"দোস্ত, একটা বিড়ি দে" - শুভর কথায় হালকা চমকে উঠি। সে কোনদিন আমাকে দোস্ত সম্বোধন করেনা, নাম ধরে অথবা ভাই করে বলে। কিছু না বলে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেই ওর দিকে। সিগারেটটা ধরিয়ে আমার বিছানায় উঠে বসে সে। চুপচাপ টেনে যায় সিগারেট আর ছাই ফেলে মেঝেতে, কিন্তু কথা বলেনা। প্রমাদ গুনি আমি, কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে, শুভ মোটেও স্বাভাবিক আচরন করছেনা আজকে।
অনার্স ফাইনাল ইয়ার চলছে আমাদের, বছরের শুরু, তাই পড়াশোনার চাপ নেই মোটেও। আড্ডা দিয়ে দিয়ে সময় কাটাই অজপাড়াগাঁয়ে বানানো আমাদের কৃষি কলেজে। প্রতিটি ছাত্রের জন্য আলাদা চাষের জমি লাগে বলে গ্রামের অনেক ভেতরে বানানো হয়েছে এই কলেজ। রাজশাহী শহর থেকে যেখানে যেতে আসতে সময় লাগে ঘন্টা খানেক করে। যাতায়াতের বাহন বাইসাইকেল অথবা রিক্সা। কাজেই খুব বেশী শহরে যাওয়া হয়না কারই, দিনের পর দিন পাশাপাশি থাকার কারনে বন্ধুদের আচরন সম্পর্কে সবাই বেশ ভাল জানে, একটুতেই পরিবর্তনটা চোখে পরে। আমি অবস্য শুভর এই রকম পরিবর্তন আগেও দেখেছি, কিছুটা আঁচ করতে পারি সে কারনেই। প্রতিবারই যখন সে প্রেমে পরে, তখন এমন কিছু না কিছু করে
"নতুন একটা মেয়ে পছন্দ হইছে রে" - সিগারেট শেষ করে লম্বা শ্বাস টেনে বলে শুভ। হেসে ফেলি আমি, পাঁচ বছরের রুমমেটকে চিনতে ভুল হয়নি আমার। "কোন বাসায় কাজ করে?" বলেই এই লাফে টেবিলের অপর পাশে চলে যাই আত্মরক্ষার্থে। শুভ লাফিয়ে ওঠে বিছানা থেকে - "তরে মাইরাই ফালামু আজকে , বারবার কি মানুষ একই ভুল করে না কি?"। বহুদিন আগে শুভ ওদের বাসা থেকে একটু দুরে তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, পরে জানা যায় যে মেয়েটা ছিলো ওই বাসার কাজের মেয়ে সুযোগ পেলে মানুষকে জ্বালানোটা আমার হবি, আমি পারতপক্ষে সেই সুযোগ হাতছাড়া করিনা, আজকেও করিনি। শুভ দৌড়ে আসে আমার দিকে, ঝাপিয়ে পড়তে চায় আমাকে মারার জন্য। আমি আস্তে করে টেবিল থেকে ছোট কাঁচের জারটা তুলে নেই, কালো জঙ্গলী একটা মাকড়শা ভরা আছে ওতে। কোন এক অজানা কারনে শুভ মাকড়শা প্রচন্ড ভয় পায়, তাই আমার রক্ষাকবচ হিসেবে জারটা হাতের কাছেই রাখি আমি। সেটা দেখতে পেয়ে যেন কাঁচের দেয়ালে ধাক্কা খায় শুভ, তারপর গজগজ করতে করতে নিজের বিছানায় গিয়ে বসে বলে "তুই কেন যে ওই জিনিসটা ফালায় দিসনা, আমার ডর লাগে জানসই তো"। হাসতে হাসতে চেয়ারে গিয়ে বসি, তারপর আরেকটা সিগারেট ছুড়ে দেই শুভর দিকে।
"এইবার সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ছি রে, মেয়েটার চোখ দেখলে তুইও প্রেমে পইড়া যাবি" শুয়ে পরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে যায় শুভ। "প্রথমবার দেইখা আমার বেশী ভাল লাগে নাই, কিন্তু কালকে আর আজকে আমার পুরা খবর হইয়া গেছে। ভার্সিটিতে ওর মত আর কেউ নাই। কেন যে আগে বেশী বেশী ভার্সিটিতে যাই নাই। তাইলে আমার একটা প্রেম হইয়াই যাইতো এত দিনে"। মজা লাগে ওর কথা গুলো শুনতে। "এইবার কিন্তু তুই ভুলেও যাবিনা ভার্সিটিতে। তুই সাথে থাকলেই আমার প্রেম হয়না। তুই একটা জন্মের কুফা। যার লগেই কথা বলস, সেই আর আমারে পাত্তা দেয়না"। হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা আমার। এই কথা গুলোই প্রতিবার প্রেমে পড়ার পর বলে শুভ। কিন্তু আমি জানি ভেতরে ভেতরে মেয়েটাকে আমাকে দেখানোর জন্য ছটফট করছে শুভ। যতই বলুক, আমাকে না দেখিয়ে শান্তি পাবেনা সে । "মেয়েটার চুল কত বড় রে?" - আমি জানি শুভ মেয়েদের লম্বা চুল খুব পছন্দ করে। "অনেক চুল, অনেক লম্বা, হাটু পর্যন্ত" - যেন স্বপ্নের ভেতর কথা বলছে শুভ। আমার বিশ্বাস মেয়েটার চুল কোমড় পর্যন্ত হবে, প্রেমে পড়লে মানুষ একটু বেশী বেশী বলে সব কিছু "শুভ, বিয়ার খাবি? মামুন দিয়ে গেছে কয়েক ক্যান" - আমি চাচ্ছি ওর কাছ থেকে আরও কিছু শুনতে। "না রে ভাই, কাইলকা সকালে বাইর হমু, ভার্সিটি যামু, ওরা না কি সকালে হাটতে বাইর হয়। প্রেম করার জন্য সকালবেলাটা খুব ভাল সময়। মানুষের মন ফ্রেস থাকে"। হাসতে হাসতে পেটে ব্যাথা হয়ে যায় আমার। বিরক্ত হয়ে একটানে আমার বিছানার চাদর মেঝেতে ফেলে দিয়ে উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে পরে শুভ, আমিও প্র্যাক্টিকাল খাতা লেখায় মন দেই।
পরদিন সকালে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে শুভ। "আব্বা উঠো, সকাল হইছে" - খুব কোমল গলায় বলে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা আমার হয়না কোনভাবেই, অনেকদিন সকালের ক্লাস মিস্ হয় আমার এই কারনে। বিরক্ত হই, ভাবি সিগারেট নেবে বোধ হয় - "বিড়ি লাগলে নিয়া যা, টেবিলের উপরেই তো আছে"। "বিড়ি নিছি দুইটা, এখন উঠ, চল ভার্সিটি যাই" - খুশী খুশী ভাব ওর গলায়। না উঠলে বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে দেবে দেখে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসি। দেখি সাতসকালে পাঞ্জাবী পড়ে রিতিমত জামাই সাজ দিয়েছে শুভ। মজা লাগে খুব। ওকে মনে করিয়ে দেই গত রাতের কথা - "আমাকে না বললি ভার্সিটিতে না যেতে"। অপরাধী মুখ করে বলে - "তখন তো ফিলিঙ্গসে আছিলাম, তরে ছাড়া আমি টয়লেট ছাড়া আর কোথাও যাইনা তুই তো জানস"। ডাহা মিথ্যা কথা, বিপদে না পড়লে সে আমাকে কোথাও নিয়ে যায়না হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে ফ্রেস হই, ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুঝতে পারি ওর এত আদরের কারন। আমার বাইকটা বারান্দায় পার্ক করা আছে গতকাল থেকে, তাই সে বাইসাইকেলে না গিয়ে বাইকে করে যেতে চায়। হবু প্রেমিকার কাছে ভাব নেবার ক্ষুদ্র চেষ্টা আর কি
পাশের রুমের রানাও আমাদের সঙ্গি হয় যাবার সময়। যেতে যেতে ওদের কথায় বুঝতে পারি এবারের ম্যাচ মেকার রানা। মেয়েটা রানার গার্ল ফ্রেন্ডের বান্ধবী। আমার বাইকে হাত মোটামুটি ভাল, আমি স্লো চালাতেই পারিনা। এ নিয়ে প্রথম প্রথম শুভ কমপ্লেইন করলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ করে আস্তে চালাতে বলে আমাকে। প্রেম মানুষকে আসলেও বদলে দেয়, জীবনের মায়া বাড়িয়ে দেয় অনেক। কিন্তু আমি তো প্রেমে পড়িনি, কাজেই স্পীড আরও বাড়িয়ে দেই, পেছনে বসা জুনিয়র রানার অস্তিত্ব অস্বিকার করে শুভ ক্রমাগত আমার কানের কাছে গালাগালী করতে শুরু করে। হাসতে হাসতে ক্যাম্পাসে পৌছে যাই আমরা।
তাপসী রাবেয়া হলের পাশেই বড় একটা পুকুর। তার পাশেই বাইক পার্ক করে বসে পড়ি আমরা। ছুটির দিনের এই সকাল বেলাতেও হলের সামনে, পুকুর পাড়ে বসে আছে অনেক জুটি, মৌ'য়ের স্মৃতী মনে করিয়ে দেয় আমাকে। মাঝে মাঝে এখানেও কিছু সময় কাটিয়েছি আমরা। দুসপ্তাহ আগে বিয়ে হয়ে গেছে ওর। তারপর থেকে নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছি ইচ্ছে করেই। কষ্টটা ভোলার চেষ্টায় আছি। পারছিনা মনে হয়। কোথায় যেন, কেমন যেন একটা ব্যাথা টের পাই প্রতি মুহুর্তে।
কিছুক্ষন পরে হলের গেট দিয়ে বেড়িয়ে আসে সম্পা, সাথে একটা মেয়ে, যাকে মেয়ে না বলে কাপড় পড়ানো পেন্সিল বললেই মনে হয় বেশী মানায়। এত চিকন মানুষ হয়? ওকে কি খেতে দেয়না হলে? মনে মনে বলি - শুভর চোখে প্রব্লেম আছে, ওকে চোখার ডাক্তার দেখাতে হবে, এবং সেটা আজই। ওরা এসে বসে আমাদের সাথে, পরিচিত হই ওদের সাথে। শুভর হবু গার্ল ফ্রেন্ডের নাম তিথী। তারপর সিগারেট খাবার নাম করে সরে আসি একটু, আসলে খুব খারাপ লাগছিল আমার। একটু পরে শুনতে পাই শুভ বলছে আমার গার্ল ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ আমার। আসলে এটা ওর সেলফ ডিফেন্স। শুভর বদ্ধমুল ধারনা আমি ওর জন্য চরম কুফা, তবুও সে কেন আমাকে প্রতিবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে সেটা আমি নিজেও জানিনা।
দুপুর বেলা সবাই একসাথে খেতে যাই ক্যান্টিনে। অপরিচিত মেয়েদের সামনে বসে আরাম করে খেতে পারিনা আমি। তখন দেখি সম্পা তিথীকে মুরগীর মাংস আর হাড় আলাদা করে দিচ্ছে। আজব কাজ কারবার। মেয়েরা কত যে ঢং জানে মনে মনে হাসি আর বলি - শুভ খবর আছে তোর। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ল' ফ্যাকাল্টির মাঠে গিয়ে বসি। রানা আর সম্পা একটু দূরে বসে মনের সুখে প্রেম করে, আমি, শুভ আর তিথী বসে থাকি। হঠাৎ নিজেকে কাবাবের হাড্ডি বলে মনে হয়, তখনই কাজ আছে বলে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। বাইকে উঠে মনে হয় শুভ ভুল বলেনি। তিথীর চোখে আসলেও কেমন যেন একটা মায়া খেলা করে। দিঘীর মত শান্ত চোখ বোধ হয় একেই বলে।
ক্রমশ ...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ দুপুর ২:১৭