নিউ মালদ্বীপের প্রথম নাম শুনি শরীফের কাছে। কি আছে নিউ মালদ্বীপে তার জানার আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম যাব। ঢাকা থেকে যানজটের ঝামেল না থাকলে নিউ মালদ্বীপ খুব দূরে নয়। কিন্তু যানজটই মূল প্রতিবন্ধকতা। যদি আমাদের জানানো হয়েছিল নিউ মালদ্বীপ যাবার সহজ রাস্তা সায়েদাবাদ থেকে তিশা ভিআইপিতে চড়ে ইলিয়াটগঞ্জ হয়ে কোম্পানীগঞ্জ সেখান থেকে রাধানগর সিএনজি অটো রিকশা বা নবীনগর যাওয়ার পথে বটতলী,ফতেপুর নেমে টমটমে করে রাধানগর। তাছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তারপর গোকর্ন ঘাট থেকে নৌকায় যাওয়া যায়। কিন্তু এই পথে আমি যাইনি।
আমি কুমিল্লা হয়ে কোম্পানীগঞ্জ হয়ে ফতেপুর হয়ে রাধানগর পথে গিয়েছি।
রাধানগরের নামই এখন নিউ মালদ্বীপ।রাধানগরের নাম কেন মালদ্বীপ? তার উত্তর না খুজে আমি দ্বীপ ভ্রমণ শুরু করে দিলাম। ......(নাম ভুলে গেছি)............. বাজারে এসে জানানো হল এখান থেকে সামনে আর গাড়ি যাবে না। হাঁটা অথবা নৌকা।
নৌকাগুলো অসাধার সুন্দর ভাবে সাজানো।মনে হচ্ছে আজই রং করে নিয়ে আসা হল। আমি ছোট একটা সেতু পাড় হয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশা নিলাম। আমারে জেলে পল্লীতে নামিয়ে দেওয়া হল। হ্যাঁ এবার সত্যিই হাঁটা, সাঁতার না নৌকা ছাড়া বিকল্প নেই। চোখের সামনে শুধুই পানি পানি আর পানি। মাঝে কিছু গ্রাম ভেসে আছে। ব্যাটারি চালিত রিকসা থেকে নেমে কাছের গ্রামটিতে বাঁশের সাকো (হাক্কা) দিয়ে যেতে হয়।
নিউ মালদ্বীপে একটা চায়ের দোকান আছে। বাকি সবকিছুর জন্য নিকটবর্তী বাজারে যেতে হবে। গ্রামগুলো সর্ম্পকে একটা ধারণা পাওয়ার জন্য বলি গ্রামে ভাসমান স্কুল আছে। নৌকায় স্কুল। নৌকা যে শুধু স্কুল তাই নয়। নৌকা তাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।
গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নৌকা চালাতে অভ্যস্থ। নৌকা চালানো নিয়ে একজন হাসতে হাসতে বলেছিল। এই গ্রামগুলোর বৌ-ঝিরাও নৌকা চালাতে পারে।
সচ্ছ পানির এক খাল দিয়ে অসংখ্য নৌকা যাচ্ছে ভিন্ন গ্রামে, বিটঘর, বাড়িখোলা, মিরপুর বাকি গ্রামের নামগুলো ভুলে গেছি।
যে কারণে আমি এবার নিউ মালদ্বীপে গেলাম তার কথায় আসি। ঝাল খাওয়া ইদানিং আমার নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। আমি প্রচুর ঝাল খাই। হাওর অঞ্চলের মানুষরাও আামার ঝাল খাওয়া দেখে অবাক হয়।
নিউ মালদ্বীপ/রাধানগরকে বলা যেতে পারে দেশি মাছের জীবন্ত যাদুঘর। এই বর্ষায় আপনি কতশত রকমের মাছ যে পাবেন তা না গিয়ে বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমার শখ হল সীমের বীচি দিয়ে মাগুর মাছ খাওয়ার। বিশেষ বিবেচনায় আমার জন্য সীমের বীচি আনা হল। সারারাত ভিজিয়ে সেই বীচি দিয়ে মাগুর মাছ রান্না হল।
গুরা শিং মাছের ঝাল তরকারি রান্না হল। ছোট ছোট কৈ মাছ রান্না হল বিলাতি ধইন্না পাতা দিয়ে। অসম্ভব সবকিছুতে বেসম্ভব ঝাল।
আমার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। কোন কিছুতেই ঝাল লাগছে না। আমার জন্য তিনদিন আগ থেকে ভয়ানক ঝাল দিয়ে হাস রান্না করা হয়েছে। তাতেও আমার ঝাল লাগছে না। সবার নাকের পানি, চোখের পানি সাক্ষী রান্নায় ঝাল হয়েছে। কিন্তু আমার কোন সমস্যা নেই। আমি খাচ্ছি যে কয়েকদিন থাকব শুধুই খাব। প্রতিবেলা খাবারের পর পর গরু দুধ নিয়ে আসা হয় আমার জন্য। আ হ সুখ, সুখ, সুখ বলে আমি খাচ্ছি।
বাজারে এক কেজির বেশি ওজনের তেলাপিয়া মাছ নিয়ে আসল এক যুবক। তা রাতে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার আযোজন হল।
বিশেষ ভাবে বিছানা তৈরি করে। ম্যাজিক মশারি টানিয়ে দেওয়া হল গ্রামের শেষ বাড়ির মাচায়। এ মশারিতে বাতাস আসে পযার্প্ত। নতুন সচ্ছ পানিতে ডুব দিয়ে শীতল বাতাস এসে আমার গায়ে লাগছে।
আমি গান শুনছি। অসাধারণ গান। শীতল বাতাসে এই গান অসাধারন পরিবেশ তৈরি করেছে।
১.বাবা কেল্লা শাহ্ আউলিয়া আমাকে পাগল করলা প্রেম খেলা শিখাইয়া........
২.নবী বিনে বান্দব নাইরে রোজ হাশরের ময়দানে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কসবা,বাঞ্ছারামপুর, আশুগঞ্জ, নবীনগর, কুমিল্লার কিছু এলাকায় এখনো মাজার কেন্দ্রিক এক ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চ্চা দেখা যায়।গত কয়েক বছর যাবৎ আমি নিয়মিত যাচ্ছি। মাজারের মাজারে। উরস নিয়ে প্রতিটি গ্রামে উৎসব তৈরি হয়। এ এক অন্যরকম উৎসব। শহুরে ছক বাধা জীবনের ক্লান্তি দূর করতে এ ভিন্ন স্বাদের উৎসবের জুড়ি নেই ।
ম্যাজিক মশার নিচে শুয়ে দুদিনের ভ্রমণের ক্লান্তি ঝড়িয়ে। আমি কাক জেগে উঠার আগেই জেগে তৈরি হচ্ছি। ঢাকায় ফিরব। আসার পথে দুদিনে দেখা আর শোনা মাছের নামগুলো একবার বলার চেষ্টা করছি।
চান্দা, পুইটা চান্দা, সর পুটি, পুটি, তিত পুটি, কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, মলা, ঢেলা, চেলা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, কাইকা, বাইম, তারা বাইম, মেনি, বইচা বা খলিসা, ফলি বা কানলা, চিংড়ি, ভুইতা চিংড়ি, গজার, চেং, গুতুম, গাং গুতুম, উলিকলা লাডি, টাকি বা লাডি, চিতল, কালি বাউস।
দেশে ২৭০ প্রজাতির দেশিয় মাছ পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক উৎসের মাছে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ টন মাছ প্র্রাকৃতিক উৎস থেকে আসে।
আমাদের এই বিপুল সম্পদের কোন সুদৃষ্টি নেই। আমি সুস্বাদু মাছ খাচ্ছি ।কিন্তু আমার ভবিষ্যত প্রজন্মকে সেই মাছ খাওয়ার জন্য কোন সুযোগ রেখে যাচ্ছি না। যতই বলি চাষের মাছ। দেশিয় এই মাছের কাছে চাষের মাছের কোন তুলনা হয় না। কিন্তু আমরা এই সম্পদকে কোন ভাবেই মূলায়ন করতে পারছি না।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কাউকে স্বপ্ন দেখাতে পারছি জেলে হবার। উল্টো জেলের ছেলেকে শিখা দিয়ে ভিন্ন পেশায় নিয়ে যাচ্ছি।বাপ দাদার এই পেশাকে ঘৃণা করে ছুড়ে ফেলার নামই উন্নয়ন বলা হচ্ছে।
নিউ মালদ্বীপ শুষ্ক মৌসুমে সবুজের মাঠ আর বর্ষায় রূপালি মাছদের জীবন্ত যাদুঘর। যে মানুষটি শুষ্ক মৌসুমে কৃষক, সেই বর্ষায় পাক্কা মাছ শিকারি। কঠোর পরিশ্রমের জীবনে তাদের স্কয়ার, এ্যাপলো হাসপাতালের দরকার হয় না। মোটা চালের ভাত আর মাছের আমিষে তাদের গায়ে যতটুকু চর্বি জমায়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে তাও পুড়ে শেষ। এ জীবনযাত্রা যে শ্রেষ্ট তা কোথাও বলা হচ্ছে না। মিছে আমরা প্লোট্রি মোরগ ভাজা খাওয়াকে শ্রেষ্ঠত্ব বলে চালিয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু এই শহুরে মানুষের প্রতিটি হৃদয়কে প্রশ্ন করে দেখুন কি বলে?
বলে আমার কিছু টাকা হলেই গ্রামে চলে যাব। চাষবাস করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিব। তার অর্থ কি তা বুঝার জন্য। আমি কথা দিয়ে আসলাম। আবারও আসছি।
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবনের পাশাপাশি এই গ্রামগুলোতে যান। ভ্রমণের ভিন্ন স্বাদ নিন। শুভ #ভ্রমণ
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৯