সিপ্পি আরসুয়াং (মোরগের সবচে উচু ঝুটি) পর্বতের ২ নাম্বার পিক (আরসুয়াং) মেঘের চাদরে ঢাকা পড়েছে।
আমরা রোয়াংছড়ি বাজার থেকে বম পাড়ার উলটা দিকের রাস্তা ধরে হাটা শুরু করলাম। উচু নিচু পাহাড়ি পথ দিয়ে অল্পক্ষনেই ঝিরির পথে নামলাম। পাহাড়ে ঝিরি একটা বড় যোগা যোগ মাধ্যম। দু পাশে উচু উচু পাহাড়ি দেয়াল। অন্ধকার হয়ে থাকে। জায়গাগুলোতে গাছ পালা খুব বেশি, সুর্যের আলো আটকে আটকে দেয়। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝির ঝির করে অসংখ্য স্রোত নামে, কেউ কেউ মাইক্রো ঝর্না গুলোকে বলে পাহাড়ের ঘাম। নিচে পানি টলটলে স্বচ্ছ আর আরামদায়ক তাপমাত্রার। পাথুরে, পথে আদিবাসীরা মাঝে মাঝে গর্ত করে রাখে। গর্তগুলো আসলে একধরনের কুয়া, পানির মধ্যে তৈরি জলাধার। ঝিরির পথ দিয়ে হাটা সবসময় খুব আনন্দের। যারা কেওকারাডং, তাজিন ডং কিংবা বগালেকে ট্রেকিং করেছেন তারা সবাই সবসময় রুমা বাজারের ঝিরির ট্রেইলটাই প্রথম অপশন হিসাবে নেন।
ঝিরির পথে নামা
ঝিরির পথ
ঝিরির শেষ
একঘন্টার মত ঝিরির পথ দিয়ে হাটলাম। রাস্তা একটু পড়ে পড়ে কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তবে হারানোর ভয় নেই। লাল তুয়ার দাদা আছে। একটু পর পর আরো লোকজনদের দেখা পাচ্ছিলাম। পাহাড় থেকে বাশ কিংবা জ্বালানী কাঠ কেটে ঝিরির স্রোতে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসছিলো। অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারছিলো। ছবি তুলতে তুলতে আমরা কয়েকজন পিছিয়ে পড়েছিলাম, তাছাড়া প্রতিটা ঝর্নার পানি টেস্ট করার ছেলেমানুষী নেশা ছিল। তাই পিছিয়ে পড়লেই কাঠুরেদের হেল্প নিয়ে সামনের দল কে ধরে ফেলছিলাম। দির্ঘক্ষন হাটার জন্যে লাঠি নিতে হয়। স্রোতের টানে ভেসে আসা একটা বড় সেগুন ডাল ভাঙ্গতেই চমতকার লাঠি হয়ে গেল। হাতলের জায়গাটা চমতকার বাকানো। সুইস নাইফ দিয়ে একটু ছিলকা তুলতেই অসাধারন সেগুনের ওয়াকিং স্টিক হয়ে গেল সেটা। বাকী সবাই অবশ্য বাঁশ নিচ্ছিলো। বাঁশ এখানে প্রচুর। ঘোড়া হাসিব খালি সুবিধা মত কিছু পেলনা। স্থানীয় একজন লম্বা চুলের বম কাঠুড়ে স্রোতে টেনে টেনে বাঁশের ঝার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তাকে গিয়ে সে রিকোয়েস্ট করলো,
' দাদা আমাকে বাঁশ দেবেন, প্লিজ, দেননা একটা বাঁশ
লোকটা বাংলা জানেনা, তাই আমাদের হাসির কারন বুঝতে পারলো না। তবে পরের প্রতিদিন তাকে দেখলেই আমরা বলতাম আয় তোরে বাঁশ দেই।
ঝিরিতে আমি
ঝিরিতে তৃষনায় দুঃশ্চিন্তা নাই, সেমী ঝর্না অগুনিত
একটু পড়ে ঝিরি ছেড়ে আমরা পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম। একটা চিকন গিড়ি পথ দিয়ে উপরে উঠতে হয়। রাস্তাটা সম্ভবত বৃষ্টির সময়ে পানির প্রবাহে তৈরি হয়েছে। ২ পাশে কাধ সমান ঢাল কোন রকমে পা পড়ে। এতক্ষন অনেকবার ঢাল বেয়ে উঠা নামা করতে হয়েছে। কিন্তু এটা বারাবারি রকম খারা। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার এটা উঠছে তো উঠছেই। ওঠা আর শেষ হয় না। কিছুক্ষনের মধ্যেই দম শেষ। ক্লান্তিতে সবার জিহবা বের হয়ে গেছে হাউন্ড কুকুরের মত। একটু পড়ে পড়ে বসে বিশ্রাম নিতে হয়। সবাই রেগে আগুন। সুখে থাকলে ভুতে কিলায়, তাই ভুতের কিল খাইতে এই বিশ্রি জঙ্গলে আসছি। ব্লা ব্লা ব্লা। অবশেষে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ার শেষ মুহুর্তে ঢাল শেষে আমরা পাহাড়ের চুড়ার উঠলাম। এখান থেকে স্কাইলাইন ব্রেক করে হাটা লাগবে। উপরে উঠে পাহাড়ের পিছনে জমাট মেঘের ভিতরে স্লিপি ব্লু ওশন টাইপ গ্রাম গুলো দেখে সবাই চুপ মেরে গেল। বকা বকি শেষ। অনবরত ক্যামেরার শাটার পড়তে লাগলো।
অল্প কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার হাটা শুরু। ট্রেকিং এ সবসময় আচার রাখতে হয়। দির্ঘ হাটার পথে চাটনী গুলো অমৃতের মত লাগে। ক্যান্ডি বা লজেন্সের চেয়েও কার্যকরী।
ঢাল শুরু এখান থেকে।
স্বর্প শিশু
আমরা আকা বাকা উচু নিচু রাস্তা ধরে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছিলাম। পথে বিচিত্র কিছু পাহাড়ি বন্যফুল পেয়ে ছবি তুলার জন্যে খুব কাছে যেতেই একটা সবুজ ছোট্ট খোকা সাপ বেড়িয়ে এল। চকচকে উজ্জ্বল সবুজ চামড়া, আর ছোট্ট ফনার মধ্যে থেকে কিউট পুতির মত চকচকে চোখ মেলে আমাকে দেখছিল। বেচারাকে ঘাবড়ে দেবার ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু ক্যামেরা তাগ করতেই ঘাবড়ে গিয়ে জঙ্গল ছেড়ে পথে বেড়িয়ে এল। এসে বাকিদের দেখে আরেক দিকে দৌড়। গ্রামের দিকে রাসায়নিক সারের কুফলে এখন ঝিঝি পোকার ডাক খুব কম শোনা যায়। কিন্তু পাহাড়ে আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে বড় আকৃতির একধরনের ফরিং চেহাড়ার পোকা। ঝিঝির মত কিন্তু অনেক জোড়ালো মেশিন গানের মত আওয়াজ করে। আমি বলি মেটাল ঝিঝি। গলার সাউন্ড বাংলা আন্ডার গ্রাউন্ড থ্রাশ মেটাল ব্যান্ডের গায়কদের মত। আর বড় বড় গুইসাপ, আর আচিলা (কালো রঙের একধরনে বড় গিরগিটি, অনেকটা রক্ত চোষার মত কিন্তু সবুজ না) চোখে পড়ছিল। চারপাশে বাঁশের জঙ্গল প্রচুর। বাশ বন থেকে থেমে থেমে টক্কের আওয়াজ। ঘর ঘর ঘর টক্কে টক্কে টক্কে। পাহাড়ি গ্রাম গুলোতে প্রতিটা বাসায় টিকটিকির বিকল্প হিসাবে টক্কে থাকে। এটাও দেখতে আচিলার মত। একটু ছোট কিন্তু টিকটিকির প্রায় দ্বিগুন। অনেকেই বলে এটাই নাকি তক্ষক। কিন্তু সমতলের কোন গ্রামে আমি তক্ষকের ডাক শুনিনি বা দেখি নি। তাই জানিনা তক্ষক আর টক্কে একই প্রানী নাকি।
ঘন্টা খানেক হাটার পরে আমরা একটা টং ঘরে আসলাম।সুর্য ডুবতে আর বেশী একঘন্টার মত আছে। সামনে একটা ভ্যালি, জুম খেতের পিছে দিয়ে পায়ে চলা পথ নিচের ভ্যালিতে কেওক্লাং পাড়ায় চলে গেছে। কিন্তু আমরা কেওক্লাং পাড়ায় যাব না। তাই ছোট্ট ব্রেক নিয়ে জোড় কদম হাটা শুরু করলাম। এবার এই রেঞ্জটা থেকে নামার পথ। এখন ট্রেইলটা অনেক সোজা, প্যাচ কম। চারপাশে একটু পরে বাশের জঙ্গল। বাংলাদেশের লোক, কাজলা দিদির ভাইয়েরা বাশ ঝারে চাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে না এমন কেউ নেই। বাশ বন বলতে আমরা সাধারন ভাবে বাশ ঝার বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু বাশ বন বা বাঁশের অরন্য আলাদা জিনিস। গায়ের সাথে গা লাগানো ঘন বাশের জঙ্গল, বিশাল বড়। ডিসকভারী বা ন্যশনাল জিওগ্রাফিতে বাঁশবনে পান্ডার ডকুমেন্টারীতে এধরনের অরন্য দেখা যায়। বাঁশের জঙ্গলে ঢুকতে ঢুকতেই দিনের আলো শেষ হয়ে গেল। চারপাশে জমাট অন্ধকার। মেশিনগানের মত করে একটানা মেটাল ঝিঝির আওয়াজ আরো ভৌতিক করে তুলেছে চারদিক। এবারে উঠার চেয়ে নামছি বেশি। হাটার ছন্দ চলে আসায় খুব দ্রুত অনেক রাস্তা পার হয়ে এলাম। রাব্বি ভাই কি জানি একটা হাইকিং টুলস ব্যাবহার করছেন। ওতে জিপিএস সুবিধা ছাড়াও পুরা রাস্তার একটা ম্যাপ তৈরি করে যেটা পরে গুগল আর্থে বসিয়ে নেয়া যায়। এছাড়া আমরা কত স্পিডে হাটছি কতক্ষন রেস্ট নিচ্ছি সব রেকর্ড হচ্ছে। স্পিড যথেষ্ট আশা ব্যাঞ্জক।
একটা ভ্যালিতে আসলাম। অন্ধকার বেশি তাই ঠিক মত ঠাহর হচ্ছেনা টর্চের আলোয়। চারপাশে বড় বড় মোটা গুরির শ্যাতলা পড়া বড় বড় রাজকীয় গাছ। অজগরের মত মোটা মোটা লতা ঝুরি নেমে এসেছে। চারদিকে বড় বড় ঝাকরা লতা আর ঘাসের জঙ্গল। গ্রামের কাছে তাই বড় হিংস্র জন্তুর ভয় না থাকলেও সাপের জন্যে একনাম্বার আওয়াজ। শব্দ টব্দ করছি। একটু পরে পরে পাহাড়িদের মত টারজান স্টাইলে হুয়া হুয়া শব্দ। সাপ টাপ থাকলে যেন আচমকা ভয় পেয়ে কামড় না দেয়। তোমাকে সারপ্রাইজ দেবার বা আক্রমন করার ইচ্ছা নাই। তুমিও আমাকে সারপ্রাইজ দিও না। জোরে হাটার কারনে মুলদল থেকে আমি আর লালতুয়ার ছেং আলাদা হয়ে গেছি। লালতুয়ার দাদা একটা সাঁকোর সামনে আমাকে রেখে উলটা দিকে গেলেন ওদের খুজতে। সাঁকো পেরুলেই পাইখং পাড়া।
কেওক্লাং পাড়ার রাস্তা।
কেওক্লাং পাড়ার রাস্তা।
সাঁকোটা কাঠের। দুপাশে রেলিং আছে। কিন্তু অনেক কালের পুরানো। পায়ের নিচে তক্তা গুলো ক্যাচ ম্যাচ করে। মাঝে মাঝে তক্তা ভ্যানিশ। ম্যাকগাইভার টাইপ মুভীতে আকছার নায়ককে এধরনের সাঁকো পেরুতে হয়। এবং নিয়ম করেই যেন নায়ক পাড় হবার সময় দু চারটা তক্তা খুলে পড়ে। আমার নায়ক হবার কিংবা ১৫/২০ ফিট নিচের পাথুরে ঝিরিতে পড়ার ইচ্ছা নাই। তাই সাবধানে ওজন পরীক্ষা করে করে আস্তে ধিরে সাকো পাড় হলাম। সামনে ১টা টিলার ওপারে বড় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাইখং পাড়া।
লাল তুয়ার ছেং বম, হাতে ওয়াকিং স্টিক পরীক্ষা করছেন।
সবাই আসতেই আমরা হাটলাম। দির্ঘ ক্ষন ওদের অপেক্ষায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পা জমে গেছে। হাটতে অসুবিধা নেই। কিন্তু উঠতে গেলেই পায়ের অনভ্যস্থ মাসল গুলো টন টন করে। লালতুয়ার দাদার থামা থামি যেন নাই। একটার পড় একটা ঢাল পারি দিয়ে আমরা পাইখং পাড়ায় ঢুকলাম। বাড়িতে বাড়িতে আলো জ্বলছে। সবাই সান্ধ্যকালীন উপাসনার জন্যে গির্জায় যাবার প্রস্তুতী নিচ্ছিল। বমরা খুব ধার্মিক হয়। আদি বম ধর্মের বিবর্তন নিয়ে কেওকারাডং এবং সেই ১৩ জন ব্লগে ডিসকাস করেছিলাম। এদিককার প্রতিটা গ্রামেই একাধিক গির্জা আছে, এবং এরা নিয়ম করে দুবেলা চার্চে ঢোল বাজিয়ে প্রার্থনা সঙ্গিত গায়। আমাদের গ্রামে গ্রহন করে নিলেন পাইখং পাড়ার কারবারীর ছেলে পিতর বম। গ্রামের কারবারীর বয়স হয়েছে। ঐদিন অসুস্থ তাই পিতর দা গ্রামের একটিং কারবারী। এমনিতেই গ্রামের অনেক কাজ কর্ম তাকেই করতে হয়, তাছাড়া ইয়াং বম এসোসিয়েশানের পাইখং পাড়া ব্রাঞ্চের ইনচার্জ। পিতর দা জানালেন গ্রাম প্রধানের বাসায় উঠাটা ঠিক হবে না। কারন তার কাপুনী জ্বর বেশ কিছুদিন ধরে। পাহাড়ের কুখ্যাত ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ার লক্ষন। তাই সেই বাসায় উঠাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
পাহাড়ে রাস্তাঘাট কিংবা মেকানিকাল বাহনের অনুপস্থিতির কারনে একটা চমতকার ট্র্যাডিশান আছে। অন্যান্য গ্রাম থেকে বিভিন্ন কাজে এ গ্রামে এলে বা অন্যকোথায় যাবার পথে জঙ্গলে রাত হয়ে গেলে গ্রামে রাত কাটাতে হয়। তাই মুসাফিরদের আশ্রয় দেয়া ওদের সংস্কৃতির অংশ। সাধারনত কারবারীকেই কাজটা করতে হয়। তবে প্রায় সব বাড়িতেই অতিরিক্ত কাঁথা বালিশ থাকে অতিথীদের জন্যে। ঠিক হলো আমরা লালতুয়ার দাদার ঘরেই থাকবো। লালতুয়ার দাদা গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত লোক, স্থানীয় স্কুলের টিচার। ৪০ এর মত বয়স হলেও এখনো অবিবাহিত। যখনকার কথা সেবার উনি তৃতীয় বারের মত ম্যাট্রিক পরীক্ষায় এটেন্ড করে রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। তবে লালতুয়ার ছেং অবস্থাপন্ন লোক। ঘরে সোলার ইলেক্ট্রিসিটি আছে। টেলিভিশন আছে, ব্যাটারীতে চলে সেটা এবং ডিভিডি প্লেয়ারটা। বান্দারবানে শোনা না গেলেও অনেক উচুতে চলে আসায় এফ এম রেডিওতে রেডিও ফুর্তি শোনা যায়। সেখানে বসেই শুনলাম গতকালকে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে তে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে বধ করেছে। ইস ঢাকায় থাকলে দলবেধে দেখা যেত। এই জঙ্গলে অবশ্য লাইভ ক্রিকেট কিংবা ফেসবুক অথবা বাংলা ব্লগ কোন মানে রাখে না। তাই খবরটা বেশি ইফেক্ট করলো না।
কুয়ার পানিতে গোসল করতেই সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। কাছে একটা দোকান ঘর আছে (গ্রামের একমাত্র) সেখানে চা এবং শেখ হোয়াইট সিগারেট পাওয়া যায়। আমরা দারুন খুশি হলাম যখন দেখি দোকানে আর তি (মুরগীর ডিম) পাওয়া গেল। ১৪টা ডিম সবগুলোই কিনে ফেললাম। রাতে জম্পেশ খাওয়া হবে।
জঙ্গলের পথে।
(চলবে।) পড়ের পর্ব, পাইখং পাড়া থেকে ফিয়াং বিদান পাড়া এবং রনীন পাড়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:২০