অনেক আগের কাহিনী। তখনো বাসার শোকেসটা আমার মাথার অনেক ওপরে। এক বিকেলে মাঠে খেলতে গেছি। দেখি রঙিন কমিকসের দুইটা ছেঁড়া পৃষ্ঠা পড়ে আছে। কাছে গিয়ে কুড়িয়ে নিলাম। চাচা চৌধুরীর কমিকস। জীবনে এই কমিকসের নাম শুনিনি। মাঠের কোণার কাঠবাদাম গাছের কালো শেকড়ে বসে দুই পৃষ্ঠা পড়ে ফেললাম সাথেসাথেই। ঐ বই পড়ার পর থেকে কমিকসের নেশায় আক্রান্ত হলাম। চাচা চৌধুরীর কমিকসের বই কই পাবো, সে চিন্তায় রাতে ঘুম হয়না, দিনে কাহিল লাগে। সে এক বেহাল অবস্থা।
বাবা একদিন ঢাকা গেলো, প্রতিবার বাবা ঢাকা গেলেই আমি বইয়ের বিশাল ফর্দ ধরিয়ে দিতাম বাবার হাতে। আমার বাবাও লিস্টের প্রত্যেকটা বই নিয়ে ফিরতো ঢাকা থেকে। সেবার লিস্টের পুরোটা জুড়ে চাচা চৌধুরীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য। বাবা বাংলাবাজারে ঘুরে ঘুরে অনেকগুলো চাচা চৌধুরীর বই কিনে নিয়ে এলেন। মানুষ চাঁদ হাতে পেলেও বোধহয় এতটা খুশি হয়না, সেদিন আমি যতটা খুশি হয়েছিলাম।
তারপর, বিল্লু, পিঙ্কি, রমন, শ্রীমতিজী... অনেকগুলো চরিত্রের সাথেই পরিচিত হয়ে গেলাম খুব তাড়াতাড়ি। তিন গোয়েন্দা, কাকাবাবু, ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটী... এগুলো তো ছিলোই।
আসলে, স্মৃতিচারণ করতে বসিনি। হঠাৎ মনে পড়লো, বাবা যদি আমাকে এগুলো কিনে না দিতো, তাহলে কী হতো? কিছুই হতোনা, হয়তো দুয়েকবেলা ভাত না খেয়ে মুখ গোঁজ করে বসে থাকতাম। বাবার সাথে দুয়েকবেলা কথা বলতাম না। কিন্তু, বিশাল ক্ষতিটা হয়তো আমারই হয়ে যেতো। ছোটবেলায় ওই বইগুলো পড়তাম অবসর সময়ে। অন্যদিকে যেতে পারিনি, যাওয়ার সুযোগও পাইনি, আগ্রহও না। বিড়ি-সিগারেটের নেশা করিনি, তাস খেলিনি, মার্বেল খেলিনি। বলছিনা, এগুলো খারাপ। খারাপ-ভালো বলার আমি কে? তবে, সবকিছুর হয়তো নির্দিষ্ট একটা সময় আছে, এটুকুই। হয়তো ওগুলো করার জন্যে শৈশবটা উপযুক্ত বয়স ছিলোনা।
পেপার পড়া বাদ দিয়েছি অনেকদিন হলো। তবুও মাঝেমধ্যে দুয়েকটা খবর কানে চলে আসে, চোখে ভেসে ওঠে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। কেউ মোটরসাইকেলের জন্যে বাবা-মায়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, ঐশীর মত কেউ কেউ বাবা-মা'কে মেরে ফেলছে নেশাগ্রস্থ হয়ে, কেউ নেশার টাকা না পেয়ে বাবা-মা'কে জবাই করছে ধারালো রামদা দিয়ে... হলফ করে বলতে পারি, এদের শৈশবে বই ছিলোনা, এদের শৈশবে চাচা-চৌধুরীরা ছিলোনা, এদের শৈশব অসুস্থ ছিলো, মুমূর্ষু ছিলো, সংকটাপন্ন ছিলো, ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। এদের গোড়াতেই পচন ছিলো।
সদ্য সদ্য যারা যারা বাবা-মা হয়েছেন, তাদের দায়িত্বটা একটু বেশি। একতাল কাদার মত যে বাচ্চাটা আজ জন্ম নিচ্ছে, কালকেই সে প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে সমাজকে আঘাত করবে কী না, সে কথা কেউ জানেনা। কিন্তু, আপনি, বাবা-মা, চাইলেই কিন্তু পারেন নিজের সন্তানের শৈশবকে জীবাণুমুক্ত করে দিতে। পারেন তাদের হাতে অনেকগুলো বই তুলে দিতে, পারেন তাদের হাত থেকে ভিডিও গেমসের জয়স্টিক সরিয়ে দিতে, পারেন তাদেরকে মেলা থেকে খেলনা পিস্তলের বদলে রুবিকস কিউব কিনে দিতে। এতে করে আপনার সন্তান বাঁচবে অসুস্থ পরিবেশের হাত থেকে, সমাজও বাঁচবে একইসাথে।
এ দায়িত্ব আপনার, আপনাকেই নিতে হবে। নাহলে, পরে আপনার সন্তানের হাতেই আপনি যদি নিহত হন, নৃশংসভাবে আহত হন, সে দোষ কিন্তু পুরোটা আপনার ওপরেই বর্তাবে। আপনিই হয়তো প্রচ্ছন্নভাবে আপনার সন্তানকে এই নৃশংসতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার বড় প্রভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরাবরই, আপনারই অজান্তে। তাই, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ মোটেও নেই।
আখেরে তাতে আপনার ক্ষতি, আপনার সন্তানের ক্ষতি, আমাদের ক্ষতি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৭:২৪