somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ ট্রিবিউট টু কিশোর পারেখ ০২ : যেভাবে কিশোর পারেখ এলেন প্রিন্ট মিডিয়ায়

১০ ই জুলাই, ২০০৮ সকাল ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। নিয়াজী অরোরা হেটে যাচ্ছেন। নিয়াজীর আরেক পাশে মেজর হায়দার। ছবি কপিরাইট : স্বপন পারেখ



আমি কখনো প্রেস ফটোগ্রাফার হতে চাইনি।

দি হিন্দুস্তান টাইমসের অফিস। কিছু কিছু সময় আসে মানুষকে অতীতে টেনে নিয়ে যায়। সেই অতীত এসে টান দিল ১৯৬২ সালের এক সন্ধ্যায়। কয়েক দিন আগে জওহরলাল নেহরুর মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। অবশ্য ওটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু ছিল না। একজন ফটোগ্রাফারকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া আছে। দিনের কাজগুলো গোছানো শেষ। সহকর্মীকে বললেন কিশোর পারেখ - জানো, আমি কখনো প্রেস ফটোগ্রাফার হতে চাইনি। হিন্দুস্তান টাইমসের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবে তোমরা যে কিশোরকে চেনো, সে কখনো পত্রিকা লাইনেই আসতে চায়নি।

খুব ছোটবেলা থেকেই কিশোরের আগ্রহ ছিল সিনেমার প্রতি। না, সিনেমার রঙমাখা ভুবন নয়, তাকে টানতো প্রতিটা মুভির ক্যামেরার কাজ। এই আগ্রহ কিশোরকে নিয়ে যায় আমেরিকার হলিউড পর্যন্ত। সেখানে সিনেমাটোগ্রাফি বিষয়ে ডিগ্রি নেয়ার পর কিশোর ফিরে আসেন ইনডিয়ায়। তার ধারণা ছিল বম্বে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, ফেরা মাত্রই তাকে লুফে নেবে।

কিন্তু কিশোরের জন্য অপেক্ষা করছিল বিশাল এক ব্যর্থতা। সপ্তাহ যায়, মাস যায়। কিন্তু বম্বে ফিল্ম সিটির একটা মিনিটও সময় ছিল না কিশোরকে মূল্যায়ন করার। এক পর্যায়ে হতাশা গ্রাস করে কিশোরকে। ‘আমাকে মাসে স্রেফ ৫০০ রুপি দিন, আমি আপনার সিনেমা দাড় করিয়ে দেবো।’

কিশোরের কথা শোনারই সময় কারো ছিল না। কাজ দেখা তো অনেক পরের ব্যাপার। এক পর্যায়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা গ্রাস করে তাকে।
জীবনের এই চ্যাপ্টারে এসে কিশোর একদিন তার এক বন্ধুর সঙ্গে গেলেন এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে। কাজটি ছিল বন্ধুর। কিশোর কেবল তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। আর ওই বৃদ্ধ ছিলেন ইনডিয়ার শীর্ষ শিল্পপতি জি ডি বিড়লার কাকা।

বন্ধু কথা বলছে বিড়লার কাকার সঙ্গে, আর কিশোর বসে সব চুপচাপ দেখছে। ধীরে ধীরে এই বৃদ্ধের প্রতি কিশোরের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। তার কথাবার্তা, চালচলন কিশোর খেয়াল করতে থাকেন। তার পান খাওয়ার ভঙ্গি, ঠোটের ফাক দিয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়া, সব।

কিছুক্ষণ পর ফোন এলো ভদ্রলোকের। তিনি ফোনে কথা বলছেন খুবই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে। কিশোর টেরও পাননি অবচেতন মনে তার লাইকা ক্যামেরাটি উঠে এসেছে হাতে। ভদ্রলোক হেসে উঠলেন ফোনে কথা বলার মাঝখানে ··· ক্লিক।

ওই একটি স্ন্যাপ শটই ছিল কিশোর পারেখের জীবনে মোড় ঘোরার টার্নিং পয়েন্ট।

কাকার এমন চমৎকার পোরট্রেইট দেখে জিডি বিড়লা বেশ খুশি হলেন। বাহ দেখেই বোঝা যায়, একজন মানুষকে ভালোভাবে স্টাডি করার ফল এ ছবি। কে তুললো এটা?

ওই ছবি তোলার ফল ফললো মাত্র দু’দিনের মধ্যেই। নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এবার স্বয়ং বিড়লার ফটো তুলে দিতে হবে।

আবার অ্যাকশনে ওই একই লাইকা ক্যামেরা। কিশোর পারেখ চলে গেলেন বিড়লার অফিসে। ১০ মিনিটের ফটোসেশন। তারপর ভিআইপি কায়েন্টকে থ্যাংক ইউ স্যার বলে কিশোর বেরিয়ে এলেন।

পরদিন কিশোর আবার গেলেন বিড়লার অফিসে। বিড়লার ফটো বিশাল একটা প্রিন্ট হাতে রোল করে নিয়ে।

ছবি দেখে বিড়লার ভ্রূ কপালে উঠে গেল। তিনি মিনিটখানেক তাকিয়ে রইলেন ফটোর দিকে।

কি ছিল সেই ফটোতে?

বিশাল এক একজিকিউটিভ টেবিল। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে দেয়ালে টানানো ইনডিয়ার ম্যাপ। যেখানে ইনডিয়ার সেই এলাকাগুলো চিহ্নিত করা আছে। যেখানে বিড়লা সাম্রাজ্যের কোনো না কোনো ব্যবসা আছে। আর এ দুয়ের মাঝখানে আলো-আধারিতে বসা একজন মানুষ। জিডি বিড়লা বলে চেনা যায় কি যায় না।

কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন বিড়লা। ছবিতে আমার চেহারা এতো ছোট করে তুলেছো কেন?

কিশোর দাঁড়ানো। বিড়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার, আমি আর আপনি একই রাজ্যের লোক। ছোটবেলা থেকেই আমি আপনার বিভিন্ন গল্প-কাহিনী শুনে বড় হয়েছি। আমি জেনেছি কিভাবে আপনি এতো বিশাল এক ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন। তখন থেকেই যখনই আপনার নাম আমি শুনি, আমার মনে আপনার চেহারার বদলে ভেসে ওঠে আপনার ব্যবসার কথা, বিশাল সাম্রাজ্যের কথা।

আপনার ফটো যখন তুললাম, তখনো একই চিন্তা আমার মাথায় ছিল। আমার কাছে আপনার এই বিশাল কাঠের টেবিল আসলে আপনার পদমর্যাদা আর ক্ষমতার প্রতীক। আর পেছনের ওই দেয়ালের ম্যাপ জানান দেয় আপনি আসলে কতোটা বড়। কতো বিস্তৃত আপনার সীমানা। আর এই দুটো মেলালে যা হয়, তাই জিডি বিড়লা। এই দুটো জিনিসই প্রকাশ করে আপনার সাহস, চরিত্র আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। এসব মিলিয়ে যে বিশাল বিষয়টি দাড়ায় তাই বিড়লা। এটাই বিড়লার আসল চেহারা।

কেমন যেন একটা ধাক্কা খেলেন বিড়লা। তিনি এভাবে কখনো ভাবেননি। তিনি আবার তাকালেন ফটোর দিকে তারপর সম্মত হলেন। ৩০ বছর বয়সী এ ইয়াং ম্যান ঠিকই বলেছে। তিনি কিশোরকে বসতে বললেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় কাজ করো তুমি।

কিশোর বললেন, আমার এখনো কোনো কাজ নেই স্যার। আমি একজন সিনে ক্যামেরাম্যান। অপেক্ষা করছি একটা ভালো ব্রেক পাওয়ার আশায়।
বিড়লার আগ্রহে কিশোর তখন মনে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

অনেক ক্ষমতাবান লোক বিড়লা। যদি সুপারিশ করে কোথাও পাঠান, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিশ্চয়ই তাকে ফেলে দেবে না। কিন্তু বিড়লার মনে তখন অন্য চিন্তা। বললেন, তোমাকে যদি আমি চাকরি দিই?

কিশোর উৎফুলস্ন। থ্যাংক ইউ স্যার। সো নাইস অফ ইউ।

ঠিক আছে। বিড়লা বললেন, আমি চাই তুমি দিল্লিতে আমাদের পত্রিকা দি হিন্দুস্তান টাইমসের ফটোগ্রাফি সেকশনের চিফ হিসেবে জয়েন করো।

মাই গড! এ লোক বলে কি? পত্রিকায় চাকরি তখন কিশোরের কল্পনাতেও নেই। তার মনে তখন ঘুরছে ফিল্ম দুনিয়া।

ন-ন-না স্যার। তোতলাতে তোতলাতে কিশোর বললেন।

প্রশ্ন এলো- সমস্যাটা কি?

কিশোর ভাবলেন এই তো সুযোগ। সমস্যা জানতে চাইছে, তাহলে সমস্যাই বলি। এমন বেশি বেতন চাইবো যে, তুমি মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী আমাকে তাড়াতে পারলে বাচবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। কিশোর একখানা বেতন চাইলেন বটে। মাসে দশ হাজার।

বেতনের পরিমাণ বলতে যা দেরি। বিড়লার মুখ থেকে উত্তর এলো - ঠিক আছে, দেয়া হবে।

কিশোরের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা। বলে কি? ৫০০ রুপির চাকরি পেলেই কিশোর বর্তে যায়। আর এই লোক ১০ হাজার দেবে। যাই হোক কিশোর দমার পাত্র নন। দ্বিতীয় দাবি, বাড়ি ভাড়া লাগবে স্যার।
বিড়লা বললেন - ঠিক আছে পাবে।

আর গাড়ি লাগবে। তখনো কিশোরের আশা এতো কিছু চাইলে ভদ্রলোক নিশ্চই বেকে বসবেন। অন্যদিকে এই ছোকরাকে বিড়লার চাই-ই চাই। বললেন - ঠিক আছে, সবই পাবে। তুমি আগামী সোমবার দিল্লিতে পত্রিকার সম্পাদক দেবদাস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে কাজে যোগ দিচ্ছো।
কিশোরকে স্তম্ভিত করে দিয়ে নিজের প্রিন্ট করা ছবিটা রোল করে হাতে নিয়ে বিড়লা উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন।

ঘরের মধ্যে কিশোর একা দাড়ানো। এই ছিল কপালে! এটা কি হলো, ভালো না খারাপ?

কিশোরকে যারা ভালো করে চিনতেন, তার ফটোগ্রাফির ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখতেন তারা বললেন, এতোদিনে সত্যিকারের ব্রেক পেয়েছে কিশোর।

নিজের মনেই কিশোর বললেন, ঠিক আছে। এটাই যদি নিয়তি হয় তবে আমি চ্যালেঞ্জ নেবো। কতোটা আস্থা থাকলে আমাকে ১০ হাজার রুপি বেতন দিতে পারে? ঠিক আছে আমি তার ভরসার মর্যাদা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

কাজেই পরের সোমবার ঠিক সময় মতো কিশোর পারেখকে দেখা গেল হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদকের রুমে এসেছে কাজে যোগ দিতে। অন্যদিকে সম্পাদক দেবদাস গান্ধীও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নতুন ফটোগ্রাফি চিফের জন্য।

কিশোর তার কথা রেখেছিলেন। মাসখানেকের মধ্যেই হিন্দুস্তান টাইমসের ফটোগ্রাফির চেহারা পাল্টে যেতে শুরু করে। কিশোর প্রমাণ করেন ফটোজার্নালিজম কতোটা ক্রিয়েটিভ হতে পারে। সম্মান থেকেছিল বিড়লারও। প্রমাণ হয়েছিল তিনি রত্ন চিনতে ভুল করেননি।

(১৯৭১ পর্ব আসছে...)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০০৮ দুপুর ১২:৩৩
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×