জাপানে গত ১১ই মার্চ ২০১১'তে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূকম্পন ও সুনামির ধ্বংসলীলা সম্পর্কে আমরা সকলেই কম বেশী জানি। U.S. Geological Survey - National Earthquake Information Center থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে গত ১৩ই জুন ২০১০ সালে একই স্থানে ৬.১ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এই বছর ১০ই মার্চ তারিখেও প্রায় একই স্থানে ৬, ৬.১, ৬.৩ মাত্রার ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়। ১১ই মার্চ তারিখে সেখানেই প্রথমে ৭.৯, ৬.৮, ৭.১ ও পরে ৮.৯ মাত্রার ভূকম্পনে সাগরে প্রবল সুনামির সৃষ্টি হয়, যা টোকিও থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে মিয়াগি, ফুকুসিমা, নারিতা উপকুলে আঘাত হানে ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। জাপানে ভূমিকম্প নতুন কোন ঘটনা নয়। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে - ৬৮৪ খৃষ্টাব্দ থেকে ২০১১ পর্যন্ত জাপানে প্রায় অর্ধ শতাধিক ভূকম্পন রেকর্ড করা হয় যা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। ১৯২৩ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর " 1923 Great Kantō earthquake " প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের প্রানহানি ঘটে। এর পর থেকেই মূলত জাপানে ভূমিকম্প সহনশীল ইমারত নির্মাণের উপর ব্যাপক জোর দেয়া হয়। যার ফলে ২০১১ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পরেও অধিকাংশ ইমারতের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এবার সুনামির পানির ঢল সব চাইতে বেশী ক্ষতিসাধন করে।
সুনামির ফলে ভেসে যাওয়া শহরগুলোতে যা ক্ষতি হয়েছে, তার চাইতেও বেশী ক্ষতির ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুকুশিমা দাই-ইচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বিস্ফোরণ। Tokyo Electric Power এর অধীনে থাকা এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিটটি প্রথমে বিস্ফোরিত হয়, পরে ১ ও ৩ নম্বর ইউনিটেও বিস্ফোরণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই খবর প্রকাশের সাথে সাথে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট মেল্ট ডাউনের বিষয়টি পত্র পত্রিকায় ও সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। আমরা অনেকেই জানি যে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কিভাবে কাজ করে ও মেল্ট ডাউন আসলে কি - সেটা নিয়ে কিছু তথ্য জানাতেই এই ব্লগের অবতারণা।
পৃথিবীতে কয়েক প্রকারের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। ফুকুশিমায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একটি Pressurised Water Reactor, যেখানে পারমানবিক ফিউশনের ফলে সৃষ্ট তাপ নিয়ন্ত্রণের (কুলিং) জন্য পানি ব্যবহৃত হয়। খুব সাধারণ ভাবে বর্ণনা দিতে গেলে প্রক্রিয়াটি হবে নিম্নরূপ -
১) ফিশন: পরমাণুর ফিশনের ফলে তৈরি হয় তাপ। এ ক্ষেত্রে একটি মুক্ত নিউট্রন একটি ইউরেনিয়াম অণুকে আঘাত করে ও ইউরেনিয়াম অণুটি মুক্ত নিউট্রনটিকে শুষে নিয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে ও বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণের ফলে তৈরি হয় তাপ। সাথে সাথে বিস্ফোরণের সময় কিছু নিউট্রন মুক্ত হয়ে যায়, যা অন্যান্য ইউরেনিয়াম অণুকে আঘাত করে ও বিস্ফোরণ ঘটায়। এভাবেই চলতে থেকে ফিশন।
২) তাপের সাহায্যে পানিকে বাষ্পীভূত করা: ইউরেনিয়ামের বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পীভূত করা হয়।
৩) টারবাইন ঘোরানো: বাষ্পের চাপকে কাজে লাগিয়ে পাওয়ার প্ল্যান্টের টারবাইন ঘোরানো হয়।
৪) বিদ্যুৎ উৎপাদন: টারবাইনের অপর প্রান্তে লাগানো বৈদ্যুতিক জেনারেটরের চাকা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। প্রক্রিয়াটি আমাদের দেশে ব্যবহৃত ডিজেল জেনারেটরের মতই। ডিজেল জেনারেটরের ক্ষেত্রে একটি ডিজেল ইঞ্জিন জেনারেটরের চাকা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
নিউক্লিয়ার রিএক্টরের ভেতর ইউরেনিয়াম রড গুলো সজ্জিত থাকে। ফিশনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রক রড ব্যাবহার করা হয়। নিয়ন্ত্রক রড ইউরেনিয়াম রড গুলোর ওপর ঢাকনার মত বসে গিয়ে ফিশনে বাধা দেয়। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে - নিয়ন্ত্রক রড গুলো রিএক্টরের ভেতর নিউট্রনের সংস্পর্শে আসা ইউরেনিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ফলে তাপ কম উৎপন্ন হয়। আর সম্পূর্ণ রিএক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পানি ব্যাবহার করা হয়। এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের ফলে যে বাষ্প নির্গত হয়, তা দিয়েই টারবাইন ঘোরানো হয়। অতিরিক্ত বাষ্প বিশাল চিমনী দিয়ে বের করে দেয়া হয়।
কোন কারণে রিএক্টর বন্ধ করে দিলেও কয়েকদিন পর্যন্ত রিএক্টরের ভেতর উচ্চ তাপমাত্রা থাকে। কারণ পারমা্ণবিক বিক্রিয়া হঠাৎ করে সম্পূর্ণ থামিয়ে দেয়া যায় না। রিএক্টরের তৈরি বিদ্যুৎ দিয়েই রিএক্টরে পানি সরবরাহের পাম্প গুলো চলে। তাই রিএক্টর বন্ধ করে দিলে ডিজেল জেনারেটর অথবা ব্যক আপ জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালিয়ে রিএক্টরে পানির প্রবাহ সচল রাখা হয়। ডিজেল জেনারেটর কাজ না করলে ব্যাটারি ব্যাবহার করে পাম্প সচল রাখারও ব্যবস্থা আছে। এই পানির প্রবাহ যদি কোন ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে রিএক্টরের তাপমাত্রা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, ফলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে।
ফুকোসিমা দাই-ইচিতে যা ঘটেছিলো:
১) ভূমিকম্পের ফলে রিএক্টরের দেয়ালে ফাটল ধরে।
২) সুনামির পানি পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রবেশের ফলে পাওয়ার প্ল্যান্টে বন্ধ করে দেয়া হয়।
৩) ডিজেল জেনারেটর সুনামির পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে সেটি ব্যাবহার করা যায়নি।
৪) ব্যাটারি দিয়ে পাম্প চালালেও ব্যাটারি মাত্র ৮ ঘণ্টা পাম্প গুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
মেল্ট ডাউন কি এবং এর ফলাফল:
রিএক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পরলে রিএক্টরের ফুয়েল রড তথা ইউরেনিয়াম রড গুলো গলে গিয়ে রিএক্টরের মেঝেতে তেজস্ক্রিয় জ্বালানী ছড়িয়ে পড়তে পারে। রিএক্টরের মেঝে ২১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। কিন্তু রিএক্টরের ভেতরের অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যেতে ফলে। ফলে রিএক্টরের মেঝে গলে গিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটির নীচে চলে যাবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের সাথে মিশে যাবে। যেহেতু দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানি মাটির নীচ থেকেই সংগ্রহ করা হয়, সেক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।
ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানোর জন্য ফুকোসিমা দাই-ইচি পাওয়ার প্লান্টের রিএক্টরের ভেতর সাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানো হচ্ছে। যার ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাগরের লবণাক্ত পানি ইউরেনিয়াম রডগুলোর এবং গোটা রিএক্টরের ক্ষতি সাধন করবে। ফলে পুনরায় এই রিএক্টর চালু করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু এতে করে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানো যাবে।
সর্বশেষ: রিএক্টর ঠাণ্ডা করার জন্য দেয়া পানির কিছু অংশ বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে এসে পাওয়ার প্লান্টটির ১ নম্বর ইউনিটে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বর্তমানে ২ ও ৩ নম্বর ইউনিট বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
জাপানে প্রলয়ঙ্করী ৮.৯ অথবা ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পরে আরও প্রায় শতাধিক ছোট ছোট ভূমিকম্প ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা আরও একটি উঁচু মাত্রার ভূকম্পনের আশংকা করছেন যার ফলে আরও একবার সুনামি দেখা দিতে পারে।
তথ্যসুত্র:
=> Click This Link
=> http://earthquake.usgs.gov
=> The Daily Telegraph (anatomy of meltdown); 14/03/2011
=> MX news paper ; 15/03/2011