোন কিছুকে গ্রহণ করার এই
যে মানসিকতা এই মানসিকতার
নাম-ই হল
যুক্তিবাদী মানসিকতা। প্রশ্নের
মাধ্যমে বিশেষভাবে কোন
কিছুকে জানার এই
যুক্তিবাদী মানসিকতার অপর
নাম বিজ্ঞান মানসিকতা। তাই
আমরা বলতে পারি সাধারণভাবে প্রতিটি মানুষই
যুক্তিবাদী তথা বিজ্ঞানমনস্ক।
কিন্তু
আমাকে অতি আশ্চর্যজনকভাবে তাজ্জব
করে এই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষগুলোই
কেমন নির্বোধ, যুক্তিহীন,
অবৈজ্ঞানিক আর গোঁয়ারের
মতো আচরণ করেন, যখন বিষয়টা হয়
"ধর্ম"। "ধর্ম" বিষয়ে অধিকাংশ
মানুষই অন্ধ। তারা "ধর্মান্ধ"।
তারা নিজেদের সংস্কার
করে নিতে চান না,
তারা কুসংস্কারবাদী।
তারা ধর্মীয় অনুশাসনের
অযৌক্তিক গণ্ডিরেখার
বাইরে যাওয়ার
কথা ভাবতে পারেন না ধর্মীয়
শোষকদের দ্বারা সৃষ্ট কাল্পনিক
স্বর্গ-নরকের ভয়ে,
তারা ভাবজড়তাগ্রস্ত (ডগমেটিক)।
পুরনো ধ্যানধারণাসম্পন্ন ধর্মীয়
রীতিরেবাজ যা পরবর্তী যুগের
দৃষ্টিতে অযৌক্তিক,
অবৈজ্ঞানিক, শোষণমূলক
এবং সর্বোপরি অমানবিক,
তা নিয়ে অতি বাস্তবসম্মত ও
যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন কোন ধর্মগ্রন্থের
বিরুদ্ধে তুললে এই
কুসংস্কারবাদী ধর্মান্ধরা "মাইরালামু"
"কাইট্টালামু" বলে শুধু তেড়েই
আসেন না,
অনেকে তা বাস্তবায়িতও
করে দেখান। তাদের এহেন
ধর্মাচরণে বীতশ্রদ্ধ ও বিরক্ত
হয়ে কিছু মানুষ পরমচৈতন্যঘন
সত্তা "ঈশ্বরের" অস্তিত্বকেই
অস্বীকার করে বসেন।
তারা নিজেদের "নাস্তিক"
হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ
করেন। তবে তারাও তাদের
কর্মের মাধ্যমে আনন্দরূপী অসীম
অনন্ত ঈশ্বরকেই খোঁজে বেড়ান।
অতিরিক্ত জড় ভাবনার
কারণে তারা এই
আনন্দকে মনে দীর্ঘস্থায়ী করে ধরে রাখত
পারেন না। ধর্মান্ধদের শোষণ,
অত্যাচার আর খুনখারাপির
মতো অমানবিক কাজকর্ম
যুগে যুগে চার্বাক, অজিত
কেশকম্বলী, কার্ল মার্ক্স,
বার্ট্রাণ্ড রাসেল, সলমান
রোশদি, তসলিমা নাসরিন,
মালালা ইউসুফজাই,
কিংবা প্রবীর ঘোষ
প্রভৃতি নাস্তিকদের জন্ম
দিয়েছে। তথাকথিত
আস্তিকেরা এই কথাটি ভুলে যায়
কেন? ধর্মান্ধদের
জাঁতা কলে পড়া বিপন্ন
মানবতাকে উদ্ধার করতে এই
নাস্তিকেরা যা করেন তা ঝুলন্ত
কড়াই থেকে বাঁচতে জ্বলন্ত
কড়াইয়ে ঝাঁপ দেওয়া। হ্যাঁ,
নাস্তিকতা তথা জড়বাদ
সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী।
সে প্রমাণ কালান্তরে দেওয়ার
চেষ্টা করব। কিন্তু এখন কথা হল, এই
নাস্তিকগণ নিজেদের
যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞানমনস্ক
বলে দাবী করলেও "ঈশ্বরের"
অস্তিত্বের স্বপক্ষে ওঠা খুবই
যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত
প্রশ্নকে অতি সযত্নে ও
অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে যান
অথবা অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দেওয়ার
ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এই
এড়িয়ে যাওয়ার
প্রশ্নে কুসংস্কারবাদী আর
নাস্তিকদের মধ্যে কোন পার্থক্য
নেই। কুসংস্কার বুদ্ধির বিকাশ
হতে দেয় না,
বুদ্ধিকে দাবিয়ে রাখে। আর
জড়বাদ তথা নাস্তিকতা বিকশিত
বুদ্ধিকে ধীরে ধীরে ধ্বংস
করে দেয়। আজকের "নব্য-
মানবতাবাদী" চিন্তাধারার
যুগে উভয়ই ত্রুটিপূর্ণ, তাই বর্জনীয়।
এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন
আসে, তাহলে "ধর্ম"
কী এবং "ধার্মিক"ই বা কে?
এবার এক এক করে প্রশ্নগুলোর উত্তর
দেওয়া যাক। প্রথমেই "ধর্ম"
কী নিয়ে আলোচনা করা যাক।
এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত
আছে "ধার্মিক কে"-এর উত্তর।
'ধৃ' ধাতুর সঙ্গে 'মন' প্রত্যয় যোগ
করে "ধর্ম" শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে। 'ধৃ'
ধাতুর অর্থ ধারণ করা (To hold)।
ধারণকৃত যে পার্থক্য
দেখে একটি সত্তাকে অন্য
আরেকটি সত্তা থেকে আলাদা করা যায়,
তাই ধর্ম। ধর্ম কথার মানে হল,
সত্তাগত বৈশিষ্ট্য। ধর্ম শব্দের
প্রতিশব্দ হল, গুণ বা বৈশিষ্ট্য
বা স্বভাব। এর ইংলিশ প্রতিশব্দ
হল, Characteristic বা Property
বা Nature । যেমন, আগুনের ধর্ম
বা বৈশিষ্ট্য হল দহন করা। আগুন ও
তার দাহিকা তথা দাহ্য
শক্তি অবিচ্ছেদ্য। আগুন থেকে তার
দহন শক্তি বাদ দিলে তাকে আর
যাই বলা হোক না কেন আগুন
বলা যায় না। আগুন
যদি না পুড়িয়ে ভিজাতে থাকে,
তবে তাকে আগুন না বলে জলই
বলা হবে। প্রধান বৈশিষ্ট্য দহন
করা ছাড়াও আগুনের আলো ও তাপ
দেওয়ার মতো কতগুলো উপধর্ম
আছে। আগুন বললে একটিমাত্র
'সত্তা'কেই বোঝায়, লাল আগুন,
নীল আগুন, বাংলাদেশের আগুন,
ভারতের আগুন, আমেরিকার আগুন
এইসব কিছু-ই বোঝায় না। যেহেতু
আগুন বললে একটিমাত্র সত্তাকেই
বোঝায় তার রঙ, আকার আকৃতি ও
স্থানগত পার্থক্যকে বোঝায় না,
তাই সকল স্থানের, সকল রঙের
আগুনের একটা সাধারণ (common)
বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম আছে। আর তাহল
দহন করা।
ঠিক তেমনি "মানুষ" বললেও
একটিমাত্র সত্তাকেই বোঝায়,
তার রঙ, আকার আকৃতি বা স্থানগত
পার্থক্য এইসব কিছু-ই বোঝায় না।
তাই অতি স্বাভাবিকভাবেই
'মানুষ' সত্তাটিরও (পৃথিবীর সমস্ত
মানুষের) একটি সাধারণ গুণ
বা বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম আছে। আগুন
সত্তার প্রধান ধর্ম হল দহন করা,
তাহলে মানব সত্তার প্রধান ধর্ম
কী? উত্তরটি বিশ্ববন্দিত কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়
দেওয়া যাক। তিনি বলেছেন,
"....আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্ম
বলতে মহাজাগতিক, বিমূর্ত
বা অলৌকিক কোন কিছু বোঝায়
না ধর্মের লক্ষ্য হল মানুষের
মাঝে ব্রহ্মের অন্বেষণ করা ও
ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে ওঠা"।
সুতরাং সেই বিরাট বিভু
সত্তা ব্রহ্মকে নিজের
মাঝে অন্বেষণ করে তাঁর
সঙ্গে মিলে মিশে একীভূত
হয়ে যাওয়া তথা ব্রহ্মসম্প্রাপ্তিই
হল মানুষের ধর্ম। আর এই ব্রহ্মসম্প্রাপ্
তির জন্য
শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে খাওয়া পরা,
কর্ম করা এসবই হল মানুষের উপধর্ম।
বেদে বলা হয়েছে,
"একহি বহুস্যাম"-- একই বহু হলেন।
যেহেতু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
প্রতিটি সত্তা সেই অসীম
অনন্তরূপী এক থেকেই সৃষ্ট, তাই
অতি স্বাভাবিকভাবেই
প্রতিটি সত্তার মধ্যে সেই একের
সমস্ত গুণ বিদ্যমান আছে। তাই
বলা হয়, "যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
ে তা আছে দেহভাণ্ডে"। এই
কথাটিই বিশ্বে আলোড়ন
সৃষ্টিকারী এক্সিমার লেজারের
আবিষ্কারক বিশ্বখ্যাত
বিজ্ঞানী ডঃ মণি ভৌমিক তাঁর
"বিজ্ঞানে ঈশ্বরের
সংকেত" (যার ইংলিশ নাম Code
Name God -বেষ্ট সেলার পুরস্কার
প্রাপ্ত)-- গ্রন্থের
মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যেই এই
অনন্তকে "আপন হিয়ার মাঝে"
উপলব্ধি করার সাধনা করেন
তিনিই হয়ে উঠেছেন/উঠেন
"মানবতাবাদী"। তিনিই প্রকৃত
ধার্মিক। মানুষের মনুষ্যত্বকে প্রকট
করার, জাগ্রত করার দ্বিতীয় আর
কোন পথ নেই। তাই পৃথিবীর সব
মানুষের ধর্ম একটাই।
এই কথাতে কেউ দ্বিমত নন যে,
আল্লাহ, ভগবান, খোদা, ঈশ্বর, ব্রহ্ম,
God যে নামেই ডাকা হোক
না কেন সবগুলো শব্দের মানে এক
জনকেই বোঝায়। শুধু ভিন্ন ভিন্ন
নামে তাঁকে ডাকার
পদ্ধতিটা ভিন্ন ভিন্ন। ডাকার এই
ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিকে বলা হয়
Religion বা মজহব বা ধর্মমত। মজহব বহু
হতে পারে।
মজহবগুলো মুখ্যতঃ কারোর
মনগড়া কথাকে ঈশ্বরের
বাণী বা প্রত্যাদেশ বলে প্রচার
আর কাল্পনিক স্বর্গ-নরকের (Heaven-
Hell) ভয়ের উপর আধারিত বাহ্যিক
আড়ম্বরপূর্ণ আচার সর্বস্ব অনুষ্ঠান
(Ritualistic) মাত্র। যেমন, ঈশ্বরের
কাল্পনিক
মূর্ত্তি গড়ে পূজার্চনা করে আরাধ্য
ঈশ্বরকে বিসর্জন দিয়ে দেওয়া,
পুণ্যের (ছোয়াবের)
লোভে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ানো,
ঘটা করে অনুষ্ঠান করে ঈশ্বরের
উদ্দেশ্যে প্রাণী হত্যা করে নিজেদের
উদরপূর্তি করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
Religion-এ বিশ্বাসীগণ কোন সত্য ও
অকাট্য প্রশ্নকে সহ্য করতে পারেন
না। এতে তারা অতি সহজেই
ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, হিংস্র
হয়ে ওঠেন। তারা নিজেদের
মতকেই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য
প্রাণপণ অথচ ব্যর্থ
চেষ্টা চালাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
তারা আস্তিক তথা ধার্মিক নন।
কেননা, "ধর্ম এমন একটি ভাব--
যা পশুকে মনুষ্যত্বে ও
মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে"--
স্বামী বিবেকানন্দ।