প্রতি বছর অক্টোবর নভেম্বর মাসে এই ব্লগটা লেখার কথা ভাবি। কখনই সেভাবে শুরু করা হয়না। নভেম্বরের ৭ তারিখে কিছু একটা লিখে পোষ্ট করে দেই, কিন্তু ভ্রমণের খুটিনাটি বিষয় গুলো আড়ালেই থেকে যায়। পরে মনে হয় কত কি যে লেখার ছিল। সময় করে উঠতে পারিনা এখন। কিন্তু ভাবছি অন্তত সপ্তাহে একটা হলেও ব্লগ দেবো। দেখা যাক কি করতে পারি
৭ই নভেম্বর ২০০৪
সকালে একটু দেরি করে উঠি ঘুম থেকে। বাবুই আমার ঘুম ভাঙ্গায়। ছোট্ট দুই হাতে আকড়ে ধরে থাকে আমাকে। গত পাঁচ মাসে কখনই এমন করেনি সে। বুকের সাথে জাপটে ধরে রাখি আমার সন্তানকে। মা কেঁদে ফেলেন দেখে, বলেন "বাবা চলে যাবে বুঝতে পেরেছে আদিত্য। তাই এমন করছে"। তারপর কেমন করে যেন শেষ হয়ে যায় দিনটা। হঠাৎ করে দেখি সন্ধে হয়ে গেছে। দুপুরেই সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে এসেছিলাম। সারাটা দিন বাবু আমার কোল থেকে নামেনি একবারও। আমার কোলেই ঘুমিয়েছে, খেয়েছে। ইফতারের পর সুটকেস তালাবদ্ধ করি, গুছিয়ে নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, টিকেট। রাত ৯ টার দিকে তৈরী হয়ে যাই। বাবুকে কোলে নিয়ে আর কান্না চেপে রাখতে পারিনা, কি বুঝে যেন কান্না করে ওঠে বাবুও, সে কান্নায় যোগ দেয় তিথী।
১০টার দিকে বেড়িয়ে পরি, আমি, বাবু, তিথী, বাবা - মা, ভাবী আর মামি। এয়ারপোর্টে চেক ইন করে বেড়িয়ে পড়ি, সবার কাছ থেকে বিদায় নেই, বাবুকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলে যাই। আব্বু আর তিথী আসে সাথে। একটু পরেই প্লেনে ওঠার এনাউন্সমেন্ট হয়। বাবুকে অনেক গুলো চুমু দিয়ে আব্বুর কোলে দিয়ে দেই, যেতে চায়না সে, কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, ছোট্ট দু'হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে আসবে বলে। বুকের মদ্ধে কেমন যে করে, প্রকাশ করতে পারিনা।
এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকে লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র দেখাই, শুরু হয় অপেক্ষার পালা। ডিপার্চার লাউঞ্জের এক কোণে টেলিফোন বুথ দেখে ফোন করতে উঠে যাই, ভেতরে বসে থাকা লোকটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেন, তার নিজের মোবাইল। এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষারত মা কে ফোন করে কথা বলি ২ মিনিট মত, চার্য রাখে ৭৫ টাকা। কোন রিসিট না দেয়ায় বুঝি গোটা টাকাটাই পকেটস্থ করেছে লোকটা। কিন্তু কিছুই করার নেই।
কিছুক্ষন পর প্লেনে ওঠার এনাউন্সমেন্ট শুনতে পাই, জীবনে প্রথমবারের মত প্লেনে উঠবো, একটা উত্তেজনা কাজ করে। মেটাল ডিটেকটরের দরজা দিয়ে গিয়ে দাড়াই একটা ছোট ঘরের মধ্যে। তারপর ছোট একটা সুড়ঙ্গপথে ঢুকে পরি আর সবার সাথে, এক এক করে। অনেকটা মুভীতে দেখা স্পেসশীপের মত লাগে চলতে চলতে সুড়ঙ্গ পার হতেই প্লেনের দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে স্বাগত জানান প্লেনের ক্যাপ্টেন (পাইলট) আর ট্রেডিশনাল সিঙ্গাপুরী পোষাক পরা সুন্দরী বিমানবালা
এয়ারবাস ৩৩০ প্লেনটা অনেক বড়। বোর্ডিং পাস দেখে সিটের সামনে নিয়ে যায় বিমানবালা। হ্যান্ডব্যাগ ওপরের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রেখে সিটে বসে পড়ি। পাশে এসে বসে লুঙ্গি পড়া এক লোক একটু পরে বলে - ভাইজান, গিট্টুটা দিবার পারতাছিনা তো" সিটবেল্ট বাঁধা দেখিয়ে দেই উনাকে। তারপর প্লেন ছাড়ার এনাউন্সমেন্ট হয়। আস্তে আস্তে ট্যাক্সিং করে প্লেন চলে যায় রানওয়ের ওপর, আমি ভাবি এভাবে চলতে চলতে প্লেন আকাশে ওড়ে? আমার ধারনা ভুল প্রমান করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর প্লেন রানওয়েতে চলা শুরু করে। এবার কিন্তু আগের মত নয়, অনেক বেশী দ্রুত। যাত্রার এই অংশটা সবচাইতে উপভোগ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। এত বড় একটা বিমান, হঠাৎ রেসিং কারের মত স্পিড নিয়ে কয়েক মুহুর্তে মাটির মায়া কাটিয়ে টেকঅফ করে।
টেকঅফ করার পর কিছুক্ষন প্লেনটা ওপরের দিকে উঠে এক সময় সোজা হয়। জানালা দিয়ে দেখি রাতের ঢাকা, মায়া - বড় মায়া লাগে এই শহরটার জন্য, মাটির টান আর কি। চোখের কোণে জমে অশ্রু, মুছে ফেলিনা, গাল বেয়ে ফোটা ফোটা জলের ধারা কোলের ওপর পরে। চোখে ভাসে আমার সন্তানের মুখ। এ কান্না আমি থামাতে পারিনা অনেক্ষন। একটু পরেই বিমানবালা খাবারের ট্রে নিয়ে আসে। আমাকে কাঁদতে দেখে আলতো করে হাত রাখে আমার কাঁধে। অচেনা অজানা একজন মানুষের সহমর্মিতা দেখে বেশ ভাল লাগে। চোখের পানি মুছে খাবারের প্লেট হাতে নেই।
পাশে বসা লোকটি ট্রে থেকে কি নেবে বুঝতে পারেনা, উনি হালাল খাবার অর্ডার করেননি, বিমানবালাকে বুঝিয়ে বলি, সৌভাগ্য যে এক্সট্রা হালাল খাবার ছিলো, মনে হয় অনেক বাংলাদেশী প্যাসেঞ্জারই হালাল খাবারের অর্ডার করেন না। যা হোক, উনাকে খাবারের ট্রে দিয়ে দেখিয়ে দেই কি করে খুলতে হবে প্যাকেটগুলো, লজ্জা লজ্জা মুখ করে খাওয়া শুরু করেন উনি, আমিও। এরাই দেশের জন্য মুল্যবান বৈদেশীক মুদ্রার যোগান দেন, উনাদের ছোট করে দেখবার অবকাশ নেই।
খাওয়া শেষ করে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, মাঝে মাঝে নীচের পৃথিবীতে আলোর ছোট্ট বিন্দু দেখা যায়, বোঝা যায়না কোন শহরের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে যায় তখন। জেগে উঠি বিমানের ঝাকুনীতে। ভয় ভয় লাগে, কিন্তু হালকা ঝাকুনীর পর প্লেন আবার আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সিঙ্গাপুর যেতে সময় লাগেনা বেশী। কয়েক ঘন্টা পরেই পৌছে যাই সিঙ্গাপুরে।
সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে নেমে ধাঁধাঁয় পরে যাই, বিরাট বড় এয়ারপোর্ট, কোন দিকে যাব বুঝতে পারিনা। পরে বোর্ডিং পাস বা অন্য একটা কাগজে দেখি গেট নম্বর দেয়া আছে, খুঁজে খুঁজে বের করি গেটটা, ভাল করে দেখে নিয়ে এয়ারপোর্টে ঘুরতে থাকি, ট্রানজিট প্রায় ৪ ঘন্টা। এয়ারপোর্টের ভেতর ফোন কার্ডের দোকান দেখে একটা কার্ড কিনে ফোন বুথ থেকে বাসায় ফোন দেই। কথা বলি সবার সাথে। আব্বু আসার সময় বারবার বলে দিয়েছেন হালাল সিল ছাড়া কিছু না খেতে, দোকানে দোকানে ঘুরি, খাবার মত কিছু পাই না সারা দিন রোজা ছিলাম, খিদে লেগেছিলো অনেক, কিন্তু সময় দেখি সকাল হবার কাছাকাছি, তাই না খেয়েই রোজার নিয়ত করে ফেলি। তারপর ডিপার্চার গেটের পাশে বেঞ্চে বসে বসেই ঘুমিয়ে যাই। ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভাঙ্গে মানুষের আসা যাওয়ার শব্দে। দেখি গেট খুলে দিয়েছে, লাইন ধরে মানুষ যাচ্ছে ভেতরে। সকাল হয়ে গেছে ততক্ষনে।
আরেক দফা চেকিং এর পর বোর্ডিং পাস নিয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষন পর আবার সুড়ঙ্গ পথে প্লেনে উঠে পরি, এবারের বিমানটা বোইং ৭৭৭, আরও বড় আর আধুনিক। সহযাত্রীদের বেশীরভাগই সাদা আর বেশ কিছু চাইনিজ চেহারার, কিছু বাংলাদেশি ছেলে মেয়েও আছে। এবার পাশের সিটে বসে গম্ভীর চেহারার সাদা এক বুড়ী। বসেই ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে দেয়, আমিও বসে বসে সিটের পেছনের ছোট মনিটরের মেনু থেকে মুভী সিলেক্ট করে দেখতে চেষ্টা করি। কিছুক্ষন পর আবার টেকঅফ করে প্লেন, আবার সেই দুরন্ত গতীতে ছুটে চলা, তারপর যেন ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে আকাশে উঠে পরা।
এবারের যাত্রাটা অনেক লম্বা, প্রায় আট ঘন্টা। চিন্তা করলাম এই সুযোগে অন্তত ৩টা মুভী দেখে ফেলা যাবে। মুভী খোঁজা শুরু করলাম, একশন ছবি তেমন ভাল লাগলোনা কোনটাই, পরে কার্টুন দেখতে আরম্ভ করলাম। এর মাঝে এয়ার হোষ্টেজ খাবার নিয়ে এলো, কিন্তু আমি তো রোজা মজার মজার সব খাবার দেখে মনে হলো রোজা ভেঙ্গে খাওয়া শুরু করি
কিন্তু খাওয়া হলোনা কিছুই। এয়ার হোষ্টেজকে বেশ বিচলিত ও বিব্রত মনে হলো আমি কিছু না খাওয়াতে। এই আন্তরিকতাটুকুই আমার জন্য অনেক। যাত্রাপথে কয়েকবার সে খাবার সেধেছে আমাকে, আমি বলেছি সুর্য ডোবার আগে কিছু খেতে পারবোনা। তারপর কিছুক্ষন মুভী দেখে ঘুমিয়ে গেছি। আবার প্লেনের ঝাকুনীতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে, সিট বেল্ট বেঁধেও নিতে হয়েছে দু বার। একবার মনে হলো বিমান হঠাৎ শুন্য থেকে অনেক নীচে পড়ে গেলো নীচে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, সাগর আর সাগর। দেখতে দেখতে আবার ঘুমিয়ে গেছি কখন নিজেই জানিনা। এক সময় এনাউন্সমেন্ট হলো সিট বেল্ট বাঁধার, পৌছে গেছি আমরা। নীচে তাকিয়ে সিডনী দেখার চেষ্টা করি, এত ওপর থেকে কিছুই বোঝা যায়না তেমন।
প্লেন তখন নীচে নামছে। এর মাঝে কখন যেন সুর্য ডুবেও গেছে। আমার মনে না থাকলেও এয়ার হোষ্টেজ ঠিকই মনে রেখেছে। কোথা থেকে দৌড়ে এসে সে আমার হাতে খাবারের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে গেল, বললো এভাবে নীচে নামার সময় খাবার দেবার নিয়ম নেই, কিন্তু যেহেতু আমি কিছুই খাইনি সারাটা সময়, কাজেই আমাকে সে খাবারটা দিয়ে গেল, তখনই খেয়ে নিতে বললো, কারণ খাবার নিয়ে এয়ারপোর্টে ঢোকা যাবেনা। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খেয়ে নিলাম তারাতারি।
প্লেন ল্যান্ড করলে বেরিয়ে এলাম বিমান থেকে, নাথিং টু ডিক্লেয়ার লাইন দিয়ে খুব দ্রুত চলে এলাম বাইরে, বেল্টের ওপর থেকে নামিয়ে নিলাম আমার বিশাল সাইজের ব্যাগ। বের হবার দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুকে দেখে খুব ভাল লাগলো। দুজনে বের হলাম এয়ারপোর্ট থেকে। অনেকদিন পর দেখা, কিন্তু এত বড় জার্নির ক্লান্তি অনুভব করতেই পারছিলামনা তখন। এয়ারপোর্টের বাইরে বসে আমাদের গল্প যেন শেষ হয়না আর। এক সময় খিধে পেয়ে গেল খুব। তখন উঠে ট্যাক্সি নিয়ে যে বাসায় থাকবো সেখানে চলে এলাম।
সিডনীতে নেমেই বাতাসে যেন ভাজা পাউরুটির গন্ধ পেয়েছিলাম, সেই গন্ধটা কয়েকদিন নাকে লেগে ছিলো। ঢাকার পেট্রোলের গন্ধমাখা বাতাস থেকে এই দেশের বাতাস অনেক পরিচ্ছন্য লাগলো। যা হোক, বাসায় ঢুকে সবার সাথে পরিচিত হয়ে গোসল করে ফোনটা হাতে নিয়ে শুয়ে পরলাম, বন্ধু যাবার আগে ফোনকার্ড দিয়ে গেছে, বুঝিয়ে দিয়ে গেছে কিভাবে কল করতে হয়। বাসায় ফোন করে সবার সাথে কথা বলে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। বুকের ভেতরটা খুব ফাঁকা লাগছিলো তখন। গত ছয়টা মাস আমার কেটেছে বুকের মধ্যে আমার সন্তানকে জড়িয়ে রেখে।
এভাবেই চলে এলাম স্বপ্নের দেশে, পেছনে পরে রইলো আমার প্রিয় ঢাকা শহর।
চলবে ...
(ছবি গুগোল মামার সৌজন্যে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১০ ভোর ৫:৪৮