somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ ট্রিবিউট টু কিশোর পারেখ ০৩ : একাত্তরের ছবিগুলো

১২ ই জুলাই, ২০০৮ দুপুর ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফটোগ্রাফ ১
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
লেফটেনান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী হেটে যাচ্ছেন। তার ডান পাশে আরেক লেফটেনান্ট জেনারেল। তিনি জগজিৎ সিং অরোরা। নিয়াজীর বাম পাশে মেজর হায়দার। পেছনে মুক্তি। সে সময়ে পাকিস্তানিদের কাছে মুক্তিবাহিনীর সংক্ষিপ্ত নাম ছিল মুক্তি। এই মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের দেখা যায় অনুসরণ করছেন উল্লিখিত নেতৃস্থানীয়দের। তারা সবাই হেঁটে যাচ্ছেন দলিলে সই করতে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক পরাজয়ের দলিলে সই করতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতি বছর আমরা দেখি এই ফটোগ্রাফ। দেশের প্রতিটি নিউজপেপার ১৬ ডিসেম্বর ছাপে এই ছবি। এর সঙ্গে আরো কিছু ছবি যোগ হয় ছাপার তালিকায়।

ফটোগ্রাফ ২
ঢাকার রাস্তা। জনশূন্য। রাস্তার পাশের দালানের সারি দেখে বোঝা যায় রাস্তাটি পুরনো ঢাকার। বন্দুক হাতে তিন গেরিলা এগিয়ে যাচ্ছেন। ছবিটা গেরিলাদের পেছন থেকে তোলা। যোদ্ধরা যাদের ধাওয়া করছে, তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেবল রাস্তার ওপর দেখা যায় পড়ে আছে একটি
আর্মি বুট। ওই একটি চিহ্নই বলে দেয় ধাওয়া করা হচ্ছে পাকিস্তান আর্মিকে।

ফটোগ্রাফ ৩
বহু দেখা ছবি এটি। এক পাক সোলজারের সামনে দাড়ানো লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এক বাঙালি। সোলজারের নির্দেশে লোকটি তার লুঙ্গির
গিট আলগা করেছে। পাকিস্তানি সোলজার লুঙ্গির ভেতর তাকিয়ে দেখছে লোকটির সাবকামসেশন করা হয়েছে কি না।

১৯৭১ সালের কথা মনে হলেই আমাদের সামনে যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে এই ছবিগুলো ভেসে ওঠে। এই ফটোগ্রাফগুলোই আমাদের সাহায্য করে যখন পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা বলতে চাই আমাদের সেই বিশাল অর্জনের কথা, ভয়াবহ সেই দিন কিংবা রাতের কথা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফটো ডকুমেন্টেশন যারা করেছেন তাদের অনেকের নামই আমরা জানি। রশীদ তালুকদার, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, মনজুর আলম বেগ, মোহাম্মদ আলম, আফতাব আহমেদের মতো অনেক ফটোগ্রাফারের নাম জানা যায়। বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ছিলেন ডন ম্যাককালিন, রেইমন্ড ডিপারডন, মার্ক রিবান্ড, ম্যারি অ্যালেন মার্ক, রঘু রাই (মুক্তিযুদ্ধের ছবি যাকে এনে দেয় ভারতের সর্ব্বেচ্চ অসামরিক পদক পদ্মশ্রী)), মেরিলিন সিলভারস্টোন, কনটাক্ট প্রেসের ডেভিড বার্নেট, এপির সংবাদ সংস্থা এপির বাঘা ফটো এডিটর হর্স্ট ফাস যিনি মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেই জিতে নেন পুলিটজার প্রাইজ, ম্যাগনাম ফটোজ-এর ইরানিয়ান ফটোগ্রাফার আব্বাস এবং সে সময়ে ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত বিদেশি ফটোসাংবাদিক। বিদেশি ফটোগ্রাফারদের মধ্যে প্রায় সবাই এখানে ছিলেন অ্যাসাইনমেন্টে।

যে তিনটি ফটোর বর্ণনা দেয়া হলো তার সবই একজন ফটোগ্রাফারের তোলা। নাম কিশোর পারেখ। কিশোরের এই তিনটিসহ আরো কিছু ফটো প্রতি বছর ছাপা হয় দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে। আমাদের দূর্ভাগ্য, কোনো পত্রিকাই এই ফটোর পেছনের মানুষদের জানার বা পরবর্তী প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেনি।

৭১ সালের পরিচিত ছবির ফটোগ্রাফারদের মধ্যে সম্ভবত কিশোর পারেখ ছিলেন সেলফ অ্যাসাইন্ড। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, তিনি নিজেই চলে এসেছিলেন এ দেশে যুদ্ধের ডকুমেন্টেশন করবেন বলে।

১৯৫৬ সালে ২৬ বছরের কিশোর চলে যান আমেরিকায়। তার আগ্রহ ছিল ফিল্মে। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেসময়ই ফিল্ম নিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি ঝুকে পড়েন ফটোগ্রাফিতে। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন যখন লাইফ ম্যাগাজিন এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কনটেস্টে সাতটি ক্যাটেগরির মধ্যে ছয়টি পুরস্কারই জিতে নেন।

১৯৬১ সালে কিশোর লেখাপড়া শেষ করে ফিরে আসেন ইনডিয়ায়। বেশ কিছুদিন তিনি চেষ্টা করেন তার পড়লেখা বম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগাতে। কিশোরের ধারণা ছিল দেশে আসার পরপরই বম্বে মুভি ইন্ডাস্ট্রি তাকে লুফে নেবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।

তাকে লুফে নেয় বিড়লা পরিবার। কিশোর পারেখ যোগ দেন তাদের পত্রিকা দি হিন্দুস্তান টাইমসের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবে। এর পর ছয় বছর কিশোর কাজ করেন ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে। পাল্টে দেন ইনডিয়ান প্রেস ফটোগ্রাফির চেহারা। ১৯৬১ থেকে ৬৭ সালকে বলা হয় ইনডিয়ান প্রেস ফটোগ্রাফির স্বর্ণযুগ। এর আগেও প্রেস ফটোগ্রাফি সেখানে ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হতো ফিক্সড কিছু কমন ফরমাটের ছবি। যেমন হ্যান্ড শেক বা বক্তৃতার ছবি।

কিশোর ফটো রিপোর্টের গোটা ফরমাটই বদলে ফেলেন। কেবল ডকুমেন্টেশন বাদ দিয়ে তিনি চলে যান সাবজেক্টের গভীরে। খোঁজ করার চেষ্টা করেন নিউজ তৈরি করা প্রতিটি ঘটনার ফল যা প্রভাব ফেলে মানুষের জীবনে। এর সফল প্রয়োগ তিনি ঘটান বিহারের দুর্ভিক্ষ কভার করতে গিয়ে। জওহরলাল নেহরুর জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে প্রাঞ্জল ডকুমেন্টেশন কিশোরের ছবি। নেহরুর মৃত্যুর পর কিশোর পারেখের একজিবিশন সাধারণ ইনডিয়ানদের জন্য হয়ে ওঠে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানানোর স্থান।

৬৭ সালের পর কিশোর পারেখ ফটো জার্নালিজম ছেড়ে দেন। তিনি চলে যান সিঙ্গাপুর ও হং কং-এ। সেখানে তিনি যোগ দেন দি এশিয়া ম্যাগাজিন-এ। সেখানে এক্সক্লুসিভ কিছু ফটো সিরিজ করেন পারেখ। এর পর তিনি কাজ করেন দি প্যাসিফিক ম্যাগাজিন লিমিটেড-এ। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন পিকচার এডিটর।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিশোর যখন ট্রাভেল এবং ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত, তখন একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসবেন। কারণ তার দেশ তখন জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধে। দ্রুত যোগাড় করেন ৪০ রোল ফিল্ম। প্রথমে আসেন ইনডিয়ায়। এক বন্ধু তাকে পৌছে দেয় বর্ডারে। জোর করে তিনি ঢুকে পড়েন প্রেস হেলিকপ্টারে। তারিখটি ৮ ডিসেম্বর। ১৬ তারিখ বিজয় অর্জন পর্যন্ত কিশোর ছিলেন বাংলায়।

কাজ শেষ করেই মুহূর্ত দেরি না করে তিনি ফিরে যান। টানা তিন দিন তিন রাত সময় দিয়ে ফিল্ম ডেভেলপ করেন। ল্যাব থেকে যখন তিনি বের হন, তার হাতে ছিল ৬৭টি সফল ফটোগ্রাফ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এতো কম সময়ে এতো সফল ফটোগ্রাফি আর কেউ করতে পারেননি সে সময়। সে ছবিগুলো অলম্বন করে পরে তিনি বাংলাদেশঃ এ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর কিশোর আবার ফিরে যান কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফির পেশায়। ১৯৮২ সালে ৫২ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কিশোর আর ফিরে আসেননি প্রেস ফটেগ্রাফিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ২:১১
১২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×